খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে যত বাধা
বাংলাদেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন লাগাতার বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। তারপরও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমরা আমদানি করছি প্রতি বছর। এর মধ্যে আছে চাল, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য পণ্য। শুধু দানাদার খাদ্যশস্যের আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন। এর সঙ্গে অন্যান্য কৃষিপণ্য যেমন ডাল, তেলবীজ, চিনি, মসলা ও দুগ্ধজাত পণ্য যোগ করা হলে মোট আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০ থেকে ১০০ লাখ টন। টাকার অঙ্কে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকা। তারপরও দেশে খাদ্য নিরাপত্তার ঘাটতি আছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি।
বর্তমানে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এটি দূর করতে হলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চায়তা বিধান করতে হলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন আরও দ্রুত বাড়াতে হবে। তার মাত্রা হতে হবে ন্যূনতম পক্ষে বছরে গড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হবে। কৃষিপণ্যের বাজারজাত উদ্বৃত্ত আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অনেক। উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে আছে কৃষি জমি হ্রাস, আবাদযোগ্য জমি চাষের বাইরে ফেলে রাখা, জমির উর্বরতা হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, খাদ্য অপচয় এবং অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে চাষাধীন জমির পরিমাণ কম। মোট ১ কোটি ৮৬ লাখ একর বা ৭৫ লাখ ৪২ হাজার হেক্টর। জনপ্রতি প্রাপ্যতা মাত্র ১১ শতক। দ্রুত এর পরিমাণ কমছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯২০ লাখ হেক্টর। ১৯৯৬ সালে তা ৮২ লাখ, ২০০৮ সালে ৭৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে তা ৭৫ লাখ হেক্টরে হ্রাস পায়। শতকরা হিসাবে আবাদি জমি হ্রাসের গড় হার ছিল ১৯৮৪ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত বার্ষিক শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ, ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শূন্য দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং ২০০৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ। ১৯৮০ সালে কৃষি জমির পরিমাণ ছিল মোট জমির ৬৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশে হ্রাস পায়।
এভাবে কৃষি জমি হ্রাসের প্রধান কারণ হলো শিল্পায়ন, নগরায়ন, নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন বসতবাড়ি স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ইটভাটা স্থাপন, নদীভাঙন ইত্যাদি। সম্প্রতি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে জমি হ্রাসের প্রবণতা কিছুটা কমে আসছে; কিন্তু তা এখনো উদ্বেগজনক ও বিপদাশঙ্কাপূর্ণ। আগামীতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিজমি অন্য খাতে ব্যবহারের সুযোগ সীমিত করতে হবে। বিশেষ করে তিন ও দোফসলি জমি কোনোক্রমেই অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি জমি অন্য খাতে ব্যবহার করতে হলেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করা দরকার।
কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর একটি বাধা হলো আবাদযোগ্য পতিত জমির আধিক্য। বর্তমানে এর পরিমাণ ৪ লাখ ৫২ হাজার ৪৩০ হেক্টর। মোট আবাদযোগ্য জমির ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ হচ্ছে পতিত জমি। দেশের বিভিন্ন চিনিকল, পাটকল, বস্ত্রকল ও রেল বিভাগে চাষযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মচর্চা কেন্দ্র, সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসনস্থল এবং ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানার চারপাশেও অনেক আবাদযোগ্য জমি পতিত অবস্থায় পড়ে আছে। সরকারি বা বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যে পরিমাণ জমি দখলে নেয়া হয়, তার বেশি ভাগই স্থাপনা নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয় না। বাকি জমি ফেলে রাখা হয় খালি। ঢাকা মহানগরের চারপাশে আবাসন কোম্পানিগুলোর অসংখ্য সাইনবোর্ড দেখা যায়। তার চারপাশে পতিত ফেলে রাখা হয়েছে শত শত একর আবাদি জমি। ঢাকার বাইরেও চোখে পড়ে এমন অনেক দৃশ্য।
অপেক্ষাকৃত উঁচু, নিচু ও সমস্যাসংকুল অঞ্চলে আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ বেশি। এমতাবস্থায় সব পতিত জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এক্ষেত্রে শস্য বহুধাকরণ, স্বল্প সময়ের শস্য আবাদ, শস্যক্রমের বিন্যাস পরিবর্তন। হাওর অঞ্চলের জন্য নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ফল, কাজুবাদাম ও কফি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। বছরের বিভিন্ন সময়ে মাঠের জমি যাতে অনাবাদি না থাকে, সে বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। প্রয়োজনে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জমি পতিত রাখার জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয় (সেট এ সাইড পলিসি)। তাতে পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায় এবং বিশ্ববাজারে কৃষি পণ্যের মূল্য পতন ঠেকানো যায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো খাদ্য নিরাপত্তা সংকটে থাকা একটি দেশে পতিত জমি আবাদের জন্য কৃষকদের সহায়তা দেয়া হবে খুবই যুক্তিসঙ্গত।
বাংলাদেশের ফসল উৎপাদন জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। এর প্রভাবে বন্যা ও খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়। উপকূল এলাকায় জলমগ্নতা ও লবণাক্ততার সম্প্রসারণ ঘটে। নদীভাঙনে বিলীন হয়ে যায় অনেক কৃষিজমি। সম্প্রতি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তাতে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বিঘ্নিত হয়েছে পানি সেচ। উপযুক্ত অভিযোজন কর্মসূচি বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে লাগসই কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যত্নবান হওয়া দরকার। এরই মধ্যে বন্যা, খরা, জলমগ্নতা ও লবণাক্ত-সহিষ্ণু বেশ কিছু ফসলের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
এগুলোর ক্রমাগত উন্নয়ন সাধন ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো আবশ্যক। তাছাড়া জমির ফসলক্রম পরিবর্তন এবং শস্যবহির্ভূত কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কৃষি বীমা চালু করতে হবে। আমাদের দেশে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যের অপচয়। এটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে বড় বাধা। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউনেপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে একজন ব্যক্তি বছরে ৮২ কেজি খাবার অপচয় করছেন। খাদ্য অপচয়ের এ পরিমাণ ভারত, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। সর্বসাকুল্যে বার্ষিক অপচয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৪ লাখ টন, যা দিয়ে বাংলাদেশের সব মানুষকে ৩ মাস খাওয়ানো সম্ভব।
এ অপচয় রোধ করা সম্ভব হলে খাদ্যশস্য আমদানির কোনো প্রয়োজন হতো না। বাংলাদেশে উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে যখন গরিব ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে তখন অতিমাত্রায় খাদ্য অপচয় মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অতএব, এখনই তা রোধ করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি, ফসল কর্তন ও সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়ন, ইঁদুরের উপদ্রব হ্রাস, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও পরিবেশনে ভালো প্রশিক্ষণ প্রদান। এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মনিটর করা প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসগুলোর একটি হলো কৃষি উৎপাদনে টেকসই অবস্থা বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য অপচয় অর্ধেক কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্যে সরকার ও জনগণকে একযোগে কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিত।
কৃষি উপকরণ জোগানে আমদানিনির্ভরতা আমাদের আর একটি বড় সমস্যা। এক সময় দেশের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৭০ শতাংশ রাসায়নিক সারের চাহিদা দেশের উৎপাদন থেকেই মেটানো হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২০ শতাংশেরও নিচে। দেশের ৫টি সার কারখানার মধ্যে মাত্র একটি এখন চালু আছে। বাকি ৪টি গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ সার মজুদ আছে, তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। এরপর শুরু হবে রবি শস্যের আবাদ ও বোরো ধানের চাষ। এরই মধ্যে আমন ধানের উপরি প্রয়োগ করতে যত পরিমাণ সারের প্রয়োজন শেষকালে তারও কিছুটা ঘাটতি হতে পারে। রবি ও বোরো ফসলের জন্য লাগবে প্রায় ৪০ লাখ টন সার। এদিকে ডলার সংকটের কারণে সার আমদানির জন্য এলসি খোলা প্রায় বন্ধ রয়েছে।
বকেয়া পরিশোধে অপারগতার কারণে বেসরকারি আমদানিকারকরা সার আনতে পারছে না বিদেশ থেকে। এমতাবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় সার আমদানির ওপর গুরুত্ব দেয়া দরকার। তারও বেশি দরকার দেশের বন্ধ সার কারখানাগুলো চালু করা। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত প্রতি টন ইউরিয়া সারের খরচ দাঁড়ায় ৩২ থেকে ৩৩ হাজার টাকা। এর আমদানি খরচ দাঁড়ায় প্রতি টন ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। সুতরাং রাসায়নিক সার দেশে উৎপাদন করা অনেক বেশি লাভজনক। পানি সেচ ও মাটি কর্ষণের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এসব যন্ত্রের উৎপাদন বাংলাদেশেই হতে পারে। প্রয়োজনে বিদেশের সঙ্গে সমঝোতা করে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের কারখানা স্থাপনে তাদের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। আমাদের কৃষি পণ্যের বাজার অদক্ষ। এখানে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহযোগিতাই বেশি, প্রতিযোগিতা কম। সে কারণে বাজারে পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও মূল্য থাকে চড়া। ব্যবসায়ীদের অশুভ আঁতাত এর জন্য দায়ী। তাতে কম আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টভোগ করেন। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ঠকেন কৃষকরা। বাজার শৃঙ্খলের এই দুই প্রান্তে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য বাজার দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া উচিত।
ড. জাহাঙ্গীর আলম: পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং সাবেক উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে