রোকেয়ার ভাবনা আজকের পৃথিবীতে জেন্ডার সমতার সূত্র
বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ‘বেগম রোকেয়া’ নামে পরিচিত হলেও তার প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন, যিনি বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় মুসলিম নারী জাগরণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত। কোনোরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, সম্পূর্ণ প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশে, তিনি যেভাবে নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তির জন্য কাজ করেছেন, তা গোটা বিশ্বে বিরল। ‘লতা যেমন আপনিই আলোকের দিকে উন্মুখ হইয়া থাকে, যতই বাধা পাক এই নারীর জীবনে তেমনি সত্য ও সুন্দরের প্রতি একটি অনিবার্য প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।’ রোকেয়া প্রসঙ্গে এসব কথা লিখেছিলেন মোহিতলাল মজুমদার।
রংপুর জেলার পায়রাবন্দে সম্ভ্রান্ত এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণকারী বেগম রোকেয়া বেঁচেছিলেন মাত্র ৫২ বছর। তার ব্যক্তিজীবন খুব একটা সুখের ছিল না। কঠোর রক্ষণশীল পরিবেশে পর্দার মধ্যে শৈশব অতিবাহিত করার পর ষোলো বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুর নিবাসী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। বাবার সংসারে থাকাকালে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে রোকেয়া কুসংস্কার আর ধর্মান্ধ সমাজকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর পৃষ্ঠপোষকতায় রোকেয়া পড়ালেখায় নিজেকে আরও বেশি মনোযোগী করেন এবং লেখালেখির কাজ শুরু করেন। স্বামীর সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ছিল ২৬ বছর। বিয়ের ৯ বছর পর স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। খুব অল্পবয়সে তিনি তার দুই সন্তানকেও হারান। এরপর থেকে ২৩টি বছর রোকেয়াকে একাকী জীবনযাপন করতে হয়।
বেগম রোকেয়া আভিজাত্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেও ব্যক্তিজীবনে খুব একটা সুখ ভোগ করতে পারেননি। বৈরী পরিবেশে বেদনায় জর্জরিত তার নিঃসঙ্গ জীবন যে কষ্টের ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না; কিন্তু কর্তব্যের পথ থেকে তিনি কখনো সরে দাঁড়াননি। বুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও নিবেদিত প্রচেষ্টায় তিনি সমাজ সংস্কারক হিসেবে অপরিমেয় ভূমিকা পালন করেন। তার সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের মধ্যে কোমল আর কঠিনের সংমিশ্রণ, আত্মত্যাগ ও পরার্থপরতার দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়।
বাংলার জাগরণে মুসলিম সমাজের অর্ধাংশের নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম রোকেয়া। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলার মুসলমানদের যে অংশের মধ্যে উদার মানবিক প্রভাব অনুভূত হয়েছিল তাদেরই অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। রামমোহন রায়ের যুক্তিবাদ ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদ রোকেয়াকে প্রভাবিত করেছিল। তার তীক্ষ্ণ লেখনীর মাধ্যমে প্রগতিশীল ভাবধারা প্রচার করে বাঙালি মুসলমান সমাজে নারীর প্রতি যে অবমাননা চলছিল তার বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন।
তিনি নারী সমাজের কল্যাণে সামাজিক কুসংস্কার দূর করার জন্য এবং নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। রোকেয়া স্বামীর মৃত্যুর পর শোকে আচ্ছন্ন থাকেননি। শোককে বুকে নিয়েই তিনি মাত্র পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরের খলিফাবাগে শুরু করেছিলেন প্রথম সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়। বিভাষী অঞ্চলে প্রতিকূল অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে তিনি দুঃসাহসিক কাজ শুরু করেন। স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা ও জামাতার চক্রান্তে এমন পরিস্থিতি হয় যে, তাকে মিশনারিদের চর বদনাম দেয়—যাতে রোকেয়ার বালিকা বিদ্যালয়ের স্বপ্ন ব্যাহত হয়। তৎকালীন কর্মরত ভাগলপুরের বাঙালি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্যে রোকেয়া তার ছোট বোন হোসায়েরাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
অনিশ্চয়তার পথে ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় এসে ১৯১০ সালে তিনি আবার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে দুখানা বেঞ্চ আর আটজন ছাত্রী নিয়ে পাঠদান শুরু করেন। ছাত্রী সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করেছেন। কলকাতার মতো বৃহৎ শহরে পরিচয়হীন মুসলিম নারীর পক্ষে সে কাজ বড় কঠিন ছিল। তার সম্বল ছিল স্বামীর দেওয়া ১০ হাজার টাকা মাত্র। কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ব্রিটিশ খ্যাতনামা ব্যক্তিদের কারও নামের সঙ্গে মিলিয়ে নামকরণ করতে বলেন—তাহলে ইংরেজ সরকারের সাহায্য পাওয়া যাবে; কিন্তু রোকেয়া সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
সমাজের দুর্বল নারীদের মধ্যে দুর্বলতম হলো মুসলিম নারী সমাজ। তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে মুসলিম নারীদের সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়। নারীদের স্বাবলম্বী ও স্বনির্ভর করে তোলা ছিল এই সংগঠনের প্রধান লক্ষ্য।
বিশ শতকের শুরুতে নারীর সার্বিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়, আর এ পরিবর্তনে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি উপলব্ধি করেন শিক্ষা ছাড়া বাঙালি নারীর দুর্ভোগ মোচন সম্ভব নয়। সে লক্ষ্যে তিনি শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছেলেমেয়েদের সমমানের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা সমাজের কাছে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। তিনি লেখনীর মাধ্যমে নারীসমাজের তৎকালীন সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে তাদের সেই দুরবস্থা থেকে উত্তোরণের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মতিচূর, পদ্মরাগ, সুলতানার স্বপ্নসহ সব রচনায় নারী-পুরুষের অসম অবস্থান, নারীর ওপর পুরুষ ও সমাজের অত্যাচার, পর্দাপ্রথার নামে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি কারণে বাঙালি পরিবার ও সমাজে নারী যে অধস্তন হয়ে পড়ছে, তা সুনিপুণভাবে তুলে ধরেন।
আবার বাস্তবতা মেনে নিয়ে তিনি পিছিয়ে পড়া নারীর সার্বিক উন্নয়নে পুরুষের সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়েছেন। কেননা দীর্ঘদিন ধরে বাংলায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় সমাজের পুরুষ এগিয়ে না এলে নারীর সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব নয় বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। রোকেয়া দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি নারীর মন-মানসিকতার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা লক্ষ্য করে তাদের সনাতন চিন্তা-চেতনা থেকে নিজেকে মুক্ত করে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মনে করতেন, নারীদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকতে হবে, যাতে তাদের মানসিকতা প্রশস্ত হয় এবং আধুনিক ভাবধারা গ্রহণ করার শিক্ষা পায়। ধর্মের প্রতি মানবজাতি স্বভাবতই দুর্বল। ফলে যুগে যুগে পুরুষজাতি ধর্মকে নারী শাসনের হাতিয়াররূপে ব্যবহার করে আসছে।
ধর্মের নামে পুরুষসমাজ নারীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে নারীর ওপর প্রভুত্ব করে চলেছে। এরূপ অন্যায় নারীর সহ্য করা উচিত নয় মর্মে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। সমাজে প্রচলিত ধর্মের নামে পর্দাপ্রথার দোহাই দিয়ে নারীকে ঘরের কোণে বন্দি করে রাখার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অন্যদিকে তিনি লেখাপড়া শিখে নারীর অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর জোর তাগিদ প্রদান করেছেন। তেমনি অর্থ উপার্জন করা যে নারীমুক্তির অন্যতম সূচক তা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তিনি নারীকে পায়ের নিচে শক্তি দেয়ার জন্য অর্থনৈতিক ভিত তৈরির ব্যবস্থা করেছিলেন।
বেগম রোকেয়া মানবজাতির অর্ধেক অঙ্গ নারীসমাজকে ‘অচেতন’ না হয়ে জ্ঞানের আলোকে সচেতন এবং আপনবুদ্ধিতে বলীয়ান হয়ে স্বাধীন হতে আহ্বান করেছেন। সে আহ্বানকে নারীসমাজের অন্ধকার মনের আবদ্ধ কুঠুরিতে প্রবেশ করানোর সাধনায় তিনি পুরো জীবন ব্যয় করেছেন। শুধু আচ্ছন্ন বুদ্ধি নিয়ে পুরুষের হাতের পুতুলের মতো হয়ে বাঁচার মধ্যে নারী জীবনের যে অর্থহীনতা এবং অসারতা নিহিত রয়েছে, সে সত্যটি সমাজের নারী-পুরুষ উভয়কে অবহিত করানোর চেষ্টা করেছেন।
তার বিভিন্ন রচনায় নারীর অধিকার এবং পুরুষ ও নারীর যে সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি প্রবলভাবে উঠে এসেছে, তা ছিল তৎকালীন মুসলিম সমাজ সংস্কৃতির পরিবেশে খুবই বৈপ্লবিক এবং বিদ্রোহাত্মক। তিনি নারী-পুরুষের সমঅধিকারের দাবি তুলে বলেছেন, নারী-পুরুষ সমাজ দেহের দুটি চক্ষুস্বরূপ। মানুষের সব রকমের কাজকর্মের প্রয়োজনেই দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান। রোকেয়ার এ ধরনের চিন্তাভাবনা আজকের পৃথিবীতে জেন্ডার সমতার ক্ষেত্র বিশ্লেষণের মৌলিকসূত্র। জেন্ডার সমতার যে সমাজমনস্ক চিন্তা পরিব্যপ্ত হয়েছে বিশ্বজুড়ে তা কোনো তাত্ত্বিক উদ্ভাবন ছাড়াই রোকেয়া তার আপন জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় অনুধাবন করেছিলেন।
তিনি গত শতকের শুরুর দিকে যখন এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করেছিলেন তখন জেন্ডার ধারণার জ্ঞান একাডেমিক জগতে প্রবেশ করেনি। এখানেই রোকেয়ার বিশিষ্টতা। কেবল সাহিত্যকর্মে নয়, বেগম রোকেয়ার অস্তিত্বের সবটুকুজুড়েই ছিল নারীমুক্তির চিন্তা-ভাবনা। তিনি ছিলেন সদা সচেতন স্বাধীনপ্রেমী নারী। সারা জীবন লড়েছেন বোরখাপরা দুঃখিনীদের চোখ ফোটাতে। আলো ধরতে চেয়েছেন বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের চলার পথে।
১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জীবনাবসান হয়। সেদিনই ছিল তার জন্মদিন। এই বিশেষ দিনটি হোক নতুন করে রোকেয়া চর্চার মাধ্যমে আমাদের সমাজ প্রগতির লড়াইকে এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকারের দিন।
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে