Views Bangladesh Logo

শেষ পর্ব

সেন্টমার্টিনে যে কোনো দেশের বেসক্যাম্প করা অসম্ভব

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশের খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী বন্ধু-রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দোদুল্যমান সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। ভারতসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্ক কীরকম হতে পারে, তা নিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার মানিক মিয়াজী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।

ভিউজ বাংলাদেশ: ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে কয়েক মাস ধরেই পরিকল্পিতভাবে নেগেটিভ প্রচারণা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের মিডিয়ার ভূমিকা কী হওয়া দরকার?

ইমতিয়াজ আহমেদ: ভারতীয় মিডিয়ার নেগেটিভ প্রচারণা রোধে অনেক কাজ করা যায়। যারা সমালোচনা করছেন তাদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ করা। বাংলাদেশের মিডিয়ার তাদের ভুল তথ্যের বিষয়ে সত্য প্রচার করা। আমরা দেখেছি তাদের অনেক ভুল তথ্য প্রচার করছে। এখন তো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগ, তাই যে কেউ চাইলেই একটা কিছু ভুলভাল তৈরি করে দিতে পারে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে দরকার হলে সরকারের খরচেই ভারতের মিডিয়াকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন না বলে কিংবা রাজনৈতিক না বলে তাদের বাংলাদেশে এসে ঘটনা দেখে রিপোর্ট করার জন্য আহ্বান করা।

দ্বিতীয়ত, ঘটনার বিষয়ে সত্যকে তুলে ধরে নিউজ, আলোচনা কিংবা ডকুমেন্টারি করা যেতে পারে। সরকার চাইলে কিছু ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগাতে পারে। যাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। তার মধ্যে ডি-ক্যাবকে দিয়ে দেশি কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা কিংবা সেমিনার করা যেতে পরে। তা হলে নেগেটিভ প্রচারণা কমবে বলে আমার মনে হয়। আরেকটি বিষয়ের দিকে সরকার শুরু থেকেই নজর দিতে পারত, তা হলো ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সে বিষয় নিয়ে কথা বলা। বিষয়টি নিয়ে সব মহলে আশ্বস্ত করা। যে বিষয়টি সরকার নজর রাখছে। মনে রাখতে হবে, কিছু মহল কিছু অপপ্রচার করবে, এটাই কিন্তু রাজনীতি এবং রাজনৈকিত খেলা। এখানে যদি সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা না যায়, তাহলে বুঝতে হবে, যে ব্যক্তি কিংবা যারা দায়িত্বে আছে, তারা তাদের দায়িত্ব থেকে সেরে যাচ্ছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: অবশ্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় মিডিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন, আপনারা (ভারত) বাংলাদেশে আসেন, দেখে যান। এখন তাদের অপপ্রচার রোধে বাংলাদেশ কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?

ইমতিয়াজ আহমেদ: এখানে একটা বিষয় হলো সরকার ডাকা মনেই হলো সরকার যা চাচ্ছে তা দেখাবে। তার থেকে ভালো ওয়ে হলো, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে করা, কোনো থিঙ্কটাঙ্কের মাধ্যমে করা কিংবা কোনো বিশ্বস্ত সংগঠনের মাধ্যমে করা। যেমন ডি-ক্যাব রয়েছে। এমন কিছু কাঠামো ব্যবহার করা, যা মূলত সরকারের হলেও অন্য কোনো মাধ্যমকে ব্যবহার করা। এখানে একটা কথা হলো, যারা নেগেটিভ প্রচার করছে, তারা মূলত তাদের খবরে আসবে না। সে ক্ষেত্রে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা সংগঠনের মাধ্যমে একটা সেমিনারের আয়োজন করলে তার একটি বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে। না হলে তো তারা মনে করবে, তাদের সরকার তার নির্দিষ্ট কিছু দেখাতে আনছে। তার থেকে ভালো হতো কোনো একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক গ্রুপকে ব্যবহার করত, যাদের সঙ্গে বিদেশি মিশনের সম্পর্ক ভালো আছে। তখন তারা একটি সার্ভে করে বলতে পারত, কারা কারা এসব নেগেটিভ প্রচারণার সঙ্গে জড়িত।

এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের একটি বড় ভূমিকা আছে। কারণ সব কিছু তো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তদের যেসব সংগঠন রয়েছে, তারাও চাইলে সেমিনার করতে পারে। সেখানে তারা সত্য বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তুলে ধরার সুযোগ আছে। এ ছাড়াও রয়েছে একাডেমিশিয়ানরা, চাইলে তারাও একটি উদ্যোগ নিতে পারে। এখানে অনেক সেক্টরে কাজ কারার সুযোগ রয়েছে। যেমন সাংবাদিক কিংবা থিঙ্কট্যাঙ্ক গ্রুপ, ব্যবসায়ী এবং একাডেমিশিয়ান। সবাইকে কাজে লাগাতে পারে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমান সরকারের ব্যবস্থাপনা দেখলে কতটুকু অভিজ্ঞতার অভাব মনে হয়?

ইমতিয়াজ আহমেদ: এটা সম্ভবত এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর বড় সমস্যা। এখানে সরকারে যারা আছেন, তারা মনে করে একাই যথেষ্ট। আমি যথেষ্ট, অন্যরা কেন বা কৃতিত্ব পেয়ে যাবে, এরকম মানসিকতা থাকতে পারে না। অথচ সবাইকে কাজে লাগাতে পারত। সে ক্ষেত্রে তো বলাই যায়, এখানে একটা বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। দেখা যাক সামনের দিকে কী হয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার পর যেসব খাতে যোগ্য লোক তৈরি হয়েছে, বতর্মান সরকার কি তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছে।

ইমতিয়াজ আহমেদ: এ সরকারের মাত্র চার মাস হয়েছে। সরকার ভালো করে জানে যে, তার মূল দায়িত্বটা হলো সংস্কারের মধ্যে যাওয়া। এখন তারা হয়তো ভাবছে ফরেন পলিসির মধ্যে নতুনত্ব আনতে পারবে। এ সরকার যেমন ফরেন পলিসির কথা ভাবছে, তেমনি কৃষককে নিয়েও ভাবতে হবে। এখন দেখার আছে যে, তারা সঠিক লোককে কীভাবে মূল্যায়ন করে।

ভিউজ বাংলাদেশ: সেন্টমার্টিন ইস্যুটি কি শেখ হাসিনার পতনের মূল কারণ ছিল, না কি পুরোটাই ভুল কূটনৈতিক কৌশল?

ইমতিয়াজ আহমেদ: আমি সেন্টমার্টিন বিষয়টিকে শুধু একটি সিম্বলিক অর্থে দেখি। মূলত সেন্টমার্টিনে যে কোনো দেশের বেইসক্যাম্প করা সম্ভব না, তার কয়েকটি কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম ভারত। কারণ ভারত চাইবে না সেখানে অন্য কারও ক্যাম্প তৈরি হোক। এ ছাড়া চীনও চাইবে না। বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক কাঠামো তাতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার যে সারপ্লাস, তা কিন্তু একটি কারণ। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের জন্য কাঁচামাল হিসেবে যেসব জিনিস ভারত এবং চায়না থেকে আনতে হয়, তা কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ম্যাটেরিয়ালস যদি আমরা ইউরোপ কিংবা আমেরিকা থেকে আনতাম, তাহলে আমার সে পরিমাণ লাভ থাকবে না। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো লস হয়ে যেত। এ বিষয়টি খুবই ভালোভাবে বোঝা দরকার। যারা হয়তো বলছেন, বাংলাদেশ কেন পুরোপুরি আমেরিকার দিকে ঝুঁকছে না, তাদের তো এ বিষটি বুঝতে হবে। অনেকেই হয়েতো বলবে সিঙ্গাপুর যদি পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না। এখন দেখতে হবে, সিঙ্গাপুরের কাঠামো আর আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো কিন্তু এক না।

আমাদের অর্থনীতির বিশাল একটি অংশ কৃষি, আমাদের রয়েছে পোশাক খাত। বাংলাদেশের পোশাক খাত গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে ভারত থেকে ২০ শতাংশ কটন আমদানি, ৩০ শতাংশ স্টোপিয় কিংবা মধ্য এশিয়া থেকে। মেশিন আসে চায়না থেকে। তারপর আমার এখানে আমাদের শ্রমিক দিয়ে কম মজুরি দিয়ে পোশাক তৈরি করার কারণে বাংলাদেশের লাভ হচ্ছে বেশি। যে আমরা বেশি পরিমাণ লাভ পাচ্ছি ইউরোপ কিংবা আমেরিকা থেকে। এখন আমরা যদি এমন কোনো নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করি, যার ফলে ভারত কিংবা চীনের মতো দেশগুলো বলবে আমরা নিরাপত্তার কারণে তোমার সঙ্গে থাকতে পারছি না।

এখন বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে, আসলে কী। যেমন আমেরিকার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু বিশাল, যার সমালোচনা তো স্বয়ং ট্রাম্পই করছে। আমেরিকার অর্থনীতিতে তারা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া আসলে চলতে পারবে কি না। এখন দেখতে হবে আমরা তাদের এসবের মধ্যে ঢুকতে যাব কি না। তাতে আমাদের কোনো লাভ আছে কি না। এখন যারা সরকারে আছে, তারাই বলতে পারবে তারা এসব ঝামেলায় যাবে কি না। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমি বলব, আমাদের এসব ঝামেলায় জড়ানো ঠিক হবে কি না, তা দেখার আছে। এদিকে ভারতের সঙ্গে আগের সরকারের এমন একটি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তা ভারত কিংবা দিল্লি হয়তো বুঝবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: মালাক্কা প্রণালিতে আমেরিকাকে সুবিধা দিলে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশ কতটুকু সুবিধা পাবে?


ইমতিয়াজ আহমেদ: টেকনোলজি এখন যেখানে গেছে, সেখানে কোথাও ক্যাম্প থাকার প্রয়োজনীয়তা কিংবা আবেদন এখন আর এত নেই। দেখা যায়, রিপাবলিকানদের যে থিম ইউরোপ থেকে সরে আসা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমেরিকার ১১৯টি বেইস ক্যাম্প আছে জার্মানিতে, ২৪টি ইউকেতে ও ৪০টি ইতালিতে। তাদের ক্যাম্প তো প্রায় দেশেই আছে। ট্রাম্প তো তাই বলছেন, তাদের টাকা অন্য দেশের নিরাপত্তা দিচ্ছে। অথচ আমেরিকার রাস্তা ভেঙে যাচ্ছে। তাদের হাইস্পিড ট্রেন নেই। কিছু স্থান তো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতো হয়ে গেছে। আমেরিকার সাবওয়ে ভেঙে যাচ্ছে। ট্রাম্প আমেরিকার সেই নীতি কতটুকু পরিবর্তন করতে পারবে, তা এখন দেখার বিষয়। কারণ আমেরিকার এতবড় মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি এবং তারা প্রচণ্ড শক্তিশালীও বটে। সে ক্ষেত্রে তারা এ স্থান থেকে সরে গিয়ে রাস্তা নির্মাণ শুরু করবে তা হয়তো হবে না। যদি ট্রাম্প তা পারে, তাহলে সাংঘাতিক একটা পরিবর্তন হবে। আমেরিকার জনগণ কিন্তু রিস্টাকচারের জন্য ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। আমেরিকার জনগণ কিন্তু যুদ্ধ চায় না। তবে যুদ্ধ চায় না আর যুদ্ধ থেকে সরে যাওয়া এক কথা না। এখন কথা হলো আমি কেন তাদের এসবের মধ্যে ঢুকতে যাব? আমার তো কোনো লাভ নেই। আমি কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধে যাব।

আমাদের দরকার এমন সম্পর্ক, যে সম্পর্কের মাধ্যমে সবার সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। তবে একটি বিষয় হলো গত সরকার রাজনৈতিক এবং ভোটে জেতার জন্য একটি দেশের সঙ্গে এমন ধরনের সম্পর্ক তৈরি করেছে, যেখানে অন্যদেশও কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।


আরও পড়ুন:

প্রথম পর্ব: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফরেন পলিসি নিয়ে কাজ করার জন্য আসেনি

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ