Views Bangladesh Logo

ভোটে নয়, জোটের রাজনীতিতেই গুরুত্ব নতুন দলগুলোর!

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

ঠাৎ করেই একসঙ্গে দুই ডজনেরও বেশি রাজনৈতিক দল এবং প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব দেখেছে বাংলাদেশ, যে ঘটনা গত সাড়ে ৩ দশকেও ঘটেনি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রেক্ষাপটে নতুন বন্দোবস্ত গড়বার একই ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকারে আত্মপ্রকাশ করেছে দলগুলো। পক্ষে জনমত, জনবল ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের ধারণা কম থাকলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটে নয়, জোটের রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।

রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, এরশাদের আমল থেকেই প্রতি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল গঠনের এই ধারার সূচনা। তবে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে ছাড়া এত বেশিসংখ্যক দল আর কখনোই আসেনি।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের এই প্রবণতা যতটা না গণতন্ত্রায়ন বা ভোটের রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ, তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ও জোট গঠনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বার্থের সমীকরণ মেলানোর প্রচেষ্টা।

নতুন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে সরকারে থাকা বা সরকার গঠন করতে যাওয়া দলগুলোকে সুবিধা দিচ্ছে তাদের মতবাদ প্রচার এবং প্রতিষ্ঠায়ও।

অবশ্য নতুন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে নতুন রাজনৈতিক মাত্রা যোগ হবে বলেই আশাবাদী দলগুলোর সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর প্রায় নয় মাসে অন্তত ২৭টি রাজনৈতিক দল বা প্ল্যাটফর্ম গঠনের খবর এসেছে গণমাধ্যমে, যার মধ্যে গত বছর ১১টি ও চারটি প্ল্যাটফর্ম আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আত্মপ্রকাশ করেছে ১২টি দল।

দলগুলো হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ মুক্তির ডাক ৭১, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ, দেশ জনতা পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক শক্তি, বাংলাদেশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিএসডিপি), বাংলাদেশ জন-অধিকার পার্টি, জনতার বাংলাদেশ পার্টি, জনতার দল, গণতান্ত্রিক নাগরিক শক্তি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, আ-আম জনতা পার্টি (বিএজেপি) এবং জনতা পার্টি বাংলাদেশ।

আর প্ল্যাটফর্মগুলো হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ এবং গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, বিশটিরও বেশি রাজনৈতিক দল বা প্ল্যাটফর্ম এসেছে। এগুলোর মাঝে নিবন্ধন না পেলেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনায় রয়েছে এনসিপি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একমাত্র এই দলটিই এককভাবে নির্বাচন করার মতো জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম। এনসিপি গঠন থেকে বেরিয়ে আসা ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের নতুন সংগঠন, ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ বা আপ বাংলাদেশও কিছুটা আলোচনায় আছে। আর নতুন করে আলোচনায় এসেছে জনতা পার্টি, বাংলাদেশ।

তার মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনেক ধরনের জোটের কথাই শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে বৃহত্তর জোট গঠনে সাবেক জোটসঙ্গী এবং ডান-বাম দলগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনা চালাচ্ছে বিএনপি। ইসলামিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ জোট গঠনে আলোচনা চালাচ্ছে জামায়াতও। জোটভিত্তিক নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় নতুন দলগুলোর মধ্যে দুই একটি এসব জোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে।

তবে ক্ষমতায় যেতে নয়, গঠনমূলক বিরোধিতায় সরকারকে দেশের উন্নতির কক্ষপথে নিয়ে আসার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়তে চান বলে দাবি করছে নবগঠিত দল ও প্ল্যাটফর্মগুলো।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন দল তখনই গড়ার প্রয়োজন পড়ে, যখন আগের দলগুলো জনগণের ভাষা ও চাহিদা বুঝতে ব্যর্থ হয় এবং নতুন করে কাউকে তা উচ্চারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এনসিপি এক নতুন বন্দোবস্তের কথা বলছে, যা দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করে এদেশের নাগরিকদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে।’

বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টির দপ্তর সম্পাদক কাজী শামসুল ইসলাম বলেন, ‘জোট আসলে মূল কথা নয়। রাজনৈতিক দলের কাজই হচ্ছে, তার আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনমত গঠন করা। আমরাও চাই, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে আমাদের আদর্শের পক্ষে মতবাদ গড়ে তুলতে।’

‘ক্ষমতায় যেতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের লক্ষ্য, গঠনমূলক বিরোধিতায় সরকারকে দেশের উন্নতির কক্ষপথে নিয়ে আসা এবং সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখা’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এবং জনতা পার্টি বাংলাদেশের মহাসচিব শওকত মাহমুদ বলেন, প্রতিটি গণঅভ্যুত্থান, বিপ্লব ও আন্দোলনের পর সেসব সংগ্রামী চেতনায় নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় ঘটে। যেহেতু রাষ্ট্র সাজবে একাত্তর ও চব্বিশের গণজাগরণের চেতনায়, সেই আঙ্গিকে নতুন দলের আবির্ভাব অনিবার্য। জাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতীয় প্রত্যাশায় সব ধরনের বৈষম্য, ফ্যাঁসিবাদ, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে জনকল্যাণ, ইনসাফ, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতে এবং গর্বিত জাতীয়তাবোধ দৃঢ় করতেই জনতা পার্টি বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ।

নবগঠিত দলগুলোকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানুল্লাহ আমান বলেন, ‘শুধুমাত্র জোটের অবস্থানেই এই নতুন বা ছোট দলগুলোর মূল্যায়ন করলে আসলে ভুল করা হবে। দলীয় আদর্শিক জায়গা এক না হলে তো একসঙ্গে আন্দোলনে রাজপথে নামাও যায় না। আবার পরস্পরের প্রতি যে বিশ্বস্ততা, সেটিও কার্যকরীভাবে আসে না।’

‘আবার তাদের ভোট কম মনে হলেও তারা কোনো না কোনো গোষ্ঠীর সমর্থন অর্জন করতে পেরেছেন বলেই দল গঠন করেছেন। তাই এই জনগোষ্ঠীর প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে, তাদের নাগরিক অধিকারটুকু নিশ্চিতে এই দলগুলোর ভূমিকা অস্বীকারেরও উপায় নেই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নির্বাচনী ব্যবস্থা গবেষক নেসার আমিন মনে করছেন, এই নতুন দলগুলো সাধারণত নিবন্ধিতও হয় না। কোনো কোনো দল নিবন্ধন নিলেও দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে অংশ নেয়া ছোট দলগুলোসহ এই নতুন দলগুলো ভোট পাচ্ছে মোট ভোটের এক শতাংশেরও নিচে। তবে তারা বড় দলের সহায়তা এবং প্রতীকে নির্বাচন করলে কিছু ভোট পাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, নতুন দল আসা মানে হলো, নতুন ভাবনার আবির্ভাব। নতুন এক পন্থার চর্চা। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো নতুনকে গ্রহণ করার ক্ষমতা। তবে এই নতুন দল গঠন যে সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশে আসে, ব্যাপারটা এমনও নয়। এর সঙ্গে থাকে জোটে অঙ্গীভূত হয়ে রাজনৈতিক সমীকরণে ফায়দা তোলার মানসিকতাও।

অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তীর মতে, মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন দলের আগমন দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে এনসিপি বাদে, এই ছোট দলগুলোর সক্রিয়তার মূল কারণ, মূলত পারস্পরিক সুবিধা লাভ। আবার আদর্শিক কারণে সবার সঙ্গেই কিন্তু জোট গঠিত হচ্ছে না। অর্থাৎ, রাজনৈতিক আদর্শিক যুথবদ্ধতা ও রাজনৈতিক লাভ আহরণও জোটের পেছনের মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে ছোট দলকে জোটে টানার বিষয়ে মতাদর্শিক বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। এর মধ্যে বড় যে দলের সঙ্গে মতাদর্শগত মিল থাকে, ছোট দলগুলো সেদিকেই বেশি ঝোঁকে। এভাবেই বিএনপি ২০-দলীয় জোট করেছিল আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগকে ১৪-দলীয় জোট গড়তেও দেখেছি।’

অধ্যাপক দিলারা বলেন, ছোট দলগুলোর যিনি প্রধান থাকেন তাদের প্রতি জনগণের ব্যাপক সমর্থন না থাকলেও তাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা কোনো না কোনো জায়গায় নিরঙ্কুশ বা অন্তত মেনে নেয়ার মতো থাকেই। যেমন কর্নেল অলির এলডিপি বা আন্দালিব রহমান পার্থর বিজেপি এবং হালের জনতা পার্টি বাংলাদেশ-এর ইলিয়াস কাঞ্চন বা শওকত মাহমুদ। এই ধরনের ব্যক্তিত্ব যখন কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে যুক্ত হন তখন সেই মতাদর্শ রাজনৈতিক পরিসরে বিকশিত করার এক ধরনের চেষ্টাও তাদের মাঝে থাকে যা বড় দলগুলোর মাঝে যথাযথ বৈচিত্র্য নিয়ে আসে।

‘তবে এই দলগুলো ক্ষমতার মাঝে থাকলেও ক্ষমতা বন্টনে খুব বেশি দাবি রাখতে বা উচ্চকিতও হবার সক্ষমতা রাখে না, যা প্রকৃতপক্ষে বড় দলের অনুকূলেই যায়। ফলে জোটের এই রাজনীতিতে দলের সংখ্যা বাড়িয়ে একদিকে প্রচারণায় জনমত নিজেদের পক্ষে আনার সুযোগ তৈরি হয় অন্যদিকে ক্ষমতার বণ্টনে নিজেদের আধিপত্য রাখতে পারে বড় দলগুলো’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ