Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

৯৯ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই, বলছে ফায়ার সার্ভিস

ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রাজশাহী নগরী, পর্ব-১

Shamiul Alim

শামীউল আলীম

বুধবার, ২৭ মার্চ ২০২৪

গ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে রাজশাহী। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজশাহীতে অবস্থিত প্রায় ৯০ শতাংশের অধিক ভবন, বিপণীবিতান, রেস্তোরাঁ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দিরে নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, রাজশাহী সিটি করপোরেশন, রাজশাহী মহানগর পুলিশ, রাজশাহী জেলা প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর নেই দৃশ্যমান তৎপরতা। ফলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, যে কোনো মুহূর্তে রাজশাহীতে ঘটতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত বড় কোনো অগ্নি দুর্ঘটনা। তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।

সম্প্রতি সরেজমিনে রাজশাহীর বিভিন্ন ভবন, বিপণীবিতান, রেস্তোরাঁ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, মেস, ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাস, আবাসিক হোটেল ঘুরে দেখা যায়, শতকরা ৯০ শতাংশের অধিক স্থাপনায় নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামাদি। যা সত্যিই আশঙ্কাজনক। তবে এসবে বসবাস করা বা অবস্থানকারীদের কারও নেই এ বিষয়ে কোনো উদ্বেগ।

রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট, আরডিএ মার্কেট, সাহেববাজার কাপড়পট্টি, স্বর্ণপট্টি, স্যান্ডেল পট্টি, গণকপাড়া, মালোপাড়া, জয় বাংলা চত্বর, বাটার মোড়, সোনাদীঘি মোড় ও তার আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত ভবন, মার্কেট ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এদের বেশিরভাগের নেই অগ্নি নিরাপত্তা বা অগ্নি নির্বাপণের কোনো কিছুই। সাহেব বাজারের ‘শিবগঞ্জ সুইটস’-এ যাওয়ার পর দেখা যায়, দোকানটির কারিগররা গ্যাস সিলিন্ডার চুলার কাছে রেখে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় খাবার প্রস্তুত করছে। তাদের প্রতিষ্ঠানে দেখা মেলেনি অগ্নি নির্বাপণের কোনো সরঞ্জামাদি। নেই অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাও। তার পাশে থাকা ‘রস মেলা’ তে গিয়েও একই দৃশ্য দেখা যায়।

একটু এগিয়ে আরডিএ মার্কেটের মেইন গেটের কাছে রাস্তার পাশে ফুটপাতের ধারে উন্মুক্ত স্থানে একজন ব্যবসায়ী গ্যাসের চুলায় খাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। অথচ তিনি যে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে খাবার প্রস্তুত করছেন তার সাথেই রাখা গ্যাস সিলিন্ডার। একই চিত্রের দেখা মিলল সাহেব বাজার বড় জামে মসজিদের সামনের রাস্তায়। জান্নাত বেকারীর সামনে রাস্তায় গ্যাসের চুলায় খাবার প্রস্তুত করছেন এক কারিগর। আর চুলার দু’পাশে রয়েছে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার। তার পাশে সৌদিয়া ফার্মেসির সামনে রাস্তায় অন্য একজন কারিগর রাস্তার পাশে গ্যাসের চুলায় বিভিন্ন মুখরোচক খাবার প্রস্তুত করছেন। সেখানেও রয়েছে একাধিক গ্যাস সিলিন্ডার। তার কয়েক হাত সামনে আরও একজন ভাজাপোড়া বিক্রি করেন। তিনিও ব্যবহার করছেন গ্যাসের চুলা। এমনভাবে শামীম সুইটসেও গ্যাসের চুলায় চলছে নানা পদের রান্না। যার অদূরে সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের জলিল বিশ্বাস পয়েন্টের পূর্ব গেটের পাশে দেখা যায়, মার্কেটের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাতে অরক্ষিত অবস্থায় রাখা ১০/১২টি গ্যাস সিলিন্ডার। তার কিছুটা দূরেই বিদ্যুৎ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের অবস্থান। সেখানে গিয়ে দেখা মিলে ভয়াবহ চিত্র। অল্প জায়গার মধ্যে রাখা হয়েছে একসঙ্গে প্রায় ১০/১২টির মতো গ্যাস সিলিন্ডার। যা দিয়ে জ্বলছে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে চুলাগুলো। সেই চুলায় চলছে রান্না বানা আর ভাজাপোড়ার কাজ। তার পাশেই রয়েছে চায়ের দোকান। সেখানেও দেখা মিলল গ্যাস সিলিন্ডার আর জ্বলন্ত চুলার।

এমন চিত্র দেখা গেছে যে, রাজশাহীর প্রতিটি মোড়ের দোকানগুলোতে। রাজশাহীজুড়ে প্রায় প্রতিটি( চায়ের দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট এবং বাড়িতে ব্যবহৃত হচ্ছে গ্যাসের সিলিন্ডার আর চুলা। গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার আর চাহিদা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডার কেনাবেচাও। ফলে রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অলিগলিতেও এখন গ্যাস সিলিন্ডার কেনাবেচা করা হচ্ছে। তবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার কিংবা কেনাবেচায় নিশ্চিত করা হচ্ছে না সঠিক ও পর্যাপ্ত নির্দেশনা এবং নিরাপত্তা। গ্যাসের চুলার পাইপ আর গ্যাস সিলিন্ডারের রয়েছে নির্ধারিত মেয়াদ। মেয়াদোত্তীর্ণ হলে সেগুলো বাতিল করতে হয়। নিতে হয় নতুন। তবে সেটা দেখার সময় আছে কার। মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার ও পাইপের ব্যবহারে ঘটতে পারে বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ ঘটনাও। ফলে ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাজশাহী নগরী।

রাজশাহী নগরীর অধিকাংশ বাড়িতে নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বসবাসকারীদের প্রায় অধিকাংশের নেই অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ক প্রশিক্ষণ। রাজশাহীতে হু-হু করে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। বিভিন্ন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান এসব বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। তবে গড়ে উঠা এসব বহুতল ভবনের নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নি নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ করা অনেক বহুতল ভবন ঘুরে দেখা যায়, সেখানে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বহুতল এসব ভবনে স্থাপন করা হয়নি ফায়ার হাইড্রেন্ট।

যুব সংগঠন সচ্ছলতা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও থ্রি স্টার ওপেন স্কাউট গ্রুপের সিনিয়র রোভারমেট মো. ইহতেশামুল আলম বলেন, ‘আমাদের রাজশাহী শহরে ওয়াটার (ফায়ার) হাইড্রেন্ট নেই বললেই চলে। আমাদের পুকুরগুলো শেষ হয়ে গেছে। পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে সেখান থেকে পানি নিয়ে যে অগ্নিনির্বাপণ করা যাবে সেই পরিস্থিতি অনেক কমে গেছে।’

রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার আবু সামার কাছে অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট অনেক বেশি কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ। এটা থাকলে অগ্নিনির্বাপণ কাজে অনেক বেশি সহায়ক হয়। আমাদের পানির প্রাপ্যতা ও পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করে। তবে অগ্নিনির্বাপণে রাজশাহীতে দু-একটা বাদে প্রায় সব বহুতল ভবনগুলোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট নাই।

ফায়ার হাইড্রেন্টের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স রাজশাহী বিভাগের উপপরিচালক মো. ওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজশাহীতে নতুন নগরায়ণ হচ্ছে। রাজশাহী শহরটা সুন্দর। চাইলে রাজশাহী ওয়াসার সাথে সমন্বয় করে রাজশাহীতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা যেতে পারে।’

রাজশাহীর গণকপাড়ায় অবস্থিত লোটোর ১৮০০ স্কয়ার ফিটের আউটলেট। যাতে নাই একটিও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার)। এদিকে বাটারমোড়ের লোটো আউটলেটে একটা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। এদিকে এ্যাপেক্স’র আউটলেটে থাকা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের মেয়াদ ছিল মাত্র তিন দিন। রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে অবস্থিত জলিল বিশ্বাস পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) এর মেয়াদ ছিল ২৩ মে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। যা এখনও দেয়ালে ঝুলানো রয়েছে।

রাজশাহীর আরডিএ মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে থাকা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে। আরও কিছু অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) ঝুলানো অবস্থায় পাওয়া যায়, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালে। যদিও গত ১৬ মার্চ আরডিএ মার্কেটে কিছু অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) স্থাপন করা হয়েছে। তবে স্থাপন করা হলেও সেটার যথাযথ ব্যবহার জানেন না মার্কেটে থাকা দোকানদার ও কর্মচারীরা। আরডিএ মার্কেটের কিছু দোকানদার ও কর্মচারী অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) ব্যবহার করা জানেন ও তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ করা আছে বলে দাবি করলেও তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে সঠিক উত্তর দিতে পারেননি তারা।

আরডিএ মার্কেটের রোদেশী ক্লথ স্টোরের কর্মচারী সবুজ বলেন, ‘আমি ব্যবহার করতে জানি না। ছবি দেয়া আছে দেখে ব্যবহার করব।’ নাফিসা ম্যাচিং সেন্টারের কর্মচারী শিহাব বলেন, ‘আমি এ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারি না।’

তুলি লতা বস্ত্র বিতানের কর্মচারী কেয়া বলেন, ‘আমি এ অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) ব্যবহার করা জানি না।’ আরাফাত ম্যাচিং কর্ণারের কর্মচারী শীমা বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) দিয়েছে তা যথেষ্ট না। প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন। এ মার্কেট শুধু না রাজশাহী নিরাপদ না। ব্যবস্থা নিতে হবে।’ ফলে বলা যেতে পারে যে, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র (ফায়ার এক্সটিংগুইসার) আরডিএ মার্কেটে স্থাপন করা হলেও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তা কোনো কাজে দেবে না।

রাজশাহীর উন্নয়ন গবেষণাধর্মী যুব সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাসের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ‘শুধু মার্কেটগুলোই নয়, সমগ্র রাজশাহী অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। অদৃশ্য কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করারও পরেও এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এর ফলে ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।’

রাজশাহীতে কোনো অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটার আগেই অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত মার্কেট ভবনগুলোসহ সমগ্র রাজশাহীতে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবিলম্বে সমন্বিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান তিনি।

বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সভাপতি শেখ তাসনীম জামাল বলেন, ‘রাজশাহীতে যেসব বাড়ি ও রেস্টুরেন্টগুলোতে গ্যাসের চুলা ব্যবহৃত হয় সেই বাড়ি ও রেস্টুরেন্টগুলো অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ। যুবকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে অগ্নি নির্বাপণ ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বাড়ানোর এবং অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের মূল্য কমিয়ে তা সহজলভ্য করতে দাবি জানান তিনি।

জানা গেছে, রাজশাহী আগে ছিল পুকুরের নগরী। রাজশাহীতে ছিল ৯৫২ টি পুকুর। যা কালের বির্বতনে বিলীন হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা পুকুর জলাশয়গুলো ভরাট করেছে। সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। জলধারা কমে যাওয়ার প্রভাবে অগ্নিনির্বাপণের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে আর দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে।

এ বিষয়ে আদিবাসী যুব পরিষদ রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি উপেন রবিদাস বলেন, ‘পানির উৎসগুলো আমাদেরকে সংরক্ষণ করা লাগবে। আশেপাশে পানির উৎসগুলো না থাকার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পানির উৎসের অভাবের কারণে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তা নেভাতে দেরি হয়। এই কালক্ষেপণ হয় বলে অগ্নিকাণ্ডে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

(এটি ২ পর্বের সিরিজের ১ম অংশ)



মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ