ত্রাণ কার্যক্রমে মানুষের সম্মানের প্রতি খেয়াল রাখা জরুরি
বলা হয় বিপদের সময় বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ- যার সাম্প্রতিক উদাহরণ বন্যার্তদের সহায়তায় ত্রাণ কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যে পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ নিয়ে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ জড়ো হয়েছেন, সেটি অভাবনীয়। আর এই কাজে যে শিক্ষার্থীরা সমন্বয় করছেন, তারাই কিছুদিন আগে একটি গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অসংখ্য ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও মাইক্রোবাসে করে এসব ত্রাণ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুর্গত এলাকায়।
গত ২১ আগস্ট দেশে আকস্মিক বন্যার শুরু থেকেই দুর্গম এলাকা থেকে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা ধরনের মানবিক কাজ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ সর্বস্তরের মানুষজন করে আসছে। দিনমজুর-রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা বয়স, শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ে ছুটে আসছেন। সবার হাতে চাল, ডাল, আলু, তেল, খাবার স্যালাইন, লবণ, বিশুদ্ধ পানি, খেজুর, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটসহ নানা ধরনের শুকনো খাবার।
রয়েছে নগদ টাকা, কাপড়-চোপড়, লাইফ জ্যাকেট, শিশুখাদ্য, পশুপাখির খাদ্য, ওষুধ, স্যানিটারি প্যাডসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই। বিভিন্ন দুর্যোগে ঢাবি শিক্ষার্থীরা অনেকবার ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন; কিন্তু এবারের মতো বড় আয়োজন এর আগে কখনো দেখা যায়নি। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার ও সহায়তায় বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও কাজ করছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনও তৎপর। তবে দুর্যোগের সময় ত্রাণ কার্যক্রমে একটা বড় সমস্যা হয় সমন্বয়হীনতা এবং দুর্গম এলাকার মানুষের কাছে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পৌঁছাতে না পারা।
২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় প্রায় তিন সপ্তাহ উপকূলের দুর্গত এলাকায় সংবাদ কাভার করতে গিয়ে দেখেছি, ঘটনার দুই-তিন দিন পরেও অনেকে সহায়তা পাননি। মুশকিল হয়, যারা ত্রাণ দিতে যান তারা শহরের আশপাশে বা যেসব জায়গায় যাওয়া সহজ, সেসব জায়গায় ত্রাণ দিয়ে ফিরে আসেন। তাতে অনেকে একাধিকবার ত্রাণ পান। অনেকে বাদ পড়েন। আবার সব সময় সব জায়গায় একই ধরনের সহায়তার প্রয়োজন থাকে না। যেমন তাৎক্ষণিকভাবে খাবার খুব জরুরি। আবার বন্যার মতো পরিস্থিতিতে মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়ায় যেহেতু রান্না করার উপায় থাকে না, ফলে শুকনো খাবারের চাহিদা বেশি থাকে। মানুষের পোশাক-আশাক নষ্ট হয়ে যায়। বানের জলে ভেসে যায়। ভিজে যায়। ফলে এই সময়ে সব বয়সী মানুষের জন্য পোশাক নিয়ে যেতে হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ থাকে না। ফলে নারীদের জন্য সেনিটারি প্যাডেরও চাহিদা থাকে। এবারের ত্রাণ কার্যক্রমে প্রচুর মানুষ স্যানিটারি প্যাড ত্রাণ সহায়তা হিসেবে নিয়ে গেছেন, এটা বেশি প্রশংসনীয়। আবার অসুস্থ, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস ও প্রেশারের মতো অসুখ আছে; যাদের নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হয়, রক্তে চিনি পরীক্ষা করতে হয়, তাদের জন্য এসব সামগ্রী ও ওষুধও নিয়ে যেতে হয়। অর্থাৎ ত্রাণসামগ্রী মানেই খেজুর, বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি কিংবা কাপড় নয়, বরং এর বাইরে আরও অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়। আশার কথা হলো, এবারের বন্যায় যারা ত্রাণ সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন, তাদের অনেকেই এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেছেন; কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো সবার কাছে সময়মতো খাবার, পোশাক ও ওষুধ পৌঁছানো।
সিডরের সময়ে দেখেছি অনেকে বলেছেন ‘ত্রাণ চাই না বাঁধ দেন’। অর্থাৎ ত্রাণ তাদের সাময়িকভাবে রক্ষা করবে; কিন্তু নদী পাড়ে টেকসই বাঁধ না থাকায় যাদের ঘরবাড়ি বানের তোড়ে ভেসে গেছে; যাদের জমির ফসল তলিয়ে গেছে; যাদের গবাদি পশু গাছের পাতার মতো ভেসে গেছে- তাদের কাছে একটা টেকসই বাঁধ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বাঁধ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। বাঁধের নির্মাণ কাজ এবং সংস্কারের নামে শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও সেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বেশ পুরোনো। ফলে প্রতি বছর বন্যার সময় এই একই আলোচনা সামনে আসে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আত্মপ্রচারের যুগে অনেক ভালো কাজ কিছু কিছু ঘটনায় প্রশ্নের মুখে পড়ে। যেমন অনেকেই এই সময়ে ত্রাণ দেয়ার নামে নিজেদের প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ত্রাণ দেয়ার চেয়ে এর ছবি তুলে বা ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিতে তারা বেশি আগ্রহী। মিউজিক কম্পোজার তানভীর তারেক রোববার (২৫ আগস্ট) দুপুরে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, টিএসসিতে ত্রাণসামগ্রী দিতে গিয়ে দেখেছেন হ্যান্ড মাইকে একজন তরুণ বলছেন, যারা বিনা প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে আছেন, ছবি তুলছেন বা ভিডিও করছেন, তারাই প্রকৃত হাউন আঙ্কেল।
তানভীর তারেক লিখেছেন, ত্রাণ রেকর্ড পরিমাণ সংগ্রহ হচ্ছে; কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থায় গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকের জন্য অপেক্ষা। প্ল্যানিংয়ে দ্বিধা! ফেনীর কুমিল্লার কিছু জায়গায় অনেকেই ভিড় করছেন। কেউ কেউ মিডিয়া ও ইউটিউবারের ক্যামেরার ভিড় যেখানে, সেখানে ত্রাণ বিতরণের মহড়া করছেন। অনলাইনে কয়েকটা গ্রুপে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রায় ৮০ শতাংশ অভিযোগকারী বলেছেন, ফেনীর সোনাগাজী ইউনিয়ন-দৌলতকান্দি গ্রামে সবচেয়ে কম ত্রাণ গেছে। সেখানে অনেক মানুষ আটকে আছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বললেন, ত্রাণ আসছে পর্যাপ্ত। সংকট মূলত ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল ও পরিকল্পনায়। এসব পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতা থাকে এনজিওর, রেড ক্রিসেন্ট, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের টিমের; কিন্তু কোনো চ্যানেলে তাদের বক্তব্য নির্দেশনা নেই বা একেবারেই কম।
অর্থাৎ ত্রাণ কার্যক্রমে একটা বড় চ্যালেঞ্জ সমন্বয়সাধন। যারা ত্রাণ নিয়ে যান তারা নিশ্চয়ই একটা মহৎ উদ্দেশ্য থেকে এই কাজটি করেন। কিন্তু সমন্বয় না থাকায় কেউ কেউ একাধিকবার সহায়তা পেলেও অনেকেই বাদ পড়ে যান। সেজন্য স্থানীয়ভাবে প্রতিটি উপজেলায় যদি স্থানীয় প্রশাসন বিষয়গুলো সমন্বয় করে এবং দূরবর্তী তথা দুর্গম এলাকার মানুষকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখে, তাহলে কাজটা সহজ হয়।
মনে রাখা দরকার, আজকে যিনি ত্রাণ সহায়তা নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন বা ছাদে উঠে এসেছেন যাতে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেয়া একটি খাবারের প্যাকেট পাওয়ার আশায়, এক সপ্তাহ আগেও হয়তো তার ঘরে খাবারের অভাব ছিল না। হয়তো মাছ মাংস সবজি ও ফল দিয়ে তার ফ্রিজ ভরা ছিল; কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তার সবই ভেসে গেছে। এখন অন্যের বাড়িতে কিংবা কোনো স্কুলের দোতলায় আশ্রয় নিয়েছেন।
বন্যার পানি নেমে গেলে তিনি নিশ্চয়ই আবার ঘুরে দাঁড়াবেন। ঘরের যেসব আসবাব নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো ঠিক করবেন। কাজে যোগ দেবেন। ব্যাগভর্তি করে বাজার নিয়ে আসবেন। অর্থাৎ এখন যে ত্রাণের জন্য তিনি হাত পাতছেন, সেটি সংকট সাময়িক। তিনি প্রকৃত অর্থে অভাবী মানুষ ছিলেন না; কিন্তু প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে তাকে এখন অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। অতএব, এই মানুষটির হাতে পাঁচশ টাকার একটা খাবারের প্যাকেট দিয়ে আপনি যদি তার ছবি তোলেন বা ভিডিও করেন, সেটি তার জন্য ব্রিবতকর হতে পারে। তিনি এই সংকটকালীন চেহারাটি গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অন্যকে দেখাতে নাও চাইতে পারেন। এরকম মানুষের সংখ্যা অনেক।
মনে রাখতে হবে, এই মানুষগুলো একটি কঠিন সময় পার করছেন। একদিকে তাদের ঘরবাড়ির যাবতীয় জিনিসপত্র ভেসে গেছে। সহায় সম্পদের দারুণ ক্ষতি হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। কেউ আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে একটা দারুণ ট্রমার ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছেন। এরকম একটি অতি সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে তাদের ছবি না তোলাই ভালো। গণমাধ্যমের কর্মীরা তাদের সংবাদের প্রয়োজনে যতটা সম্ভব দূর থেকে এই মানুষগুলোর ছবি তুললে ভালো। কেননা অনেকেই হয়তো এই সংকটকালে ত্রাণ গ্রহণের সংবাদের ভেতরে নিজের চেহারাটা দেখতে চান না। দেখাতে চান না। প্রত্যেকেরেই আত্মসম্মানবোধ আছে। সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর ও সঞ্চালক, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে