সব্যসাচী হাজরার বর্ণপরিচয়
চৌদ্দ হাজার বছর আগে শুরু হওয়া যে যুগটিতে আমাদের বসবাস, তার নাম হোলোসেন যুগ। ১০ হাজার বছর আগে তুরস্কে প্রথম সৃষ্টি হওয়া গ্রামের হদিস পাওয়া যায়। ৬ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের সুমের অঞ্চলে লিপি আবিষ্কারের পর থেকে সভ্যতার সূচনা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত জাতি, যেমন ইংরেজ বা ফরাসির নিজস্ব লিপি নেই। রোমান লিপি দিয়ে লেখা হয় তাদের ভাষা। আমরা বাঙালিরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের একান্ত নিজস্ব একটি লিপি আছে। ‘পড়ে (উভয়ার্থে) পাওয়া চৌদ্দ আনার’ কদর যেমন কেউ করে না, তেমনি বাংলা লিপিও বাঙালি গবেষকদের খুব বেশি মনোযোগ পেয়েছে বলা যাবে না। ‘ভাষা আন্দোলনের দেশ’ নামে খ্যাত বাংলাদেশেও বাংলা লিপি নিয়ে খুব বেশি পুস্তক বা প্রবন্ধ রচিত হয়নি।
বেশ কিছুদিন ধরে এই অপবাদ অপনোদনের ‘গুরু’ দায়িত্ব স্বেচ্ছায় স্বস্কন্ধে তুলে নিয়েছেন এক ‘ক্ষীণকায়’ বাঙালি যুবক, নাম যার সব্যসাচী হাজরা। ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে গত ৩ মে ২০২৪ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত শ্রীমান সব্যসাচীর প্রদর্শনীটির বিষয় ছিল কমপক্ষে দুটি: ১) বাংলা প্রাইমার বা বর্ণমালা শিক্ষার বই এবং ২) বাংলা হস্তচালিত মুদ্রণযন্ত্র, ‘লেটার প্রেস’ যার নাম। প্রাইমার মুদ্রণের সময় যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতো, তার প্রায় সবই ছিল এই প্রদর্শনীতে। লেটার প্রেস সেই প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে একটি। লেটার প্রেসের পর লাইনো টাইপ, তার পর অফসেট হয়ে এখন চলছে কম্পিউটার প্রিন্টিংয়ের যুগ। বছর কুড়ি আগেও হয়তো মফস্বলে লেটার প্রেস ছিল। গত দুই দশক অব্যবহৃত থেকে এক সময় ওজনদরে বিক্রি হয়ে ফার্নেসে গলে লেটার প্রেসের মেশিনগুলো হারিয়ে গেছে।
আমাদের ভাগ্য ভালো, একটি মেশিন এবং তার মেশিনম্যান মোহম্মদ হালিমকে সব্যসাচী কোনোমতে উদ্ধার করে আনতে পেরেছেন। নীলক্ষেতের কোনো একটি গলিতে তামাদি হয়ে যাওয়া এই প্রযুক্তিটুকু নিয়ে নতুনত্ব-আক্রান্ত এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে হালিম সাহেব কীভাবে এতগুলো দশক টিকে থাকলেন, জীবনানন্দের ভাষায় বললে ‘সে এক বিস্ময়!’ প্রদর্শনী চলাকালীন হালিম সাহেব তার মেশিন চালিয়ে দেখিয়েছেন আলিয়ঁসের গ্যালারিতে। এ ছাড়া লেটার প্রেসের যাবতীয় যন্ত্রপাতিও সাজানো ছিল চোখের সামনে। সব্যসাচীও অনুসন্ধিৎসুদের দর্শকদের বুঝিয়ে বলেছেন, সীসা দিয়ে তৈরি অক্ষর কীভাবে কাটতে হয়, মুদ্রণের জন্য কীভাবে অক্ষরের পর অক্ষর সাজাতে হয়, সেই অক্ষরে কালিমা লেপন করে অবশেষে মসীলিপ্ত অক্ষর দিয়ে আনকোরা কাগজের মুখ ‘উজ্জ্বলতর’ করতে হয়। লেটার প্রেস স্বচক্ষে দেখেনি যারা, শুধু কানে শুনেছে, তাদের চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়েছে এই প্রদর্শনীতে। লেটার প্রেস এবং এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ছবি দিয়ে ভিন্ন একটি সংকলন করা গেলে সেটিও একটি চমৎকার কাজ হবে, সন্দেহ নেই। ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘আদর্শলিপি’, ‘হাসিখুশি’ ইত্যাদি প্রাইমারের একেকটি পাতা ছবির মতো সাজানো ছিল গ্যালারির দেয়ালে। ‘বর্ণমালা’ শিরোনামে প্রাইমারগুলোর একটি চমৎকারভাবে মুদ্রিত একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে। যারা সব প্রাইমার সংগ্রহে রাখতে চান, কবি প্রকাশনীর এ পুস্তকটি অবশ্যই তারা সংগ্রহ করবেন। সব্যসাচীর জন্ম নড়াইলে, শিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে অনুষদ)। ছাত্রজীবন থেকেই বাংলা বর্ণ ও বর্ণমালা তার আগ্রহের বিষয়। পেশায় তিনি শিল্পী, বিশদ করে বললে বাংলাদেশের অন্যতম সফল ও প্রধান প্রচ্ছদ-শিল্পী। বছর দুয়েক আগে বাংলা বর্ণমালা নিয়ে আরেকটি বই করেছিলেন সব্যসাচী। বইটির শিরোনাম: ‘অ’। চমৎকার ছাপা, বাঁধাই, পুস্তানী ... কী বলব, সর্বাঙ্গ-সুন্দর একটি গ্রন্থ। হাতে নিয়ে এক নজর বুলিয়েই মনে হয়, বাংলাদেশে যা দস্তুর, সেই ‘ছাপাখানা’ নয়, এটি জলজ্যান্ত একটি ‘প্রকাশনা’। বইটি নাকি ভারতের হরিয়ানায় বিখ্যাত এবং বৃহৎ একটি প্রেসে মুদ্রণ ও বাঁধাই করতে হয়েছিল, কারণ বাংলাদেশে নাকি এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে এ কাজ করা সম্ভব হতো না।
সেই বইটি এবং এবারের বইটি আদ্যন্ত পড়ে আমার যা ধারণা হলো, তা হচ্ছে এই- গবেষকেরা সাধারণত যা করে অভ্যস্ত, বাংলা বর্ণ, বর্ণমালা, কার, ফলা ইত্যাদির উদ্ভব ও বিকাশ, বিজ্ঞানসম্মতভাবে বর্ণগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বিচার ইত্যাদি সব্যসাচীর মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। তিনি আপাতত বর্ণগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে চান। আরও বিশদ করে বললে, শুধু ‘অ’ বর্ণটির মুগ্ধাবলোকনেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান তিনি। বিহগাবলোকন, সিংহাবলোকন, কীটাবলোকনসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ‘অ’ বর্ণটিকে দেখেছেন, দেখিয়েছেন সব্যসাচী ‘অ’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে। অ-তো বটেই, প্রতিটি বাংলা বর্ণই তার কাছে একটি শিল্পকর্ম, চারুকৃতি। বর্ণগুলোর সৌন্দর্য প্রাণভরে তিনি উপভোগ করেন এবং বাকি সব বাঙালিকে সেই উপভোগ, নিদেনপক্ষে অনুভব-উৎসবে শামিল করতে চান। একেকটি বর্ণের সামনে দর্শককে দাঁড় করিয়ে তিনি বলেন: ‘কী সুন্দর, তাই না!’
লিপিকরদের হাতে বিবর্তিত হয়ে ‘বাংলা বর্ণমালা’র অমূল্য সম্পদ কাকতালীয়ভাবে বাঙালি জাতির হাতে এসে পৌঁছেছে। ব্রাহ্মী বর্ণমালা থেকে যতগুলো বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাকে আমার কাছে সুচারুতম বলে মনে হয়। এই মনে হওয়াটা অবশ্যই সাবজেক্টিভ, কারণ বাংলা আমার নিজের ভাষা। বাংলা বর্ণের মধ্যে আরবি লিপির রৈখিক বক্রতা এবং রোমান লিপির রৈখিক সরলতা- এই দুইই আছে। এছাড়া আছে মাত্রা, যা এই দুই লিপির কোনোটিরই নেই। ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত একাধিক লিপি, যেমন দক্ষিণ ভারতীয় লিপিতেও মাত্রার অভাব আছে। ‘মাত্রা’ বাংলা বর্ণমালাকে দারুণ এক সুষমা দিয়েছে বলে মনে হয়। সব্যসাচী মনে করেন, মাত্রার উদ্ভবের পেছনে লিখন উপকরণের ভূমিকা আছে- তালপাতায় লেখা হতো বাংলা পুঁথি, তালপাতার শিরাগুলোর কারণেই সম্ভবত বাংলা বর্ণে মাত্রার সৃষ্টি হয়ে থাকবে।
‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত বইটি এবং বর্ণমালা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কিছু পোস্টার একটি সুদৃশ্য ব্যাগে ভরে বিক্রি/বিতরণ করা হয়েছে। আমি মনে করি, এই প্রদর্শনীর প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি ছবি পরিধেয় বস্ত্র, যেমন টি-শার্ট কিংবা শাড়িতে অলঙ্করণের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। লেটার প্রেসের ছবি দিয়ে একটি টি-শার্ট হলেও এমন কিছু মন্দ দেখতে হবে না। তবে বাণিজ্য এখানে মূল কথা নয়, বাংলা বর্ণমালার প্রতি বঙ্গসন্তানদের দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল সব্যসাচীর এই প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য। বাংলা বর্ণমালার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন সব্যসাচী, কারণ, তিনি রাজনীতি সচেতন এবং এই প্রদর্শনীর একটি রাজনৈতিক দিক আছে। রাজনীতি কী? এক কথায়, প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সুযোগ-সুবিধার ক্ষুদ্র কেকের বৃহত্তর টুকরাটি নিজের বা নিজেদের ভাগে বা ভোগে নেবার চেষ্টা করার নামই রাজনীতি। ভোগ করতে পারে সেই, যার যোগ্যতা ও স্বীকৃতি আছে। সব ভাষা ও সব বর্ণমালার যোগ্যতা সমান নয়। সব ভাষা ও বর্ণমালা ব্যবহারকারী জাতিও সর্বযুগে ও সর্বক্ষেত্রে সমভাবে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখে না।
জাতি গঠন, জাতীয় উন্নয়ন এবং জাতির অস্তিত্ব বর্ণমালার সঙ্গে জড়িত। কীভাবে? পৃথিবী দ্বন্দ্বময়। প্রতিটি ভাষা, প্রতিটি বর্ণমালা অন্য ভাষা অন্য বর্ণমালার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই প্রতিযোগিতায় সেই জিতবে, যার স্বীকৃতি এবং যোগ্যতা আছে। যোগ্যতাহীন লোককে সরকার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে; কিন্তু জীবন বা বাজারের সেই দায় বা বদভ্যাস নেই। তুরস্ককে এক সময় সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, সে আরবি বর্ণমালা রাখবে, নাকি রোমান বর্ণমালা গ্রহণ করবে। ভিয়েতনামকে এক সময় চীনা বর্ণমালা বাদ দিয়ে রোমান বর্ণমালা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। কী করুণ এক ‘বর্ণবিপর্যয়’! উভয় বর্ণমালার কোনোটিই তাদের নিজস্ব নয়। এমন একটি পরিস্থিতি কি আদৌ কাম্য? এমন পরিস্থিতিরই উদ্ভব হতে পারে, যদি আমরা কিছু পরিমাণে (সব্যসাচীর মতো) বাংলা ‘বর্ণবাদী’ হয়ে না উঠি। ‘বর্ণবাদ’ কথাটি বিবিধার্থক। জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বরক্ষায় এই ‘বর্ণ (প্রশংসা) বাদ’ অপরিহার্য্য, ঐ বর্ণ (ঘৃণা) বাদ পরিত্যাজ্য।
ভাষার মতো বর্ণমালারও চার ধরনের স্বীকৃতি থাকতে পারে: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং আন্তর্জাতিক। স্বীকৃতিগুলোকে যে ক্রমে সাজিয়েছি, সেই ক্রমেই স্বীকৃতিগুলো সাধারণত অর্জিত হয়। মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালার সামাজিক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল, ১৯৪৮-৫২ সালে অর্জিত হয়েছিল রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এই রাজনৈতিক স্বীকৃতি ‘ডি জুরো’ বা কাগজে-কলমে নাকি ‘ডি ফ্যাক্টো’ বা কাজে-কর্মে - সে প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বাংলা এখনো বিচারের ভাষা নয়। শিক্ষার ভাষাও বাংলা নয়, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও, যে বিশ্ববিদ্যালয়টি ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার বলে ফাঁপা গর্ব করে থাকে।
বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক স্বীকৃতি পুরোপুরি অর্জিত হয়নি, কারণ অর্থনীতি ও রাজনীতি কাগজের একই পাতার দুটি অবিচ্ছেদ্য পৃষ্ঠা। বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই বললেই চলে। ইংরেজি ভাষার সবগুলো স্বীকৃতি আছে। আমার মাতৃভাষা চট্টগ্রামীর একটি স্বীকৃতিও নেই। যে ভাষার, যে বর্ণমালার যত বেশি স্বীকৃতি, সে ভাষা, সে বর্ণমালা তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং তত বেশি দীর্ঘজীবী হবে। গারো বা ককবরোক ভাষার মৃত্যুঝুঁকি প্রমিত বাংলার কয়েক গুণ বেশি। গারো বা চট্টগ্রামীর বর্ণমালাও নেই। যে ভাষার বর্ণমালা নেই, সে ভাষা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকে। বর্ণমালাহীন ভাষার রাষ্ট্রভাষা হবার নজির নেই।
স্বীকৃতি কেউ কারও হাতে তুলে দেয় না। স্বীকৃতি মাত্রেই অর্জিত। স্বীকৃতি দাবি করতে হয় যোগ্যতা দেখিয়ে। শুনেছি, বাংলা বর্ণমালা, বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি ও ইংরেজির আগ্রাসনে বাঙালিদের অবহেলার শিকার। ‘কতরূপ স্নেহ করি বিদেশি কুকুর ধরি, স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া!’- বলেছিলেন বটে কবি ঈশ্বর গুপ্ত। এর মানে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে অন্তত বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালা হিন্দি ও ইংরেজি ভাষা ও বর্ণমালার কাছে প্রায় হেরে বসে আছে। আমরা যখনি আমাদের বর্ণমালা হারিয়ে ফেলব, আমরা আমাদের ভাষাও অনেকটাই হারিয়ে ফেলব এবং অনতিবিলম্বে সেই হারানো শূন্যস্থান পূরণ করবে বিদেশি ভাষা এবং বিদেশি বর্ণমালা, কারণ বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না। শূন্যস্থান পূর্ণ হওয়া মাত্র বাঙালি জাতিরও খোল-নলচে পালটে যাবে। এমন ঘটনা ইতিহাসে দুর্লভ নয়।
বাংলা বর্ণমালা যেমন সুন্দর, তেমনই কাজের। বাঙালি মুসলমানদের একাংশ যখন মরুস্বপ্নে মশগুল হয়ে আরবি হরফে বাংলা লিখতে চেয়েছিল, বাঙালি হিন্দুর একাংশ যখন ভুয়া আর্যামির পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দেবনাগরী লিপির পক্ষে ওকালতি করছিল, তখন ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ উর্দু ও আরবি বর্ণমালাকে বিশ্রী ও অকার্যকর এবং বাংলা বর্ণমালাকে যাবতীয় বর্ণমালার মধ্যে সুশ্রীতম ও শ্রেয়তম বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। বহু ভাষাবিদ ও বহুলিপিবিদ এই মনীষির কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পূর্বপুরুষের হাত থেকে মুফতে পাওয়া অমূল্য এক সম্পদ, ভাবপ্রকাশের কার্যকর এক হাতিয়ার বাংলা বর্ণমালা। এর কদর করতে হবে, এর সৌন্দর্য ও কার্যকারিতার দিকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। তা না হলে ইংরেজি ও হিন্দির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলা বর্ণমালা টিকতে পারবে না। আমার জিনিসকে যদি আমি দামি এবং সুন্দর না বলি, আমার পণ্যের প্রচার যদি আমি না করি, সে কাজ আমার প্রতিযোগী প্রতিবেশী এসে করে দেবে না।
বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে বাংলা ভাষা, বাঙালির অর্থনীতি, রাজনীতি ও কূটনীতি জড়িত। ভিন্ন জাতির সঙ্গে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনন্য সুষমাময় কার্যকর এক লিখন-প্রযুক্তি। এ কথা বলছি, কারণ বাঙালির শতভাগ শিক্ষাবিস্তারের ওপর নির্ভর করছে বাঙালি জাতির উন্নয়ন। শতভাগ যুক্তিনির্ভর শিক্ষা অর্জিত না হলে মূর্খ বাঙালি যেমন এ শতকে মধ্যপ্রাচ্যে-মালয়েশিয়ায় কামলা দিচ্ছে, আগামী শতকে বার্মায় গিয়ে কামলা দেবে। ষাটের দশকেও সমমানের অর্থনীতি ছিল মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশ। ছয় দশক আগে মালয় ভাষায় শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করে মালয়েশিয়া আজ বিদেশ থেকে কামলা নেয়, অশিক্ষিত বাঙালি পরের দেশে গিয়ে কামলা দেয়।
এক বাংলা ছাড়া অন্য কোনো বর্ণমালা দিয়ে বাঙালির শতভাগ শিক্ষা অর্জন করা অসম্ভব না হলেও দুরুহতো বটে। সুতরাং বাঙালি মাত্রেরই বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালার প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত, নিদেনপক্ষে বিশ্ববাজারে আপন অস্তিত্বরক্ষার স্বার্থে। আমরা চাই, বাংলা লিপি উত্তমরূপে শিক্ষা করে সুচারু অক্ষরে মনের ভাব প্রকাশে সক্ষম হয়ে উঠুক বাঙালির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। বর্ণচর্চা এক ধরনের শিল্পচর্চাওতো বটে। বর্ণচর্চার ওপর শিক্ষিত, শিল্পমনা ও সংস্কৃতিবান জাতিগঠন অনেকটাই নির্ভর করে। হাতের লেখা সুন্দর, এমন ব্যক্তিকে সবাই যে প্রশংসা করে, সাধ্যের বাইরে গিয়েও সুবিধা দিতে চায়- এই চরম সত্য আমার মতো গত চার দশক ধরে খাতাকাটা এক শিক্ষকের চেয়ে ভালো আর কে জানে?
বর্তমান প্রজন্মের দুই প্রধান দোষ: ১) তারা বাংলা (এবং ইংরেজিও) লিখতে ও পড়তে জানে না, লিখতে-পড়তে আনন্দও পায় না এবং ২) তাদের অধিকাংশের হস্তাক্ষর কদর্য বললেও কম বলা হয়। হস্তাক্ষর খারাপ হবার এই দোষ শিশু-কিশোরদের যতটা নয়, তার চেয়েও বেশি তাদের পিতামাতা ও শিক্ষকদের। ভুলে গেলে চলবে কেন যে বাংলা গালিটা ‘সারমেয় পুত্র’ বা ‘বরাহপুত্র’। পুত্রের যতই দোষই থাক, তার পিতা বা শিক্ষককেই ‘সারমেয়’ কিংবা ‘বরাহ’ বলে অপমান করা হয়। এমন সব পুত্র-কন্যাদের নিয়ে যে জাতি গঠিত হচ্ছে, সেটি অন্য জাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারা অসম্ভব না হলেও কঠিন।বাংলা বর্ণমালার সুষমতা ও কার্যকারিতার দিকে খোদ বঙ্গসন্তানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া আমার মনে হয় না দ্বিতীয় কোনো উদ্দেশ্য সব্যসাচীর আছে; কিন্তু সব্যসাচীর ক্ষীণ স্কন্ধের জন্য, আগেই বলেছি, এই কর্তব্য গুরুভার। আর এটাতো শুধু ওনার একার দায়িত্ব নয়, এ দায়িত্ব আমার, আপনার, সবার, রাষ্ট্রের এবং দিন শেষে সরকারের। সব্যসাচী যা করছে, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তা করা উচিত ছিল বহু আগেই। একক ব্যক্তি যে দেশে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এগিয়ে থাকে, সে দেশ ঠিকভাবে চলছে না বলে ধরে নেওয়া যায় এবং সে দেশের কপালে দুঃখ আছে।
উপরের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা দরকার ছিল প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে; কিন্তু যত দূর মনে পড়ছে, অভ্যাগতদের অনেকেই সেদিন প্রচণ্ড গরমে ঘামতে ঘামতে একদিকে অপেশাদার হাই প্রোফাইল উপস্থাপনা এবং অন্যদিকে অতিদীর্ঘ, গৎবাঁধা ও গড়পড়তা বক্তব্যবাহুল্যে তিতিবিরক্ত হয়ে ভাবছিলেন ‘থামলে ভালো লাগে!’ সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। অত্যন্ত পেশাদারীত্বের সঙ্গে আয়োজন করা হয়েছিল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের এই প্রদর্শনী। সিলিং থেকে বিভিন্ন ব্যানার ঝুলছিল, যাতে ছিল বর্ণ, প্রাইমার রচয়িতা, অঙ্কনশিল্পীদের ছবি। বড়সড় একটি মনিটরে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছিল অবিরাম। বাংলা প্রাইমারের ইতিহাস, কারা ছিলেন বাংলা প্রাইমার লেখক, কারা ছিলেন তাদের সহযোগী শিল্পী, কেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো প্রাইমার রচয়িতা এবং অবনীন্দ্র্রনাথের মতো শিল্পীর যুগলবন্দি, লেটার প্রেস কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি অনেক কিছুই ছিল সেই তথ্যচিত্রে।
কর্তৃপক্ষ যদি চায়, পুরো প্রদর্শনীটি একটি বর্ণমালা ও মুদ্রণ জাদুঘরে রূপান্তরিত হতে পারে। এই প্রদর্শনী ভ্রাম্যমাণ হতে পারে সারা বাংলাদেশে (এবং কেন নয়?) সারা পৃথিবীতে, যেখানে যেখানে বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষীর অস্তিত্ব রয়েছে। সব মিলিয়ে, রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে আমি বলব, সব্যসাচীর এই প্রদর্শনীতে আছে ‘বর্ণমালার ছটা, মুদ্রণের ঘনঘটা, (কিন্তু) নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ। অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ আমি নিশ্চিত, অনাগত বহুকাল যাবৎ দর্শকের মনে এই প্রদর্শনী দর্শনের সুখস্মৃতির রেশ রয়ে যাবে।
লেখক: ভাষাবিদ ও অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে