Views Bangladesh Logo

পিট সিগার: যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদী চরিত্র

পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধ চলমান। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-গাজা। গাজা এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। তারও আগে ইরাক-ইরান যুদ্ধ। আমেরিকা-আফগান যুদ্ধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুদ্ধের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এর মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে চিরশত্রু পাক-ভারতের মধ্যে। চারদিকে কেবল লাশ আর লাশ, রক্ত আর রক্তের গন্ধ। যেমন প্রাচ্যে তেমনি প্রাচ্যাত্যে। যেমন উত্তরে তেমনি দক্ষিণে। বিশ শতকে পৃথিবীব্যাপী এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিলেন আমেরিকান কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী পিট সিগার। লোকসংগীতের প্রচণ্ড অনুরাগী এক গায়ক ছিলেন পিট।

সরল জীবনযাত্রায় বিশ্বাসী অহংকারহীন এই মানুষটির প্রতি রাষ্ট্রের আক্রমণ নেমে এসেছে বহুবার। ১৭ বছর তিনি নির্বাসিত ছিলেন বেতার এবং টেলিভিশন থেকে; কিন্তু কেউ তার গান থামাতে পারেননি। আমেরিকার সাধারণ মানুষ তথা বিশ্ববাসী তাকে আগলে রেখেছিলেন মণিমুক্তার মতো। চৌরাস্তার মোড়ে, স্টেডিয়ামে, ব্যারিকেডের সামনে, হাজার মানুষের সঙ্গে মিছিলে চলতে চলতে গান গেয়েছেন সবাইকে নিয়ে। আনন্দের জন্য নয়, প্রতিবাদ- নিজের অধিকারের জন্য; আর মাটির টানে লোকসুর কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন পিট সিগার। গান ছিল তার হাতিয়ার। অন্যকে নিজের সঙ্গে শামিল করে তিনি গাইতেন গান।

পিট সিগার


জন্ম ও সংগীতের সঙ্গে বেড়ে ওঠা
পিট সিগার ১৯১৯ সালের ৩ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন শহরের এক সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই পিট সুরের আবহেই বেড়ে ওঠেন। বাবা চার্লস সিগার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত শেখাতেন, আর মা কনস্ট্যান্ট সিগার একজন দক্ষ বেহালাবাদক ছিলেন। তিনি জুয়েলিয়ার্ড স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বেহালা বাজানো শেখাতেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে পিট ছিলেন সবার ছোট। তার বড় ভাই মাইক ছিলেন নিউ লস্ট সিটি র্যাম্বলারস গানের দলের সদস্য, আর বোন পেগি ছিলেন একজন লোকসংগীত শিল্পী।

শৈশব থেকেই পিট সিগার বেশ প্রতিভাধর ছিলেন, পড়াশোনায় ছিলেন বেশ মনোযোগী। তবে, শৈশবে পিটের গানের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। কোনো স্বরলিপি অনুসরণ করে গানের তালিম নেননি। সংগীত পরিবারের একজন উত্তরসূরি হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিমণ্ডলে নানা বাদ্যযন্ত্রের হাতেখড়ি হয় তার। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে শৈশবে প্রতিদিন নিয়ম করে বাবা-মা আর ভাই-বোনের সঙ্গে তার সংগীতের পাঠ নিতে হতো। পরিবারে বাবা, ভাই আর বোনের লোকসংগীতের প্রতি আগ্রহ দেখে ছোটবেলা থেকে পিটেরও লোকসংগীতের ওপর আগ্রহ জন্মায়। এভাবে শৈশব থেকে কৈশোর পার করলেন; কিন্তু সংগীতের প্রতি তার আবেগ জন্মালো আরও বেশ কিছু সময় পর।

একটু বড় হতেই পিট কখনো বাবা, আবার কখনো ভাই মাইকের সঙ্গে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তারা পল্লির নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লোকসংগীতের কথা ও গানের সুর সংগ্রহ করতেন, আবার কখনো তারা নিজেরাই স্থানীয় কোনো গানের প্রোগ্রামে অংশ নিতেন। যখন পিটের বয়স ১৬ বছর, তখন এক গ্রীষ্মের দিনে বাবার সঙ্গে তিনি ঘুরতে যান নর্থ ক্যারোলিনার অ্যাশভিলের একটি লোকজ মেলায়। সেই মেলায় বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্রের প্রদর্শনী চলছিল। হঠাৎই পিটের চোখ এক অন্য ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ওপর আটকে যায়। সেই প্রথম পিট সিগার ব্যাঞ্জোর প্রেমে পড়লেন। এই যন্ত্রটি মার্কিন লোকসংগীতের সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে যুক্ত ছিল।

এই পাঁচ তারের ব্যাঞ্জোই পরবর্তীকালে হয়ে উঠল তার গানের সুরে ভেসে বেড়ানোর প্রধান হাতিয়ার। আর এই ব্যাঞ্জোকে সঙ্গী করে সংগীতের প্রতি পিটের নতুন করে আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে।১৯৪০ সালে পিট সিগার প্রথম গান লেখা নিয়ে মনোযোগী হন। এই সময়ে মিলার্ড ল্যাম্পেল এবং লি হেইসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘অ্যালম্যান্যাক সিঙ্গারস’ নামে প্রথম লোকসংগীতে একটি দল তৈরি করেন। তাদের প্রথম দিকের তৈরি গান ‘The Talking Union Blues’ শ্রমিকদের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এরপর ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে তাদের শান্তিবাদী গান ‘The Balled of October 16’ আমেরিকার সমাজে গানের এক নতুন ভাষা তৈরি করে।

১৯৪২ সালে এই গানের দলটি লোকসংগীতের কিছু গান রেকর্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল; কিন্তু এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সবকিছু থমকে যায়। সামরিক এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে মার্কিন সব তরুণের মতো ব্যান্ডের সব সদস্যকেই আমেরিকার সৈন্য দলে যোগ দিতে হয়। সামরিক প্রশিক্ষণও নিতে হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পিট ‘সিঙ্গ আউট’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি একক সংগীতের অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন। পিট সিগারের জনপ্রিয় গানগুলো নিয়ে প্রকাশিত গানের অ্যালবাম ‘Where Have All the Flowers Gone?’; ষাটের দশক পিট সিগারের উত্থানের সময়।

এই সময় তিনি এককভাবে মঞ্চে গান করতে শুরু করেন। তখন তার গাওয়া ‘Where Have All the Flowers Gone?’ এবং ‘Turn, Turn, Turn’ প্রভৃতি গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত তার বেশ কয়েকটি গানের অ্যালবাম বেশ প্রশংসিত হয়। প্রথাবিরোধী গান করেই শুধু পিট সিগার কিংবদন্তি হননি। লোকসংগীতের প্রতি তার ভালোবাসাই তাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শুধু নিজে গান লিখে আর তাতে সুর দিয়ে শ্রোতাদের মাঝে গান গেয়েই ক্ষান্ত ছিলেন না, আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলের পুরোনো হারিয়ে যাওয়া লোকগান পুনরুদ্ধারে তার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।

১৯৪০ থেকে ১৯৫০-এর আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন, সামাজিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে পিটের গানের কথা ও সুরে। ১৯৬০ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী র্যালি, ১৯৭০ সালে যুদ্ধবিরোধী ও পরিবেশ সংক্রান্ত ক্যাম্পেইনেও তার গান রেখেছে অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৬১ সালে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। তাকে আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিস কমিটিতে ডাকা হয়; কিন্তু পিট সিগারের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় দর্শন এবং চিন্তা-ধারণাকে কিছুতেই বাগে আনতে সক্ষম হয়নি প্রশাসন। বরং পিট দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে তার বিশ্বাস ও রাজনৈতিক চেতনার ওপর কারও হস্তক্ষেপ মোটেই কাম্য নয়।

যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন পিট সিগার
ষাটের দশকের আমেরিকাজুড়ে চলা ‘সিভিল রাইটস আন্দোলন’-এর অন্যতম পুরোধা ছিলেন পিট সিগার। মার্কিন সরকারের জনবিদ্বেষী, হঠকারী নীতি এবং রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এমনকি ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকা সরকারপ্রধান ভূমিকা নেয়ায় মার্কিন জনগণ খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। মুক্তিপাগল মানুষের প্রতিনিধি পিট সিগার বরাবরই যুদ্ধবিরোধী ছিলেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধে বিপর্যস্ত আমেরিকার জনগণকে প্রতিবাদের ভাষা চিনতে শেখান পিট। যুদ্ধের বিপক্ষে মানুষকে সচেতন করতে তাই মঞ্চকেই বেছে নিলেন তিনি। ম্যানহাটনের স্কুলের বারান্দায়, নিউ ইয়র্কের পথ চলতি ব্যস্ত রাস্তার ধারে, সর্বত্রই তার ব্যতিক্রমী সুর ঝড় তুলতে শুরু করে। শুরু হলো তার বারুদের বিরুদ্ধে ব্যাঞ্জোর মূর্ছনা, অশান্তির বিরুদ্ধে ভালোবাসার স্লোগান। ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী তার এক অসাধারণ গানের কথাগুলো এমন-


If you love your Uncle Sam
Bring them home, bring them home
Support our boys in Vietnam
Bring them home, bring them home

যে কোনো যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার ছিলেন পিট সিগার। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ইরাকের যুদ্ধ, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলন, ওয়াল স্ট্রিট দখল অভিযান থেকে হাডসন নদী বাঁচাও আন্দোলন- সব জায়গায় শান্তিকামী, অহিংস জনতা তার গানে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে, পেয়েছে প্রতিবাদের নতুন স্লোগান। ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি ৯৪ বছর বয়সে থামলো ব্যাঞ্জোর জাদু। জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। ১৯৫৪ সালে পান ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব আর্টস’ এবং ‘কেনেডি সেন্টার অ্যাওয়ার্ড।’ ১৯৯৬ সালে সংগীতে তার অসাধারণ ভূমিকার জন্য রক অ্যান্ড রোল এর ‘হল অব ফেম’-এ তাকে নির্বাচিত করা হয়।

সে বছরেই তিনি হার্ভার্ড আর্টস মেডেল অর্জন করেন; কিন্তু সবচেয়ে বড় পুরস্কার অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা সারাজীবন ভর পেয়েছেন। বিশ্বের লাখ লাখ নিপীড়িত মানুষের পক্ষে আজীবন লড়াই করে গেছেন এই নির্ভীক শিল্পী। আজীবন সাধারণ মানুষের জন্য গান গেয়েছেন যে শিল্পী, মার্কিন লোকসংগীত যার ছোঁয়ায় নবজীবন পেল সেই পিট সিগার এই বিশ্বকে দেখিয়ে দিলেন সংগীতের এক অসাধারণ ক্ষমতা। গান শুধু মানুষকে আত্মিক শান্তিই দেয় না, শ্রোতাকে ভাবতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গানও যে এক মাধ্যম হতে পারে, তাই তুলে ধরেছিলেন এই সংগীতশিল্পী। শুভ জন্মদিন যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক।

লেখক: সাংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ