পদ্মা সেতু করার আগে প্রয়োজন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় করা
আমাদের সবচেয়ে বেশি সংস্কার দরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে। এই শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছিল ১৮৫৪ সালে, ইংরেজদের হাতে। সেখানে মূল ব্যবস্থা ছিল কেউ যদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তাহলে সরকার ১০ শতাংশ মঞ্জুরি দেবেন। এখনো সেই নাম আমরা বহন করে চলেছি, ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন’ নামে। ব্রিটিশ সরকার এই মঞ্জুরি দিত নিম্ন বিদ্যালয়কে, আপনি বিদ্যালয় তৈরি করবেন, জমি দেবেন, বিল্ডিং তৈরি করবেন, ব্রিটিশ সরকার শতকরা ১০ ভাগ খরচ দিবে শিক্ষকদের বেতনের জন্য। সেই ঐতিহ্য এখনো চলছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৯৭টি মাধ্যমিক স্কুল এখনো বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে। শিক্ষকদের বেতন অনিয়মিত। কোনো স্কেল নাই। চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নাই। এমতাবস্থায় আপনি কী করে ভালো মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক আশা করবেন? শিক্ষার গোটা ভিত্তিটাই হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। অন্তত নীতিগত পর্যায়ে। এ এক অবহেলিত অঞ্চল। প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে কিছু কথাবার্তা আছে। জাতিসংঘ এবং এনজিওরা বলে বলেই আমরাও কিছু বলি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে এতে খুশি হয়ে আমার বন্ধু বিনায়ক সেন হাত তালি দিয়েছেন। দেখেন আমরা কত আনন্দ লাভ করেছি, বাংলাদেশে নারী শিশু এবং পুরুষ শিক্ষার্থীর ভর্তির অনুপাত প্রায় সমান সমান হয়েছে, পঞ্চাশ পঞ্চাশ। এটা বড় একটা অর্জন বটে।
কিন্তু পঞ্চম শ্রেণির পর শতকরা আশি ভাগ ঝরে যায়। তারা কম করে বলে শতকরা পঁচিশ ভাগ ঝরে যায়। কেন ঝরে যায়? একটা ধারণা আছে, মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে শিক্ষার্থীরাও অনেকে ঝরে যায়, লেখাপড়া বাদ দিয়ে তারা কাজেকর্মে চলে যায়। এটাকে বৈধতা দিয়েছে জাতিসংঘের একটা অনুষঙ্গ। ইউসিপি স্কুলগুলো। নন-ফর্মাল এডুকেশন। এটা নিয়ে কথা বললে কেউ শুনতে চায় না। বলে, গরিবের ছেলেমেয়েদের ৪ বছর পরলেই হবে। আর আমাদের ছেলেমেয়েদের পাঁচ বছর পড়তে হবে। আবার বড়লোকের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তির ৭ বছর বয়স থেকেই ক্যাডেট কলেজে যায়। ক্যাডেট কলেজ সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু হবে কেন? কারণ, প্রাথমিক শিক্ষার স্তর হচ্ছে ৬ বছর। এটাকে তারা স্বীকার করেছে।
এটা তারা ইউরোপ থেকে শিখেছে। ইউসিপিগুলো সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু হয়। আমাদের ক্যাডেট কলেজগুলো সেটা অনুসরণ করে ভালোই করেছে। ক্যাডেট কলেজগুলোর গঠন দেখেন, ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ ১৯৫৭ সালে শুরু হয়েছিল। ঘটনাচক্রে ওই বছর আমার মাত্র জন্ম। তো ওইখানে তো ৬ বছর পড়ানো হয়। কিন্তু এই বৈষম্য কেন? ওগুলো সামরিক অফিসার তৈরি করার জন্য বানিয়েছে। নিশ্চয়ই ওগুলো রবীন্দ্রনাথ তৈরি করার জন্য বানায় নাই। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষাপদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য সামরিক অফিসার বানানো; কিন্তু অর্ধেক তো সামরিক অফিসার হয় না; কিন্তু তারা ভালো শিক্ষা পায়। পরে অন্যান্য ভালো ভালো জায়গায় যায়।
আমি এটা ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করে দেয়ার জন্য বলছি না। বলছি, প্রতিটা হাইস্কুলই এরকমটা হওয়া উচিত। আসলে এটাা আমাদের সামর্থ নাই। আমরা যে-সব পয়সা অপচয় করেছি, বিদেশে যে সব অর্থ পাচার হয়েছে, সেগুলোর কথা বলছি না, সেগুলো দেবপ্রিয় ভুট্টাচার্য বলবেন, আমি দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই এখন, রেহমান সোবহান কোথায় এখন? দেবপ্রিয় কোথায়? তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ইকোনমিক করিডোর করতে, তাহলে আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হবে। এখন কী বলবেন আমি জানি না। তারা যে তদন্ত রিপোর্ট দিবেন তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।
যে টাকা নষ্ট হয়েছে তার বেশি লাগবে না, এর শতকরা ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ যদি আমরা খরচ করি তাহলে আমাদের প্রত্যেকটি হাইস্কুলকে ক্যাডেট কলেজ করা সম্ভব। ছেলেমেয়েরা যদি খেতে না পারে তারা পড়াশোনা করবে কী করে? ক্যাডেট কলেজে কী করা হয়? শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো হয়। খেলাধুলা করতে দেয়া হয়। পিটি করানো হয়। আমি অতো বেশি সামরিক নিয়ম-কানুন পছন্দ করি না, কিন্তু সেখানে দেখলাম ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পর্ক ভালো হয়। ক্লাসগুলো ছোট ছোট। কিন্তু হাইস্কুলের ক্লাসগুলো দেখেন, বড় বড় ক্লাস, ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রী, পেছনের শিক্ষার্থী শুনতেই পারেন না শিক্ষক সামনে দাঁড়িয়ে কী বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন শুরু হয়, ৭০০-৮০০ ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল। টিউটোরিয়াল ক্লাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে ১০ থেকে ১২ জন ছেলেমেয়ে থাকবে, অধ্যাপক সাহেবদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হবে, তাদের টিউটোরিয়া দেখবেন, ক্লাস মানে টিউটোরিয়াল ক্লাস। এটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।
লেখাপড়া চলতে হলে তো সারা পৃথিবীতে একটাই নিয়ম চলবে। ‘জগত জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি’, আপনি মানুষের ধর্ম ভাগ করতে পারবেন, কিন্তু মানুষের শিক্ষার যে বয়স ও চাহিদা এটার ব্যাপারে জাতি নির্বিশেষে একরকম। একজন শিক্ষার্থীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময় হচ্ছে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত। দেশভেদে তারপর আরো দুই বছর যোগ করতে পারেন, এইটুকুই। তো আগের দিনে বলা হতো ৬ বছর বয়সে যদি কেউ প্রথম ভর্তি হয় তাহলে ১২ বছর বয়সে ৬ষ্ঠ শ্রেণি শেষ করবে। ১৩ বছর থেকে আর ৬ বছরের মধ্যে, ১৮ বছরের মধ্যে বুনিয়াদি শিক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তারপরও জীবনে আপনি কী লক্ষ্য অর্জন করবেন সেটা আপনি নাও জানতে পারেন। যখন আপনি তথাকথিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজে ভর্তি হবেন, শিক্ষকদের সঙ্গে আপনি যে দুই বছর মিশবেন, নানা কথা বলবেন, নানা কিছু লিখবেন, নানা লাইব্রেরিতে যাবেন, তার থেকে কীভাবে কোনটা যে আপনার পছন্দ হবে তার প্রধান প্রবণতাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা করতে পারি না বলেই শিক্ষা আমাদের জন্য আনন্দদায়ক হয় না।
আমরা বলি মুখস্তবিদ্যাই আমাদের সব নষ্টের মূল; কিন্তু একজন ছাত্র যদি মুখস্ত করতে না পারে, ছোটবেলা থেকেই কঠোর প্ররিশ্রম করতে না শেখেন তাহলে পরবর্তীতে শেখার প্রতি আপনার আগ্রহ থাকবে না। শিক্ষা নিয়ে বহু তর্ক আছে, রুশো বলেছেন, ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের কোনো বই-ই দেবেন না। তারা প্রকৃতি থেকে শিখবে; কিন্তু এটা হচ্ছে অতি রোমান্টিকতা। শিক্ষা নিয়ে রুশো পুরো একটা বই লিখেছেন, ‘এমিল’ নামে, তার মূল কথা হচ্ছে ছাত্র হবে একজন শিক্ষক হবে একজন। সে অনুপাত কি আপনি পাবেন? সম্ভব নয়। অন্যদিকে আন্তোনিও গ্রামসি বলছেন, ‘এডুকেশন ইজ লেবার’। শিক্ষা হচ্ছে প্ররিশ্রম। অতএব, শিক্ষার মধ্যে আপনার বিনেয়োগ করতে হবে। শিশুকে নিয়ামানুবর্তিতা শেখাতে হবে। এই স্কুল, এই যে প্রথম থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত হচ্ছে অ্যাক্টিভ স্কুল। শিশু কী পড়বে, তাকে বাংলা কীভাবে শেখাতে হবে, অঙ্ক কীভাবে শেখাতে হবে, প্রকৃতির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক হবে, মানুষে মানুষে কী সম্পর্ক হবে তা-ই তাকে শেখাতে হবে। যাকে আমরা বলি, নীতিবোধ। ভালো আর মন্দ।
যুক্তি প্রয়োগের যে শৃঙ্খলা সেটা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বিকশিত হয়। তারপর সেখাতে হবে সৃজনশীলতা। অঙ্ক করতে যে আনন্দ এটা সৃজনশীলতা। সেই সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে তাকে শেখাতে হবে। শিশুকে শেখাতে দক্ষ শিক্ষকও দরকার। আমাদের কি সেই শিক্ষক-প্রশিক্ষক আছে? প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারলে পরবর্তীতে তাদের নিয়ে খুব বেশি দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করেছি প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে। গত ৭৮ বছরে এ দিকে কোনো মনোযোগই দিইনি। ১০-১৫ হাজার টাকা বেতনে আপনি ভালো শিক্ষক পাবেন কোথায়? আপনি শিক্ষকদের গুণগত শিক্ষা দেবেন? এটাকে বলে শুভঙ্করের ফাঁকি। আমাদের তো সেই টাকা নেই। সেই টাকা থাকলে তা ব্যয় করি অন্য প্রয়োজনে। মেট্রোরেল করি, পদ্মা সেতু করি। পদ্মা সেতু করার আগে আমাদের প্রয়োজন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় করা।
(লেখাটি ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্য থেকে নেয়া)
সলিমুল্লাহ খান: চিন্তাবিদ ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে