কবির মৃত্যুতে কাঁদতে নেই
ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটি চড়ুই উঠে যাচ্ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে, চড়ুইটা উড়ে গিয়ে বসল একটি শিরিষের ডালে, ওখানে বসেছিল একটি বুলবুলি, চড়ুইটা বুলবুলিকে বলল, শোনো, কবি নেই।
মুহূর্তে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল উদ্যানজুড়ে। ফুল-পাখি-বৃক্ষলতা-প্রেম ও দ্রোহের সঙ্গে যে কবির সম্পর্ক ছিল, আজীবন সেই কবি নেই, সেই দুঃখে সব পাখি কাঁদতে লাগল এক সুরে। গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়তে লাগল বৃষ্টিধারার মতো। শাহবাগের ফুলগুলো মলিন হয়ে গেল এক মুহূর্তে। শহরের সব মানুষের চোখ ভেসে গেল অশ্রুধারায়।
এক তরুণ আকাশের দিকে বজ্রমুষ্ঠি ছুড়ে বলল, ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
এক কবি দেয়ালে লিখে দিল, ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/ আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা।’
মহল্লার মোড়ে গিয়ে এক ফেরিওয়ালা চিৎকার করে উঠল, ‘কষ্ট নেবে কষ্ট/ হরেক রকম কষ্ট আছে/ কষ্ট নেবে কষ্ট!’
পথের মোড়ে বসে পড়ে এক বেকার যুবক গুমড়ে উঠল, ‘ইচ্ছে ছিল রাজা হবো/ তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াব,/ আজ দেখি রাজ্য আছে/ রাজা আছে/ ইচ্ছে আছে, শুধু তুমি অন্য ঘরে।’
দীর্ঘকাল বাড়ি ফিরতে না পরা এক গৃহত্যাগী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আকাশের দিকে তাকিয়ে, ‘কত দিন তোমাকে দেখি না/ তুমি ভালো আছ? সুখে আছ? বোন নেত্রকোনা।’
এভাবে, দীর্ঘশ্বাসে, চাপা কান্নায় ভরে উঠল ঢাকার আকাশ। ঘন কুয়াশা সেই বিষণ্নতার খবর পৌঁছে দিল সারা বাংলায়। বাংলার প্রতিটি প্রান্তে। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে, সব প্রকৃতিতে বেজে উঠল কান্নার রোল, কবি নেই, কবি নেই। কে তাহলে তাদের মনের কথা লয়ে বীণার তারে তুলবে প্রতিধ্বনি! কে তাদের স্বপ্নের কথা, সংগ্রামের কথা, ক্ষোভের কথা, দুঃখের কথা, একাকিত্বের কথা লিখবে!
২.
কবি হেলাল হাফিজ নেই, এ খবর আর কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। সব সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে কাল সারা দিন, সারা রাত। মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেই, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তিনি স্পর্শ করেছিলেন খ্যাতির চূড়ান্ত সীমা। আসলে একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, একটি কবিতা লিখেই তিনি তারকাখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সেই কবিতাটির নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। যে কবিতার প্রথম পঙক্তি, ওই অবিস্মরণীয় স্লোগান- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
১৯৬৯ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কবি লিখেছিলেন এই কবিতাটি। সে সময় কবিতাটি কোনো পত্রিকা প্রকাশ করতে সাহস পায়নি। কবি আহমদ ছফা ও হুমায়ুন কবির কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে। তারপর থেকেই বিদ্রোহী তরুণদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে হেলাল হাফিজের নাম।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। একটি কাব্যগ্রন্থই তাকে নিয়ে যায় খ্যাতির শীর্ষে। তারপর দীর্ঘকাল তিনি আর কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেননি। থাকতেন অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে; কিন্তু কাব্যপ্রেমীদের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে তার অসংখ্য কবিতা। সে সময় কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেট চলত খুব। অসংখ্য আবৃত্তিশিল্পী তার কবিতা আবৃত্তি করেছেন। তার কোনো কবিতার বই না পড়লেও অনেকেই তার অসংখ্য কবিতার পঙক্তি এমনিতেই মুখস্ত জানতেন।
আড়াই দশক পর, ২০১২ সালে, প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় বই ‘কবিতা একাত্তর’। তৃতীয় ও সর্বশেষ বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে; কিন্তু এই শেষ দুটি কাব্যগ্রন্থ আর সেভাবে আলোচিত হয়নি।
কাল দুপুরে কবি হেলাল হাফিজ চিরবিদায় নিলেন। শাহবাগের একটি হোস্টেলে তিনি থাকতেন ছাত্র ও কর্মজীবীদের সঙ্গে। জানা যায় বাথরুমে গিয়ে বেসিনের ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। তাতে তার মাথা কাটা যায়। হোস্টেলের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
যে কবি সারাজীবন একা থেকেছেন তিনি একাই মারা গেলেন। হেলাল হাফিজের মৃত্যুতে সহচর কবি কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘ওর একটা বড় অভিমান ছিল, সেই অভিমানের কারণেই একাকী থাকত’।
আমরা জানি না কবি হেলাল হাফিজের কী সেই অভিমান, কেন তিনি সারা জীবন রয়ে গেলেন অকৃতদার। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশ ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই, কেন একজন খ্যাতিমান কবিকেও বাংলাদেশে এমন নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়? বেঁচে থাকতেই কেন রাষ্ট্র একজন বয়োবৃদ্ধ কবির দায়িত্ব নেয় না? তারপরও কবির মৃত্যুতে কাঁদতে নেই। কারণ, কবির মৃত্যু নেই!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে