রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মতো বিকিরণ করছেন আলো
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকীতে গভীরভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্মরণ করছি। আজ আমি পাকিস্তান পিরিয়ডে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতার বিষয়ে বলতে চাই। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও রবীন্দ্রনাথবিরোধীরা জাগ্রত আছে। তাই এই নতুন প্রজন্মকে সেই ঐতিহাসিক প্রক্ষাপট জানতে হবে।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রসঙ্গ ওঠে। সেটি ছিল জুন মাস। চলছিল বাজেট অধিবেশন। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সংসদের সরকারি দলের নেতা আবদুস সবুর খান। তিনি তার বক্তৃতায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ইসলাম রক্ষার নামে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টানলেন এবং বিষোদ্গার করলেন। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে যত প্রিয় হয়ে উঠছে, ততই ইসলামী সংস্কৃতির ধারক-বাহক তদানীন্তন সরকারের মর্মমূলে ভীতির সঞ্চার করছে। জাতীয় সংসদে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে সবুর খানের কটূক্তিই তার প্রমাণ; কিন্তু তাকে ছাড়লেন না বিরোধী দলের বাঙালি সংসদ সদস্যরা। শুরু হয় তুমুল বাগবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে বিরোধী দলের সদস্য সোলায়মান খান বলেছিলেন, ‘যারা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, তারা ঢাকা গেলে বিমানবন্দরেই তাদের ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে।’
উত্তেজিত হয়ে ওঠে সরকারি দলের সদস্যরা। নিজের দলের সদস্যদের ঠান্ডা করার জন্য আবদুস সবুর খান বিরোধী দলের সদস্যদের Howling Idiots বলে গালি দেন।
পরবর্তী পদক্ষেপে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। যারা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন, তাদের ওপর নানারকম নিপীড়ন করা হয়। বিশেষ করে জাহেদুর রহিম এবং সনজীদা খাতুনকে নাজেহাল করা হয়। জাহেদুর রহিমকে ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এই ধাক্কায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং দু-এক বছরের মধ্যেই মারা যান। সনজীদা খাতুন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। তাকে ঢাকা থেকে সুদূর রংপুরে বদলি করা হয়; কিন্তু তার মনের জোর ছিল অন্যরকম। তিনি হার মানেননি। তিনি ‘ছায়ানট’ সংগীত বিদ্যানিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত উপলব্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির কাছে আমি ঋণী। এ দেশের সাংস্কৃতিক জীবনে যত পীড়ন এসেছে ততই নব উৎসাহে রবীন্দ্রসংগীতের কাছে সরে এসেছি আমরা। বিচিত্র বিরূপ ব্যবহার রবীন্দ্রসংগীতকে উত্তরোত্তর অন্তরঙ্গ করে তুলেছে। তাই রবীন্দ্রসংগীত হয়েছে আমাদের নিশ্চিত আশ্রয়।’
বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। সেই বিবৃতিতে বলা হয়: ‘স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় ২৩ জুন ১৯৬৭ তারিখে মুদ্রিত এক সংবাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। ইহাতে সরকারি মাধ্যম হইতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হইয়াছে। আমরা এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক বলিয়া মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করিয়াছে, তাহার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীব্রতা দান করিয়াছে, তাহা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করিয়াছে। সরকারি নীতিনির্ধারণের সময়ে এই সত্যের গুরুত্বকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।’ উক্ত বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের মধ্যে আহমদ শরীফ, নীলিমা ইব্রাহীম, রফিকুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, শহীদুল্লা কায়সার, ফজল শাহাবুদ্দীন, জয়নুল আবেদিন, কাজী মোতাহার হোসেন, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, খান সারওয়ার মুরশিদ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, মুনীর চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, সিকানদার আবু জাফর, মুহাম্মদ আবদুল হাই, শামসুর রাহমান প্রমুখ অন্যতম।
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন আন্দোলনে নামে। চাপের মুখে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন অধ্যাপককে ডেকে ধমকের সুরে বলেন, আপনারা কী করেন? রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেন না? যাদের তিনি এ কথা বলেছিলেন, তারা অতো মূর্খ ছিলেন না যে, এ কথা শুনে রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করবেন। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষাক্রমে রবীন্দ্র-সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য পাঠ্যক্রম তৈরি করেন। সরকারের রুদ্ররোষের বিরুদ্ধে এটাও ছিল এক নীরব প্রতিবাদ।
আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক বইয়ে কবি শামসুর রাহমান তার ‘নতুন করে রবীন্দ্রচর্চা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এ এক কৌতুকপ্রদ তথ্য যে, বঙ্গীয় সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত পুরুষও বটে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাগবিতণ্ডা কম হলো না আজ পর্যন্ত। এবং দুঃখের বিষয়, সেসব বাকবিতণ্ডার অধিকাংশই অসাহিত্যিক।’ আমার মনে হয়, এতেও আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ‘অসাহিত্যিক’ রবীন্দ্রবিতর্ক আমাদের এগিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে ছাড়া পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বক্তৃতায় বললেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপীয়র, এরিস্টটল, দাঁন্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না-আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হইবেই।’
আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ এমনই এক প্রচণ্ড শক্তি ছিলেন, যে কারণে পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ তাঁকে দাবিয়ে রাখার, এমনকি নিশ্চিহ্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে; কিন্তু তারা ঠিকই বুঝেছিল যে, যতই অখণ্ড পাকিস্তানের সংহতির নামে তারা চেঁচাক না কেন, বাঙালির জাতিসত্তার বিকাশে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব পাকিস্তানবাসীর জীবনের সূর্যবলয় হৃদয় এবং মননের উজ্জ্বল আলো। তাকে তাদের জীবন থেকে খারিজ করে দিতে চেয়ে পরাজিত হয়েছে নিজেরাই। পরিণাম হয়েছে তাদের জন্য আরো বেশি ভয়াবহ। বাঙালি ঠিকই তার নিজস্ব পথে এগিয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে দেয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “কবিগুরু আপনি লিখেছিলেন, ‘সাতকোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালি করে-মানুষ করোনি।’ কবিগুরু আপনার কথা মিথ্যা হয়ে গেছে, আপনার বাঙালি মানুষ হয়েছে।” এই মানুষ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’
এভাবেই, এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অমোঘ আমাদের জীবনে। যখন রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুশয্যায়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ফ্যাসিস্ট জার্মানি আক্রমণ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবরোধ করে রেখেছে লেনিনগ্রাদ শহর। তিনি অসুস্থ, তবু যুদ্ধের খবর জানার জন্য সারাক্ষণ উদগ্রীব থাকতেন। নির্মলকুমারী মহলানবীশ তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, “খবরের কাগজ এলে, এনে দিতাম। দেখি একমাত্র ইন্টারেস্ট যুদ্ধের খবরে, অর্থাৎ জার্মানরা কেবলই এগোচ্ছে, না রাশিয়ানরা কোথাও ওদের ঠেকাতে পারছে। যেদিন দেখেন, জার্মানদের অগ্রগতিতে একটু বাধা পড়েছে, সেদিন মুখের কাছে কাগজখানা ধরে প্রথম লাইন থেকে শেষ লাইন পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়েন। আর যেদিন বড়ো বড়ো হেডলাইনে লেখা থাকে, জার্মান সৈন্য আজ এতো মাইল সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে গেছে, সেদিন কাগজখানা হাতে নিয়ে ওই হেডলাইনটা পড়া হলেই ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেন- ‘হয়ে গেছে, নিয়ে যাও’। সেদিন অনেকক্ষণ মুখখানা ভার থাকে।”
১৯৪১ সালের ৩ জুলাই রবীন্দ্রনাথের শরীরে অস্ত্রোপচার করা হবে, সেদিন সকালে জানতে চেয়েছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানবতার অগ্রযাত্রার খবর। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ লিখেছেন, “যেদিন অপারেশন করা হয়, সেদিন সকালবেলা অপারেশনের আধঘণ্টা আগে আমার সঙ্গে তার এই শেষ কথা: ‘রাশিয়ার কথা বলো।’ বললুম, ‘একটু ভালো মনে হচ্ছে, হয়তো একটু ঠেকিয়েছে’। মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হবে না? ওদেরই তো হবে। পারবে, ওরাই পারবে।”
রবীন্দ্রনাথ পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত কখনো পরাভব মানবে না।’ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি কতটা ভালোবাসতেন, সেটা বলা সহজ কথা নয়, তবে তিনি যে পরিপূর্ণভাবে একজন ফ্যাসিবাদীবিরোধী মানুষ ছিলেন, সেটা তার লেখা এবং কার্যকলাপ থেকে পরিষ্কার। সোভিয়েত ইউনিয়নকে যুদ্ধে জেতার মধ্য দিয়ে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে মানবতার জয়।
আমি এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি এজন্য যে, ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে বাঙালিদের লড়তে দেখে তিনি আশ্বস্ত হতেন এবং গর্ব করে বলতেন, আমি জানি ওরা পরাভব মানবে না। বাঙালি পরাভব মানেনি, আর একটি ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছিল। লড়ে প্রমাণ করেছে, রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন তাদের চেতনায় কত প্রগাঢ়, কত নিবিড়। এভাবেই পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের অস্তিত্বের সংকট উত্তরণে আমরা রাজনৈতিকভাবে জিতেছি। রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মতো বিকিরণ করেছেন আলো।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক এবং সভাপতি, বাংলা একাডেমি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে