ক্লান্ত চালকের বেপরোয়া গতিতে সড়কে ঝরছে প্রাণ
বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক যেন দুর্ঘটনার হাব। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। কেউ নিহত, কেউবা আহত হয়ে সারা জীবনের তরে বরণ করছে পঙ্গুত্ব। এসব দুর্ঘটনায় বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে পথে বসছে। জানা গেছে, বিভিন্ন রুটে বেআইনিভাবে গাড়ির ট্রিপ বাড়তি দিতে গিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা এমন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ১০ হাজার দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং আহত হচ্ছে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে যানবাহনের অতিরিক্ত গতি ও চালকদের ক্লান্ত শরীরে ঝাপসা চোখে বেপরোয়া গাড়ি চালানো। মালিক পক্ষের করা রোস্টার অনুযায়ী অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে গিয়েই চালকরা এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছেন, যা বহু মানুষের জীবন নেয়ার জন্য দায়ী। বিভিন্ন পরিবহনের চালক ও হেলপারদের অভিযোগ- ট্রিপের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মালিকরা চাপ দেন। চালকদের বলা হয়- যত ট্রিপ, তত টাকা। না চালালে চাকরি থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে চালকসংখ্যা না বাড়ায় একই চালক ঘন ঘন ট্রিপ দেয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারা, যার অনিবার্য পরিণাম ভয়াবহ দুর্ঘটনা। মৃত্যুর মিছিল। অথচ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানায় মামলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রিট হয়; কিন্তু এসব মামলায় মালিক পক্ষ থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বরিশাল থেকে ঢাকা আসার পথে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় সাকুরা পরিবহনের একটি গাড়ি ২০১২ সালের আগস্টে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। এতে মৃত্যু হয় ১২ জনের। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী এক বিচারক সাকুরা পরিবহন, গাড়ির বীমাকারী প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেন ঢাকার আদালতে। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ও দেউলিয়াবিষয়ক আদালতের বিচারক হোসনে আরা আক্তার ঢাকা জেলা জজ আদালতে এই মামলা করেন। মামলা সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনার শিকার বাসের চালক একটানা ১৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সাকুরা কর্তৃপক্ষ ওই চালককে বলেছিল- টানা তিন ট্রিপ দিতে হবে, কারণ চালক কম আছে। বর্ষাকাল, তাই ফেরি পারাপারে দেরি হচ্ছে। বিশ্রাম নিতে হলে ফেরি ঘাটে বা ফেরিতে নিতে বলা হয়েছিল। মামলার এজাহারে বলা হয়, চালক তপু ঘটনার সময় ছিলেন অত্যন্ত ক্লান্ত। ঘুম ঘুম চোখে বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন গাড়ি। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশের গাছে সজোরে ধাক্কা দেয়। এই দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ও ১৭ জন গুরুততর আহত হন।’ মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
ঢাকার রূপনগরের সবজি বিক্রেতা আয়নাল হোসেনের (৫৫) স্ত্রী ফিরোজা বেগম (৪৫) ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল অ্যাম্বুলেন্সে স্ত্রীর লাশ নিয়ে তিনি গাইবান্ধার বাড়িতে ফিরছিলেন। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের ঘোগা সেতু এলাকায় পৌঁছালে ঢাকাগামী শ্যামলী পরিবহনের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলে আয়নাল হোসেনের মৃত্যু হয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন অ্যাম্বুলেন্সচালক দ্বীন ইসলাম ও আয়নাল হোসেনের তিন ছেলেকে গুরুতর আহত অবস্থায় বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে রাত ৯টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সচালক দ্বীন ইসলাম মারা যান। এ ঘটনায় রিট হলে ওই বছরের ৭ আগস্ট হাইকোর্ট হতাহতদের ১ কোটি ৭১ লাখ টাকা দিতে শ্যামলী পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রতি রুল জারি করেন। এই রিটের বিষয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘ঘাতক বাসটির ড্রাইভার দিনাজপুর থেকে ঢাকা টানা তিন ট্রিপ দিচ্ছিলেন। এটা নাকি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল। অথচ সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা আছে একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি কোনো চালক দূরপাল্লার গাড়ি চালাতে পারবে না। বেশি দূরত্বে যেতে হলে পথে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। সকাল-বিকেল বা দিন-রাত টানা ট্রিপ দিতে পারবেন না। অথচ ওই ঘটনায় শ্যামলী পরিবহনের ড্রাইভার মাত্র ২ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে টানা ২০ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছিলেন।’
পরিবহনের অতিরিক্ত ট্রিপ ও চালকদের বিশ্রাম না দেওয়ার ব্যাপারে সাকুরা পরিবহনেরে এমডি মো. হুমায়ুন কবির ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি সব নিয়ম মেনেই রাস্তায় গাড়ি চালায়। তারপরও রাস্তায় দুর্ঘটনা হতে পারে। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে আমরা কোনো ড্রাইভারকে অতিরিক্ত ডিউটি দিই না। অনেক সময় ড্রাইভাররাই ওভারটাইমের টাকার জন্য বাড়তি ট্রিপ দেন। এটাও আমরা মনিটর করছি।’ গ্রিনলাইন পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার আব্দুস সাত্তার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাস্তায় কিছু হলেই মালিক পক্ষকে দায়ী করা হয়। এটা তাই কোনো নতুন ইস্যু না। আমাদের পরিবহনের গাড়ি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। প্রায় সবই দামি এসি গাড়ি। তাই অযথা ড্রাইভারকে বাড়তি ট্রিপ দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানোর মতো কাজ আমরা কেন করব? তবে কিছু ক্ষেত্রে জোনাল অফিস ও কিছু ড্রাইভার মিলে বাড়তি ট্রিপ দেয় বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে আমরা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছি।’
হানিফ পরিবহনের এক ড্রাইভার বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমরা ইচ্ছা করে বাড়তি ট্রিপ নেই কিছু বেশি আয় করার জন্য। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ জোর করে অনেক দূরের জেলায়ও আমাদের দিনে দুই ট্রিপ দেয়ায়। প্রথমবার যেতে সমস্যা না হলেও দ্বিতীয়বার ফিরতে অনেক সময়ই ক্লান্ত লাগে। তখন জোরে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত ফিরতে ইচ্ছা করে। এসময় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা দেখবেন গাড়ি ছাড়ার পর পরই না, অধিকাংশই দুর্ঘটনা ঘটে গাড়ি দূরের গন্তব্যে পৌঁছানোর ঠিক আগে আগে। মানে তখন ড্রাইভাররা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।’ এনা পরিবহনের চালক শাহীন হোসেন বলেন, ‘আমি ঢাকা ময়মনসিংহ রুটে গাড়ি চালাই। দিনে দুই ট্রিপ দেই। সপ্তাহে দু-এক দিন তিন ট্রিপও দিতে হয়। এভাবেই রোস্টার করা আছে।’ ট্রিপের মাঝে বিশ্রাম পান কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাঝে দুপুরের খাবার খাই। আর তেমন বিশ্রাম নেই।’
এদিকে, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’-এর ধারা ১০৬ (১)-এ বলা হয়েছে কোনো কোম্পানি কর্তৃক এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইলে, উক্ত অপরাধের সহিত প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রহিয়াছে উক্ত কোম্পানির এরূপ মালিক, পরিচালক, নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপক, সচিব, অন্য যে কোনো কর্মকর্তা উক্ত অপরাধ সংঘটন করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করিতে পারেন যে উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে এবং উহা রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।’ এই ধারার উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত কোম্পানি আইনগত সত্তা হইলে, উক্ত উপ ধারায় উল্লিখিত ব্যক্তিকে অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে, তবে উহার ওপর (মালিক পক্ষ) সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শুধু অর্থদণ্ড আরোপ করা যাইবে।’
ব্যাখ্যা: এই ধারার কোম্পানি অর্থে, নিয়মিত বা নিবন্ধিত হোক বা না হোক, কোনো কোম্পানি বা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, অংশীদারি কারবার, সমিতি বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন এবং সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বা সরকারের সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিকানাধীন যে কোনো কোম্পানি বা সংস্থা উহার অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা, প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্রের দণ্ড: ধারা-৯৯। ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন বা প্ররোচনা প্রদান করেন বা ষড়যন্ত্র করেন এবং যাহার ফলে সংশ্লিষ্ট অপরাধটি সংঘটিত হয়, তাহা হইলে উক্ত সহায়তাকারী, যড়যন্ত্রকারী বা প্ররোচনা প্রদানকারী ব্যক্তি উক্ত অপরাধ সংঘটনের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের সমপরিমাণ দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ অপরাধ পুনঃসংঘটনের দণ্ড: ধারা-১০০। এই আইনে উল্লিখিত কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডভোগকারী একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করিলে, উক্ত ব্যক্তিকে সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত করা যাইবে এবং ইহা কোনোক্রমে পূর্বে প্রদত্ত দণ্ডের দ্বিগুণের কম হইবে না।’ আইনজ্ঞদের মতে মালিক পক্ষ এই সহায়তাকারীরা হতে পারেন।
অন্যদিকে, সড়ক পরিবহন আইনের ৩৯ ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে- সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০০৬ সনের ৪২নং আইন) এর সহিত সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করবেন। (২) নিয়োগকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উপধারা (১) মেনে চলবেন তা মেনে চলবেন।’ পরে সরকার এক প্রজ্ঞাপনে বলেন- ‘একটানা ৫ ঘণ্টার বেশি কোনো চালক গাড়ি চালাতে পারবে না এবং ৫ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে। দিনে একাধিক ট্রিপ দেয়া যাবে না। রাতে গাড়ি চালানো চালক ও হেলপারকে পরের দিন পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে