নাগরিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে এমন ঘটনাকে প্রতিহত করুন
‘ওই থামেন, থামেন... থামতে বললাম না তোরে!’ ‘কি হয়েছে ভাই?’ লোকটার অবাক প্রশ্ন। এত রূঢ়ভাবে থামতে বলা কণ্ঠের দিকে ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্নটা করতেই লোকটা দেখল, হাতে লাঠি নিয়ে একটি ছেলে তেড়ে আসছে। তার পেছনে আরও কয়েকজন। তারা কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল, ‘কই যান আপনি?’ প্রশ্ন শুনে লোকটা আরও অবাক। এরা কারা যে তাকে এ ধরনের প্রশ্ন করার। সে তাই বলল, ‘আপনারা কারা? আমি যেখানেই যাই, আপনাদের কি?’ এভাবে তাদের প্রশ্ন করাটা পছন্দ হয়নি তাদের। গালাগাল করল, কলার ধরে শাসাল তারা লোকটাকে। বলল, ‘আমরা সরকারি দলের লোক। ছাত্রলীগ আমরা। ফোন কই তোর? ফোন দেখা!’ এটা বলেই একজন আমার পকেট থেকে আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিল। প্রতিবাদ করতে গেলে আরও শাসানো হলো, গায়েও হাত তোলা হলো লোকটার। তারপর একজন তার মোবাইল হাতে নিয়ে বলল, ‘লক ওপেন কর! তুই কোটা আন্দোলনকারী! তুই আন্দোলনের সঙ্গে কি না সেটা তোর মোবাইল দেখলেই জানা যাবে।’
উপরোল্লিখিত ঘটনার মতো আরও অনেক ঘটনা ঘটে গত জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। এই ঘটনাগুলোতে কারা দোষী আর কারা অন্যায়ের শিকার সেটা পরিষ্কার; কিন্তু গত ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি এলাকাতে অনেক মানুষ একই ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে, অনেককে অত্যন্ত বাজেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। বয়স্ক লোকজনদের কানে ধরে ওঠবস করানো, একজনকে প্রায় দিগম্বর করে নাচতে বাধ্য করা, এসবই, এবং আরও অনেক বাজে আচরণের উদ্রেক করা হয়েছিল। মেয়েরাও হেনস্তা হওয়ার থেকে রেহাই পায়নি। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যে কারণে মানুষ জমায়েত হয়েছিল সেটা বাস্তবায়নের জন্য এত নোংরামিতে নিমজ্জিত হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। জমায়েত লোকজন সহজে, সমাদরেই সবাইকে ফিরিয়ে দিতে পারত; কিন্তু সেটা করেনি তারা। বিবেক, বুদ্ধি, সৌজন্যতা, এসবের জলাঞ্জলি দিয়ে সেখানে জমায়েত হওয়া মানুষগুলো অনুচিত আচরণের নিম্নতম স্তরকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে যেন।
আমার এক বন্ধু তার মায়ের সঙ্গে গাড়িতে করে ধানমন্ডি এলাকা পার হওয়ার সময় তাদের গাড়ি থামিয়ে গাড়ি চেক করার দাবি জানানো হয়। ফোনও চেক করার কথা বলা হয়। আমার বন্ধু উপরোল্লিখিত ছাত্রলীগের অন্যায় আচরণের শিকার ব্যক্তির মতো তাদের দাবির ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলে ওপাশ থেকে উত্তর আসে, ‘আমরা ছাত্র’। উত্তর থেকে শুধু ‘লীগ’ শব্দটাই গায়েব হয়েছে। বাকি সবই তো একই।
জনগণের প্রাইভেসি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সম্ভ্রম, সম্মানসহ আরও অনেক কিছুই আজ ছাত্রলীগের মতোই ধানমন্ডিতে জমায়েত হওয়া যুবসমাজের একটি অংশ একেবারে নস্যাৎ করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের এই আচরণের যতই সমালোচনা হয়েছে ততই কম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়করা উপরোল্লিখিত আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন। এ ধরনের আচরণ যে কাম্য নয়, সেটা উল্লেখ করে তারা এমন আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন; কিন্তু, তাদের বক্তব্যগুলো আমার মতে একটু দেরিতেই এসেছে। ধানমন্ডিতে চলমান ত্রাস সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলমান ছিল। গণমাধ্যমে তাদের বক্তব্যের খবর বের হয় সন্ধ্যা নাগাদ। তাদের যোগাযোগ মাধ্যমে তারা হয়তো তাদের বক্তব্য তার দু-এক ঘণ্টা আগে তুলে ধরেন। যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে এত প্রশংসনীয় ও কাযকরি একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা ছাত্রসমাজ সারা দিনব্যাপী এমন জঘন্য আচরণের কোনো খবর পায়নি, সেটা মানতে নারাজ আমি। আর যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে বিষয়টার প্রতি অন্তত একটা মৌন সমথন ছিল আমাদের ছাত্র সমাজের এমনটা ধারণা করা কি খুব ভুল হবে?
দুঃখজনক হলো, আমার বন্ধুর কাছে তার অভিজ্ঞতা শোনার পর এ বিষয়ে এই লেখাটা প্রস্তুতকালীন এক সাংবাদিক বন্ধুকেও ফোন দেই। জানার জন্য যে লেখাটা কতক্ষণের মধ্যে দিলে কালকের পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে। স্বনামধন্য পত্রিকার অভিজ্ঞ সাংবাদিক বন্ধু বলল, ছাত্রদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো সমালোচনা মনে হয় না তার পত্রিকায় ছাপা সম্ভব হবে। কারণ, ছাত্ররা না কি অফিসে এসে পুরো অফিস শাসায়। গণ্ডগোল, হইচই করে। পরিস্থিতি সামলানো না কি কঠিন হয়ে যায় তাদের জন্য। তাহলে তো পরিবর্তন কেবল গদিতেই হয়েছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি সরকার ও সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা বলেছে। ধানমন্ডির মতো ঘটনার উদাহরণ আরও সামনে আসলে, তাদের এমনটা করার স্পৃহা ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন আসবে। যে সরকারকে উৎপাটন করে এই নতুন সরকার এসেছে, তারাও নিজের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, এমনকি সেগুলো ন্যায্য বলেই আখ্যা দিয়ে অন্যদের মানবাধিকার, ভুল-ত্রুটি নিয়েই পড়ে থাকতো। তাদের কুকর্মের বিচার অবশ্যই হতে হবে। অত্যাবশকীয় সেটা! কিন্তু তাই বলে, এই সরকারের আমলে ছাত্র ও যুবসমাজের অংশ বলে অন্যরা যাচ্ছেতাই আচরণ করলে, পাথক্যটা হলো কোথায়?
অনেকে জানিয়েছে যে ধানমন্ডিতে যে ছাত্র, যুবকরা এ আচরণ করেছে তারা ছাত্রদলের সদস্য। তাদের না কি বিএনপি, ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট স্লোগান দিতে শোনা গিয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হয় বিএনপি রাজনীতির বির্বতন ও জনগণ, বিশেষ করে নিরপেক্ষ ছাত্র ও যুবসমাজের মনস্তাত্বিকই ধরতে পারেনি এখনো। তারা এখনো ক্ষমতায় ফিরে আসার লালসাতেই মত্ত। কয়েক বছর আগে, সংসদের এক অধিবেশনে বিএনপির এক নারী সাংসদকে তার বক্তব্য শুরু করার আগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শুনি। তখন, ক্ষমতাসীন দলের সাংসদরা তাদের স্বভাবসুলভ আচরণে চিৎকার করে তাকে থামতে বাধ্য করে। সংসদের স্পিকারও বিষয়টা নিয়ে কিছু না বলায়, বিএনপির মহিলা সাংসদকে বাধ্য হয়ে বলতে হয় যে আওয়ামী লীগ তাদের নেতার কথা বলবে, সম্মান প্রদর্শন করবে, আর আমরা আমাদের নেতার প্রতি সেটা করব। বক্তব্যটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় ছিল; কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটা ধোপে টেকেনি, বলতেই হয়।
আজ আমাদের ছাত্ররা, অনেকের কাছে অসম্ভবপর মনে হওয়াকেই সম্ভবপর করেছে। আজকে তারা রাজনৈতিক সংস্কারের এই পথযাত্রা আরম্ভ না করলে, হয়তো এভাবে অকপটে একটি সমালোচনামূলক লেখা লিখতেই পারতাম না। প্রকাশ হওয়া তো দূরের কথা; কিন্তু এই সমালোচনা আওতায় যে সবাইকেই আসতে হবে, সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই ‘সবাই’ শব্দটার মধ্যে কেউ বাদ যাবে না, এমনই গঠনমূলক সমালোচনার অধিকারবিশিষ্ট বাকস্বাধীনতা দেখতে চায় সবাই। যে ছাত্ররা তাদের জীবন বাজি রেখে সেটা করেছে, তারাও হয়তো তাই চেয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার প্রলোভন কিংবা মত্ততায় তারাও কিংবা তাদের একাংশ যে অযাচিত ও অবাঞ্ছিতদেরই আরেক সংস্করণে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যে রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে আমরা আজকের নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছি, সেই রক্তের প্রতি অসম্মান দেখানোই হচ্ছে।
রক্তক্ষয়ী বিপ্লবী দিনগুলোর পর, রাস্তায় ছাত্রদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের স্পৃহা দেখে মনে হয়েছিল যে, এবার হয়তো দেশের দৈনন্দিন সবচেয়ে বড় সমস্যার এক দীঘস্থায়ী সমাধান হবে। ছাত্ররা ধীরে ধীরে রাস্তা ছেড়ে ট্রাফিক পুলিশদের হাতে দায়িত্ব ন্যাস্ত করেছে। আর এখনই ট্রাফিক নিয়মের লঙ্ঘন শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি নিজে এর সাক্ষী। অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক সাভিস আজকে ব্যবহার করতে গিয়েই দেখি, আমার রাইডার যেখানে সম্ভব ট্রাফিক লঙ্ঘন করছে। চারদিকে ছাত্রদের কাউকে ডেকে বিষয়টা বলার সুযোগ ছিল না। ছাত্ররা তখন রাস্তায় নেই। তারা যখন ছিল, অনেকটাই নিরাপদ মনে হয়েছিল নিজেকে; কিন্তু আজ সেই অনুভূতিটা পাইনি। ট্রাফিকের মতো, আমাদের আপামর ছাত্র ও যুবসমাজের আচরণেও কি আমি একই ধরনের নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করবো সামনের দিনে। ধানমন্ডিতে অতিবাহিত ঘটনাবলি দেখে আমার তাই ভয় হচ্ছে। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতার উৎসই হলো বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র ও যুবসমাজ। এর মধ্যে ছাত্রদল, ও অন্যান্য দলের ছাত্রগোষ্ঠীও অন্তভূক্ত। দলীয় বিচারে প্রতিশোধপরায়ণতা উদ্ধৃত কুআচরণ শুধু তাদেরই নয়, তাদের মূল দলের গ্রহণযোগ্যতাও হ্রাস করবে। দলগুলোর রাজনৈতিক মনস্তত্ব যে এখনো সেই প্রতিশোধপরায়ণ, ক্ষমতার লালসা ও অপব্যবহারের প্রতি নিবদ্ধ, তাদের ছাত্র গোষ্ঠীর আচরণ সেটাই প্রমাণ করছে কেবল।
বিএনপিভুক্ত ছাত্রদল ১৪ আগস্ট রাতে মহড়া করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এসে জমায়েত করার একটি ভিডিওচিত্র মাত্র হাতে আসলো। লেখাটা লিখতে লিখতেই এক বন্ধু সেটা পাঠালো। দেখে মনে হলো, এ তো সেই বাংলাদেশই যে বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এই তো সেই দলই, সেই যুবকসমাজই যাদেরকে আমরা ভয় পেতাম, যাদের এড়িয়ে যেতাম, যাদের অবাঞ্ছিতই মনে করতাম। ছাত্রদের কল্যাণে আজ অন্তত এটা বলতে পারছি; কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমনই থাকে, তাহলে লীগ থেকে বিষয়টা দল, এই পরিবর্তনটুকুই হবে। আর কিছুই নয়। তাই বিএনপি’র উচিত নিজের রাজনৈতিক প্রাধিকার পুনবিবেচনা করা। অন্তত বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতাদের প্রতি এটাই অনুরোধ থাকবে। পাশাপাশি, বৈষম্যবিরোধি সমন্বয়কদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন নিজেরা, এবং তাদের বিপ্লবী সদস্যদের বোঝায়, ক্ষমতা আর কতৃত্বের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। যেটা উপলব্ধি করা এবং সে অনুযায়ী সৌজন্যতার গন্ডিতে থেকে আচরণ করা অত্যাবশকীয়। আমি নিজেও শিক্ষকতা করি। আমার প্রত্যক্ষ ছাত্ররাও এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা এবং তাদের মতো সকল ছাত্র ও যুবসমাজের কৃতকাজের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এমনটা তোমাদের কাছে কাম্য নয়।
সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে