Views Bangladesh Logo

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

ন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রথমে যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তার মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও ছিল। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করে জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের নিমিত্তে ৩ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারের ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, তার মতে সংস্কার ভাবনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। দেশের জনগোষ্ঠীর প্রত্যেক নাগরিককে দৃঢ়তার সঙ্গে সংস্কারের এই মহাযজ্ঞে আনন্দের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে জনগণকে এগিয়ে আসতেও আহ্বান জানিয়েছেন।

সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন কতগুলো ক্ষেত্রে প্রায় একই সুপারিশ করেছে- দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, কেউ দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের মতো দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্টও হওয়া যাবে না, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার হবেন বিরোধী দল থেকে, কেউ একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং দলীয় প্রধান হতে পারবেন না, ৪০০ আসন বিশিষ্ট নিম্নকক্ষের ১০০টি আসন মহিলাদের জন্য নির্ধারিত থাকবে এবং প্রার্থী হতে পারবে শুধু মহিলারা, তারা নির্বাচিত হবেন জনগণের সরাসরি ভোটে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব মতে উচ্চ কক্ষের সদস্য সংখ্যা হবে ১০০, অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে ১০৫। নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দানের জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের মতো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ করেছে। লোকবল নিয়োগে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সাংবিধানিক কাউন্সিলের পক্ষেও সম্ভব হবে বলে হয় না। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা রাজতন্ত্রের মতো একটি পরিবারের আধিপত্যে পরিচালিত; পরিবারতন্ত্রে জনগণের অন্ধ ভক্তি এই আধিপত্য বজায় রাখার প্রধান শক্তি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠজন, যোগ্যতা বিচারের কোনো মাপকাঠি বিচার্য ছিল না।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন একটি নতুন আইডিয়ার সুপারিশ করেছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হবেন নির্দলীয়, সৎ, যোগ্য এবং সুনামসম্পন্ন ব্যক্তি। নির্দলীয় মানে কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া যাবে না। তবে এমন শর্ত দিয়ে দলনিরপেক্ষ লোক বেছে নেয়া কঠিন। বিসিএস ক্যাডার, শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, ব্যাংকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে ইতোমধ্যে যতটুকু দলীয় আনুগত্যের সৃষ্টি হয়েছে ততটুকু দলীয় আনুগত্য অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর মধ্যেও নেই। বর্তমান সুশীল সমাজও তাদের আনুগত্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে সমর্পণ করে দিয়েছে। শিশু আর পাগল ছাড়া নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই- খালেদা জিয়ার এই কথাটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। তাই নির্দলীয় প্রেসিডেন্ট পাওয়া গেলেও নিরপেক্ষ প্রেসিডেন্ট পাওয়া যাবে না, পাওয়া গেলেও তাকে প্রেসিডেন্ট করা হবে না।

কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট আগের মতো শুধু সাংসদ দ্বারা নির্বাচিত হবেন না, ভোট দেবেন সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও। আইয়ুব খানও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বারদের ভোটে, বিডি মেম্বারদের ভোট কিনে আইয়ুব খান পাকিস্তানের জাতির পিতা মহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে; কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত মেম্বাররা ভোট দিলেন আইয়ুব খানকে। পাকিস্তানের আইয়ুব খানের সৃষ্ট অবস্থার উদ্ভব হলে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীগণও কমিশনের কথিত ‘টাকার খেলায়’ মেতে ওঠতে পারেন। কমিশন ‘না-ভোট’ পুনরায় ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছ; অর্থাৎ ভোটার ইচ্ছে করলে ‘না ভোট’ ভোটের বাক্সে ফেলতে পারবে। ‘না-ভোট’ দেশে প্রথম চালু করে ড. এ টি এম শামছুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ২০০৯ সনে আওয়ামী লীগ সরকার ‘না-ভোট’-এর বিধান বাতিল করে দেয়। সম্ভবত বিএনপিও ‘না-ভোট’-এর আবশ্যকতা স্বীকার করে না। জিয়াউর রহমানের ‘হাঁ-না’ ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়, নির্বাচনে ‘না’ ভোটের গুরুত্ব একেবারেই নেই। কারণ ‘না-ভোট’ দেয়ার জন্য কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ১৯৭৭ সনে অনুষ্ঠিত গণভোটে জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘হা-ভোট’ পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ‘না-ভোট’ ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ।

কাউন্সিলর বা মেম্বার, মেয়র, চেয়ারম্যান ইত্যাদি পদে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার সুপারিশ করেছে কমিশন। ২০১৫ সনে দলীয় প্রতীক নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নিয়ম চালু করে আওয়ামী লীগ সরকার, তারাই আবার এই নিয়ম বাতিলের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে স্থানীয় সরকারগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশরা চৌকিদারি আইন প্রবর্তন করে। ষাটের দশকে বা তার পূর্বে যাদের জন্ম তারাও গভীর রাতে চৌকিদারের ‘হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার’ হাঁকডাক শুনেছেন। তখন ছিল শুধু ইউনিয়ন পরিষদ, এই পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সবাই ছিলেন সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তি। জিয়াউর রহমান চালু করেছিলেন ‘গ্রাম সরকার’ যা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন- এইসব এসেছে অনেক পরে। এই সকল স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়ন ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদন করা হয়। কিন্তু দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে দলনিরপেক্ষ সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অবশ্য এই বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তিনিও দলনিরপেক্ষ নন। অবশ্য দলীয় ব্যক্তি মাত্রই অপাঙ্তেয় নয়, অপাঙক্তেয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন ব্যক্তির পক্ষপাতমূলক আচরণ। আমাদের দেশের লোকজন এতবেশি দলকানা যে, দলীয় প্রতীক না রাখলেও নির্বাচনে সমর্থন ও প্রচার দলীয় ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। তাই সংস্কার যতই করা হোক না কেন, সমাজসেবক, জনদরদী, মান্যগণ্য লোক যাদের দলমত নির্বিশেষে মানুষ ভালোবাসে তারা এখন আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) পদ্ধতি বাতিল ও একটি নিরাপদ অনলাইন ভোটিং সিস্টেম প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছে। তবে ইভিএম নিয়ে যেভাবে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, অনলাইন ভোটিং সিস্টেম প্রবর্তন নিয়েও একই অবস্থার উদ্ভব হতে পারে। বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে চালু করার উদ্যোগ নেয়া হলেও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় কোন সরকারের এক টার্মে তা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। পরবর্তী টার্মে ভিন্ন দল ক্ষমতায় এলে অব্যবহিত পূর্ববর্তী সরকারের সব প্রকল্প বাদ দিয়ে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করবে। সংস্কার কমিশনের ইভিএম পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ প্রত্যাশিত, কারণ কমিশনের প্রধান বিগত দিনগুলোতে এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ছাপানো কাগজের ব্যালটপেপারে ভোট দেওয়ার আদিম রীতি অক্ষুণ্ন রাখার একটা জেদ দীর্ঘদিন যাবত রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খেয়েছে; কিন্তু প্রযুক্তিকে অবহেলা করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। কোটি কোটি ব্যালটপেপার মুদ্রণ ও সরবরাহ করার প্রাচীন পদ্ধতি আজ না হলেও এক সময় বন্ধ হবেই। তাই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন বা অনলাইন ভোটিং পদ্ধতি দ্রুত চালু করার ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক।

বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব তহবিল ও লোকবল নেই, প্রতিটি জেলায় রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসকরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন জেলা প্রশাসকের স্থলে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। এজন্য লোক নিয়োগ দিতে হবে। তবে লোকের পরিবর্তন হলেই যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের মতো লোক দরকার। টি এন সেশন খুব ধার্মিক ছিলেন, তারপরও কর্মের নিরপেক্ষ পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তিনি প্রথম দিনই অফিস কক্ষ থেকে সকল দেব-দেবীর ছবি ও মূর্তি সরিয়ে দেন; তার পূর্বসূরি পেরি শাস্ত্রী মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের দপ্তরে অনেক দেব-দেবীর ছবি রেখেছিলেন। টি এন সেশন স্পষ্ট করে ভারত সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি ভারত সরকারের অংশ নন। যতদিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরকার মান্যতা দিচ্ছে, ততদিন দেশে কোনো নির্বাচন হবে না- এমন একটি নির্দেশনাও ১৯৯৩ সনে টি এন সেশন জারি করেছিলেন। তাই কাগজে-কলমে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আইনকানুন, নিয়মনীতির সংস্কার করলেই সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে সংস্কার কমিশনের সদস্যদেরও নিরপেক্ষ হতে হবে; দ্বিতীয় পর্বে তা লেখার আশা রাখছি।

সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ