প্রকল্পের সংশোধনে শাস্তি হয় না, অনাপত্তিতে বাড়ল মেয়াদ ও ব্যয়
উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ যথাসময়ে শেষ না করতে পারার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জবাবদিহি এবং শাস্তিস্বরূপ জরিমানার বিধান থাকলেও পরিকল্পনা কমিশন কোনো শাস্তি ছাড়াই প্রকল্প সংশোধনের অনুমোদন দিচ্ছে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ শাস্তির আওতায় তো আসছেই না বরং বিনা আপত্তিতেই প্রকল্পগুলো কাঙ্ক্ষিত সংশোধন পেয়ে যাচ্ছে। এতে কোনো কারণে অর্থ বরাদ্দ না বাড়লেও সময় বাড়ছে ঠিকই। ফলে সঠিক সময়ে প্রকল্প সম্পাদনে আগ্রহী হচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এডিপির আওতাধীন প্রকল্পগুলোকে বছরের পর বছর ধরে স্থগিত রাখার কৌশল হিসেবে প্রায়ই ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই সময় বৃদ্ধির’ বিধানের অপব্যবহার করা হয়। এভাবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়া মানেই ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। কারণ যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতার জন্য ব্যয় করতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ।
সাধারণত একটি প্রকল্পে রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বাইরেও থাকে প্রায় ১১ ধরনের ভাতা। এই বিষয় প্রথম সামনে আসে ২০২৩ সালে যখন অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য শুধু অগ্রাধিকার এবং প্রথম শ্রেণির প্রকল্পে অর্থছাড়ের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই সমস্যা গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে আরও তীব্র হয়েছে। আগে নামমাত্র জবাবদিহি থাকলেও এখন তাও অনুসরণ করা হচ্ছে না। পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জবাবদিহির মাধ্যমে শাস্তিস্বরূপ জরিমানার আওতায় আনার বিধান রয়েছে। শাস্তির বিধান করেই যাচাই-বাছাই শেষে প্রয়োজন অনুসারে প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বা বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে সংশোধনের সুপারিশ করার কথা; কিন্তু তা মানা হচ্ছে না অথবা আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না।
বরং কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রকল্পগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি করে সংশোধনের সুপারিশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোনো আপত্তি ছাড়াই ওইসব প্রকল্প ফের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেকে অনুমোদনও হচ্ছে। এককথায় জরিমানার বদলে দেয়া হচ্ছে উপহার। পরিকল্পনা কমিশনের একটি সূত্র বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ১৪২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পেয়েছে, যার মধ্যে বাস্তবায়ন তদারকি ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ১৩৬টির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। এদিকে, কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ গত মাসে পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডির কাছে ৫০টিরও বেশি নতুন প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যার মধ্যে ছয়টির মামলা বিচারাধীন।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ১৪২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পেয়েছে। এর মধ্যে ১৩৬টির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। আর গত সাড়ে চার বছরে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭২০টি। আইএমইডির তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৪৫টির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় ৩৫৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, অনেক প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে পড়ে রয়েছে। এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় ঠিকই কিন্তু কাজ হচ্ছে না। পড়ে থাকা বা মৃতপ্রায় প্রকল্পগুলোতেই অনিয়ম ও দুর্নীতি বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, পড়ে থাকা এসব প্রকল্পের তালিকাগুলোও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ঠিকমতো দিচ্ছে না, যাতে দুর্নীতির চিত্র সামনে না আসে। এদিকে গত ২৩ মার্চ একনেক সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্পকে দেশের অর্থনীতিতে একটা বিষফোড়া বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, এটি সমুদ্রবন্দর তো দূরের কথা নৌবন্দরও হবে না। এ প্রকল্পও একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হওয়া চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা। এরপর ২০২৩ সালে ৫৩৪ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ৫১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্পটিতে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এ রকম আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্পও গত একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। এ প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে চারগুণ হয়েছে। ১০ বছরে কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ।
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে নদীর পানির ব্যবহার বাড়াতে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। নামমাত্র কাজ হলেও প্রকল্পটির ব্যয় বেড়েছে চারগুণ। প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকায়। পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পে কাজ হয়েছে মাত্র ৯ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ২৪ শতাংশ।
এদিকে মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সম্প্রতি ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প’ (দ্বিতীয় পর্যায়) পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে উদ্যোগী সংস্থা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি ২০২০ সালের আগস্ট মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদের সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ধরা হয় ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এ ছাড়া ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। চার বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে পুরো সরকারি খরচে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক প্রকল্পে খরচ না বাড়িয়ে শুধু সময় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেই সময় অনুযায়ী তারা কাজ শেষ করতে পারে না। আর কাজ শেষ হলেও দেখা যায় খরচও বাড়ে দ্বিগুণ। কেননা তারা যে কম্পোনেন্টে খরচ ধারে প্রস্তাব পাঠায় সময়ের ব্যবধানে তো সেটির দাম বেড়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় সবচাইতে খারাপ দিক হলো, যথা সময়ে প্রকল্প সম্পাদন না করতে পারায় যে জরিমানা হওয়ার বিধান আছে তার ধারে কাছে দিয়েও যাওয়া হয় না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কার্য সম্পাদন না করতে পারার জন্য তারা শাস্তির আওতায় না এসে বরং উপহার পাচ্ছে।
অন্যদিকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ালে বা বাস্তবায়নে ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা প্রকল্প পরিচালককে (পিডি) কঠোর শাস্তির আওতায় আনা দরকার বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, প্রকল্পগুলোতে মেয়াদ বা ব্যয় বাড়ানো একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। পিডি বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জরিমানা বা জবাবদিহির আওতায় আনার কথা থাকলেও সেটি মানা হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেয়া চলবে না। যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যত্যয় ঘটে তা হলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে