বর্জ্যবাহী গাড়ি যেন আর কোনো প্রাণ কেড়ে না নেয়
মাহিন ছিল বাবা-মায়ের সবচেয়ে বড় আশা-ভরসার জায়গা। অর্থ সংকটের কারণে বড় ছেলে মাহফুজের মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা হয়নি। অনেক কষ্ট করে ছোট ছেলে মাহিন ও মেয়ে ফাতেমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মা-বাবা। মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো ছিল। ক্রিকেট, ফুটবল ও সাঁতারে এলাকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিল সে। মাহিন অবশ্য এগুলোর চেয়েও ভালো করছিল সাইক্লিংয়ে। বন্ধুদের কাছে বড় সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা বলত এই কিশোর। এক দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে দুরন্ত মাহিনকে ঘিরে পরিবারের সব স্বপ্ন।
তথ্য মতে জানা যায়, বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে উত্তর মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় নিজের বাসার কাছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার ট্রাকের চাপায় প্রাণ হারায় ১৩ বছরের মাহিন। মাহিনের পরিবার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, মাহিনের মা জ্যোৎস্না আক্তার বৃহস্পতিবার রোজা রেখেছিলেন। সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ইফতার করে মাহিন। ইফতারের পর মাকে বলে বাসা থেকে বের হয় সে। কথা ছিল রাতে একই এলাকায় তার চাচার বাসায় থেকে পরদিন ফিরবে। সেখানে যাওয়ার পথে মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার ট্রাক উল্টো পথে এসে তাকে চাপা দেয়।
ছেলেকে হারিয়ে মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন। ভাইবোন দিশেহারা। পরিবারের সবচেয়ে আশার প্রদীপটি নিভে গেল। এ ক্ষতি, এ দুঃখ তারা ঘুচাবেন কী করে! স্থানীয় বাসিন্দারা ঘাতক গাড়িটি আটক করেছেন। দুর্ঘটনার সময় চালকের আসনে পাওয়া যায় চালকের সহকারী মো. রুবেলকে। মুগদা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুল হোসাইন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘রুবেলকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। সে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেনি।’
মাহিনের জানাজায় অংশ নিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন, ‘সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত চালক গাড়িটি চালাচ্ছিল না। অন্যকে ভাড়া খাটিয়ে গাড়িটি দেয়া হয়েছে। এটা বরদাশত করব না। ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে। আমরা সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে চাই’।
সুষ্ঠু বিচারে রুবেলের হয়তো প্রাপ্য শাস্তি হবে; কিন্তু মাহিন আর ফিরে আসবে না। যেমন ফিরে আসবে না সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার গাড়িতে ৩ বছরে হারানো আরও ১৩টি প্রাণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের চালকদের অনেকেরই ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্স নেই। পরিবহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, নগরবিদ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের মতে, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূলত সিটি করপোরেশনের বর্জ্য পরিবহনব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা। একাধিক দুর্ঘটনার তদন্তের ঘটনায় গাড়িচালকের গাফিলতি ছিল বলে এসেছে।
সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে প্রাণ হারান নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান। পরদিন ২৫ নভেম্বর দুপুরে পান্থপথ এলাকায় সংবাদকর্মী আহসান কবির খানের মৃত্যু হয়। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈমের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) দিনের বেলায় ময়লাবাহী গাড়ি চালানো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যে বর্জ্য সরানোর কাজ করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে ঘোষণা দিয়েই দায় সেরেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। এখনো দিনের বেলায় বর্জ্য পরিবহনের গাড়ি রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় চলছে।
ঢাকার রাস্তায় যারা চলাচল করেন তারা জানেন সব সময়ই বর্জ্যবাহী গাড়িগুলো খুব বেপরোয়া গতিতে চলে। অনেক সময় গাড়ির চালকরা উল্টোপথেই গাড়ি ছুটিয়ে দেয়। কাউকেই তারা তোয়াক্কা করে না। এর কারণ কী? সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোতে সব ধরনের অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। এসব ভারী যানবাহনের ফিটনেস সনদ নেই, দক্ষ চালক নেই। সিটি করপোরেশনের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও বাড়বে। মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস মাহিনের হত্যাকারী মো. রুবেলের সুষ্ঠু বিচারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আমরা আশা করব, এসব দানবরূপী গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে আর কোনো প্রাণ যেন অকালে ঝরে না পড়ে, তিনি সেই নিশ্চয়তাও আমাদের দেবেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে