ধর্ষণের সংখ্যা এবং ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তির তর্ক
বান্দরবানে কিশোরীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ৪ তরুণ গ্রেপ্তার; রাজধানীর খিলক্ষেতে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণে অভিযুক্ত তরুণকে গণপিটুনি; নবাবগঞ্জে শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে প্রতিবেশীকে পিটিয়ে পুলিশে দিলো জনতা; রাজধানীর পল্লবীতে নির্মাণাধীন ভবনে আটকে রেখে নারী সংবাদকর্মীকে রাতভর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ; নরসিংদীতে ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে ধর্ষণ ও ভিডিও করার অভিযোগ ইত্যাদি। এগুলো সাম্প্রতিক কিছু খবরের শিরোনাম। অনলাইনে সার্চ করলে এরকম আরও অনেক খবর পাবেন, যেগুলো মার্চ মাসেই ঘটেছে।
৩১ মার্চ বেসরকারি সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, মার্চ মাসে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা গত ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে ধর্ষণ ও হত্যা। মার্চ মাসে যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণচেষ্টাসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪২৮টি। আগের মাসে মোট নারী নির্যাতনের ঘটনার এ সংখ্যা অনেকটাই বেশি। এমএসএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৩২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি।
পরপর এতগুলো ধর্ষণের ঘটনার মধ্য দিয়ে কী প্রমাণিত হয়, দেশে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে গেছে? প্রশ্নটা করেছিলাম ব্যারিস্টার তাসনুভা শেলিকে— যিনি দীর্ঘদিন ধরে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন। ব্যারিস্টার শেলি বলছেন, ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে গেছে কি না, সেটি বলা কঠিন। তবে ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতার খবর এখন আগের চেয়ে বেশি সামনে আসছে। এর কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। যেমন:
১. সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে দ্রুত তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, ফলে কেউ চাইলেও তথ্য গোপন করতে পারছে না।
২. ধর্ষণ, বিশেষ করে শিশুর ওপর এই ধরনের শারীরিক সহিংসতা হলে সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি চেপে রাখার চেষ্টা করা হতো। হয়তো সেখানে ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ হয়েছে। ফলে এ ধরনের যে কোনো খবরই গণমাধ্যমে আসছে।
৩. গণমাধ্যমে এ জাতীয় খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশ ও প্রচার করছে।
৪. সাম্প্রতিক সময়ে যেহেতু নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, ফলে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা এমনকি নারীর প্রতি অন্যান্য অপরাধও আর আড়ালে থাকছে না। কোনো না কোনোভাবে জনপরিসরে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
৫. সরকার যে ঠিকমতো দেশ চালাতে পারছে না, সেটি প্রমাণের জন্যও এক বা একাধিক পক্ষ ধর্ষণ বা নারীর প্রতি সহিংসতার মতো ঘটনাগুলো সচেতনভাবেই হয়তো ঘটাচ্ছে।
কারণ যাই হোক না কেন, ধর্ষণের মতো ঘটনা যে বেড়েছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ফলে প্রশ্ন হলো, এর প্রতিকার কী এবং দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও কেন এ ধরনের অপরাধ কমছে না? দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও এই অপরাধে এ পর্যন্ত কতজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে?
কত জনের ফাঁসি হয়েছে?
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সম্ভবত সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এরপরে আর কারও ফাঁসি কার্যকর হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি রাতে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাই সিকিউরিটি কারাগারে ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় দণ্ডিত শুক্কুরের ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০০৪ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সংঘটিত একটি দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় শুক্কুর জড়িত ছিলেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়।
২০২০ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি খবরে বলা হয়, দেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলায় গত ১১ বছরে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। যখন ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়, তখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কারাগারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি ছিলেন আরও ১৪৪ জন। বিভিন্ন মামলার রায় বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে প্রমাণের দায়ভার অনেক বড় হয়। সে ক্ষেত্রে চুলচেরা সুনিশ্চিত প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তির খালাস পাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। নিম্ন আদালতে হওয়া মৃত্যুদণ্ডের বেশির ভাগ উচ্চ আদালতে টেকে না। বিচারপ্রার্থীর অপেক্ষা দশকের পর দশক গড়ায়। এমনিতেই ধর্ষণ মামলা ঝুলে থাকে, সাজার হারও নগণ্য।
বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়ার পর ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উচ্চ আদালতে আসামিদের ৪৮টি আপিল মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, সব কটি মামলার আসামিরাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত পাঁচটি মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। বাকি দুটি ক্ষেত্রে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছিলেন। তারা আপিল বিভাগে গিয়েছিলেন কি না, তা জানা যায়নি। (প্রথম আলো, ১৬ অক্টোবর ২০২০)।
কারা কেন ধর্ষণ করে?
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় যেদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন বহিষ্কৃত নেতাসহ ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, সেদিন দিবাগত রাতে ওই সুবর্ণচরেই ঘরের সিঁধ কেটে ঢুকে মা-মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরদিন সুবর্ণচর উপজেলার চরওয়াপদা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল খায়ের মুন্সিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগেও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও ধর্ষণ এবং নারীকে বিবস্ত্র করে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ঘটনায় মামলাও হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় সুবর্ণচর বা এরকম চর এলাকাগুলো কেন বারবার সংবাদ শিরোনাম হয়, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
বাস্তবতা হলো, ক্ষমতা কেবল রাজনৈতিক নয়। পদ-পদবি, আর্থিক সক্ষমতা এবং সামাজিক খ্যাতিও এক ধরনের ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার উন্মত্ত প্রকাশ ঘটাতে গিয়েও অনেক সময় ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে সুযোগসন্ধানী, স্বনিয়ন্ত্রণে অক্ষম এবং বিকৃত রুচির ক্ষমতাবান পুরুষ সুযোগ পেলেই অধস্তন, দুর্বল বা বিপদাপন্ন নারীর শয্যাসঙ্গী হতে চায়। তাদের প্রস্তাবে রাজি না জোর করতে শুরু করে বা ধর্ষণ করে। অনেক সময় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যও এই ধরনের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের মধ্য দিয়ে কেউ যখন কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়, সেখানে সাধারণত ক্ষমতার বিকারটাই মুখ্য; শারীরিক আনন্দ লাভ নয়।
কেন ধর্ষণ বন্ধ হয় না বা সভ্য ও উন্নত বিশ্বেও কেন ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, তা নিয়ে নানা মত ও বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে এ বিষয়ে দ্বিমত নেই যে, শুধু একটি বিচ্ছিন্ন কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে না বা হুট করে কেউ ধর্ষক হয়ে ওঠে না। এ জন্য তার বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিকতা, শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতি, আইনের প্রতি ভয়-আস্থা ও শ্রদ্ধা, নারী ও শিশুর প্রতি শ্রদ্ধা-মমত্ববোধ-ভালোবাসা, নারীকে কতটা নারীভাবে আর কতটা মানুষ, যে সমাজে বাস করে সেই সমাজে মানুষকে মানুষ ভাববার মতো মানুষের সংখ্যা কত ও সেখানে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের কতখানি সুযোগ রয়েছে— এরকম অনেক ফ্যাক্টর কাজে করে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা এবং ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত।
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির তর্ক
যখনই সমাজে কোনো অপরাধ বেড়ে যায়, তখনই ওই অপরাধের দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়ে গেলে তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে লিখেছেন: ‘ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়া হোক’। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। বড় ধরনের অপরাধ হলেই মানুষ এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় মূলত এই কারণে যে, যাতে এ ধরনের অপরাধ করতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না পায়। সে কারণেই অনেকে ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়ার কথা বলেন; কিন্তু একটি বর্বরতার শাস্তি আরেকটি বর্বরতার মাধ্যমে হয় কি না, সেটিও প্রশ্ন। যে কারণে বিশ্বের বহু দেশ ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করেছে।
পরিশেষে…
ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার ফলে এরকম অপরাধ কমেছে কি না বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান করলেই অপরাধ কমে যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেননা, সমাজে ধর্ষণ বেড়ে যায় নানা কারণে। বিশেষ করে কেউ যখন ধর্ষণ করে তখন তার বিবেচনায় রাষ্ট্রের আইন তো বটেই, এমনকি ধর্মের বিধান তথা পরকালের ভীতিও কাজ করে না। আবার অনেকের আইন সম্বন্ধে ধারণা থাকে না। উপরন্তু আইন জানলেই যদি মানুষ অপরাধ বন্ধ করে দিত, তাহলে দেশে খুন-খারাবি হতো না। কেননা সবাই এটা জানে যে, খুনের শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড।
যে কারণে বলা হয়, অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা বা শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো কিংবা দ্রুত বিচারের চেয়েও জরুরি হলো অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন। কঠোর আইন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সেখানে একটি উপায়মাত্র। এর বাইরে আরও অনেক রাষ্ট্রীয়ও সামাজিক উদ্যোগ, বিশেষ করে সমাজে ইনসাফ তথা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা; পরমতসহিষ্ণু ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারগুলো নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধ কমিয়ে আনা যায় বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ শুধুই কঠোর আইন করে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করে কিংবা দ্রুত বিচার করেও সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে