২০২৫ সালের রাজনীতি : জাতীয় নির্বাচন হবে মূল চ্যালেঞ্জ
চলমান অস্থিরতার মাঝেই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের সম্ভাবনা এবং নির্বাচন ও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষায় ২০২৫ সালে যাত্রা শুরু করেছে দেশ। জামায়াত ছাড়া ডান-বাম বা উদারপন্থি সব রাজনৈতিক দলই সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপসহ দ্রুত নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপও বাড়াচ্ছে। অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এবং এর মিত্র দল ও জোটগুলোর বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে দ্রুত নির্বাচন চাইছে। আবার সংস্কার প্রশ্নে চাপ বাড়াচ্ছে সুশীল সমাজও।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি ‘প্রক্লেমেশন অব জুলাই রেভলিউশন’ নিয়ে চাপ তৈরি করছে, দিচ্ছে নানা কর্মসূচি। এসব নিয়ে নতুন বছরের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার শঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা বলছেন, জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন প্রশ্নে ছাত্রসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐক্য বজায় ছিল ৫ আগস্টের কিছুদিন পর পর্যন্ত; কিন্তু সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে সেই ঐক্যের অনেক জায়গায়ই ফাটল ধরেছে। এত সব তর্ক-বিতর্ক, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে উদ্ভূত এই ঘোলাটে পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ কীভাবে কিসের ভিত্তিতে হবে বা দেশ কোনদিকে যাবে- এ নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করতে গেলে অনেক সময় লাগবে। তাই যে সংস্কারগুলো (বেসিক সংস্কার) না করলেই নয়, সেগুলো অন্তত সম্পন্ন করে যেন নির্বাচন দেয়া হয়। আর এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐকমত্যের।
কি বলছে রাজনৈতিক দলগুলো
গত কয়েকদিন ধরে বিএনপির নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক ঐক্য কিন্তু এখনো একেবারে বিনষ্ট হয়নি। সব রাজনৈতিক দল একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তা হলো, কোনো স্বৈরাচারী সরকারকে আর এই দেশে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেয়া।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ২০২৫ সালে রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রাখাই হবে সবার প্রথম পরীক্ষা। ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ, সংস্কার ও সংবিধানের সংশোধন অথবা পরিমার্জন এবং সর্বোপরি দ্রুত নির্বাচনেই এ ঐক্য নিহিত ।
রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম। গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধেও ছিলাম। গণতান্ত্রিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে; কিন্তু এখন ঐক্য রক্ষার যে যুদ্ধ, তাতে আমাদের ব্যর্থতা আছে’।
যুবদলের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করলেও এতে সায় দেয়নি দলটি। ভুল পদক্ষেপ দেশে অরাজকতা তৈরি করতে পারে বলেই মনে করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে সংবিধান ইস্যুতেও মতৈক্য হয়নি। এ ক্ষত্রেও স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছে বিএনপি।
তিনি বলেন, ‘উদারপন্থি ও সহনশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য ধরে রাখাসহ নানামুখী কাজ করছে। করা হয়েছে বিভিন্ন কমিটিও। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের কমিটিগুলোর প্রধান করা হয়েছে। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আলাদা কমিটি রয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের। নিয়মিত বৈঠকও করছেন দায়িত্ব পাওয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু।
দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনই ২০২৫ সালের প্রধান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।
তার মতে, এজন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং সক্রিয় করে তোলা, মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ হিসেবে সক্রিয় করা, নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম আরও জোরালো করা, নিখুঁত ভোটার তালিকা প্রণয়ন।
মান্না বলেন, ‘সবকিছু হতে হবে ঐকমত্যের মাধ্যমে। দেশের এখন যে অবস্থা, আমাদেরকে খোল-নলচে বদলাতে হবে, দেশ বদলাতে হবে, সরকার পদ্ধতি বদলাতে হবে। তবে তা করতে হবে আইনের মধ্যে থেকে। সর্বগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যেন সবাই ভোট দিতে পারেন, সবাই গ্রহণ করেন এবং সেই ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে আমরা যেন গণতন্ত্র বিনির্মাণ করতে পারি।’
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি। স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার এবং বাধাহীন রাজনীতির লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একাত্ম হয়েছিল জাতীয় পার্টিও। আজ তাতেই বাধাগ্রস্ত হছে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি। তবে দল গোছানোর পাশাপাশি জনমত যাচাই করে তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সামনের কৌশল নির্ধারণে আবারও মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়াবে জাতীয় পার্টি’।
তবে ২০২৫ সালে রাজনীতির মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে নির্বাচন, সংস্কার (দলের ভেতরে এবং রাষ্ট্রীয়), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্ষম করে তোলা (যেন নির্বাচন সুষ্ঠূ হয়) এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ পরিচালনাকে দেখছেন তিনি।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বাংলাদেশের সামনের পথচলার বিষয়টিকে অনুধাবন করছেন আরেকটু ভিন্ন আঙ্গিকে।
বৈষম্যবিরোধী পরিবেশ আনতে এবং সবার নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে বাম, প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ জোট বা যুক্তফ্রন্ট গঠনের কথা বলেছেন তিনি।
স্বাধীনতার পর থেকে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো- বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জোটবদ্ধ হিসেবে জামায়াতকে বাদ দিয়ে নতুন এই যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা হবে বলেও জানান সেলিম।
তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার অবনমন, যা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐক্যই হবে নতুন বছরের প্রধান ও জাতীয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ’।
এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য আছে, ব্যাপারটা তেমন নয়। নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা হচ্ছিলো। তবে এখন সবাই দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন’।
‘গত সাড়ে ষোল বছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সিস্টেম গড়ে রেখেছেন, তার পরিবর্তন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই ২০২৫ সালের আসল চ্যালেঞ্জ’- বলেন তিনি।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমও সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রধান চ্যালেঞ্জ উল্লখ করে বলেন, ‘কোনো কিংস পার্টি গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচনে কালক্ষেপণ করা হলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। রাজনীতি করার অধিকার সবারই আছে; কিন্তু কিংস পার্টির জন্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনোভাবেই কাম্য নয়’।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘২০২৫ সাল হবে জুডিশিয়ারি মর্যাদা পুনঃপতিষ্ঠার বছর। সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিমার্জন, শেখ হাসিনার আমলে প্রশাসনে পদায়নকৃত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেশপ্রেমিক, স্বচ্ছ কর্মকর্তাদের পদায়ন, ইসির প্রয়োজনীয় সংশোধন করেই সুষ্ঠু নির্বাচনে যেতে হবে’।
‘তবে সবার আগে দরকার, রাজনৈতিক ঐকমত্য। স্বাধীনতার পরে নানা সময়েই রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দোষারোপ করে নানা বয়ান দিয়েছে। তবে দেশের প্রয়োজনে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সমস্যা হয়নি। এরশাদের আমলে ১৯৯০ এবং ২০০১ সালেও তা ঘটেছে। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ছোটখাটো বিষয়গুলো ভুলে ঐকমত্যে পৌছাতে এবারও সমস্যা হবে না’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক এই ঐকমত্যের বিকল্পও নেই। তা না হলে জনগণকেও ভুগতে হবে’।
বিশ্লেষকরাও বলছেন, ‘ঐক্যই সমাধান’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘসময় ধরে যেভাবে দেশ পরিচালনা করেছে, তাতে সামগ্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্য দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারটি এসেছে। রাজনৈতিক যে জটিলতা, সেটি কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য। সত্যিটা হলো, রাজনীতি এখন আর রাজনৈতিক দলগুলো ও স্থানীয় নেতাদের হাতে সীমাবদ্ধ নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের সমর্থন পেতে হলে রাজনীতির এই চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে, জনগণের মানসিক যে পরিবর্তন হয়েছে- সেটিও বুঝতে হবে। জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের চরিত্রের বিপরীতে গিয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. আমেনা মহসিন বলেন, ‘ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এই বছর অনেক ঘটনাবহুল হতে যাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বিশেষ করে সংস্কার ইস্যুতে। এবং তা উতরে যেতে হলে সবার ধৈর্য, সহনশীলতা ও সংযমটা খুব জরুরি’।
দেশের রাজনীতিতে যে অস্থিরতা চলছে তা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া অন্য কোনো পথ দেখছেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীও।
তিনি বলেন, ‘ঐক্য আসতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে, সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে, ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথ নিয়ে। সংস্কার বাস্তবায়নে এই ঐক্য খুবই প্রয়োজন। ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ নিয়েও আমরা মতানৈক্য দেখেছি। এটা হওয়া উচিত হয়নি। অষ্টাদশ শতকে ফরাসি বিপ্লবের পরেও ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, যা দেশটিতে উন্নয়নের পাথেয় হয়ে আছে। এই ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ সংবিধানের সঙ্গে জুড়েও দেয় তারা। সেটাও তো সম্ভব হয়েছে ঐকমত্যের কারণেই। সেজন্য তো সংবিধান ফেলে দিতে হয়নি’।
অধ্যাপক ড. দিলারা বলেন, ‘পথ অনেক আছে। ইচ্ছে থাকলেই তা বাস্তবায়নও সম্ভব। দেখতে হবে, ইচ্ছা আছে কি-না। থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোকে ইস্যুভিত্তিক একতায় দাঁড়াতে পারবে। শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু প্রগতিশীল, আত্মনির্ভরশীল, বৈষম্যবিরোধী দেশ গঠনে, বহির্দেশের চাপমুক্তভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে এই মুহুর্তে আসলে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠাই একমাত্র উত্তরণের পথ। অন্যথায় আমাদের আবারও আগের অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতে হবে’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে