বিশেষ সংখ্যা : প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ৭ মার্চের ভাষণ
৭ মার্চের ভাষণ: মানবিক অধিকারকে নিশ্চিত করে
৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। সেদিনের বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বসে যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাধারণ ভাষণটি শুনেছিলাম, সে সময় ভাবিনি ‘সাতই মার্চের বিকেল’ নামে কোনো উপন্যাস আমি লিখতে পারব। ঐতিহাসিক সেই ৭ মার্চে আমার সঙ্গে ছিল আমাদের বন্ধু নমিতা সান্যাল। আমাদের সবারই সেদিন মনে হয়েছিল, পিছু হটার দিন আর নেই। ওই ভাষণটি মাথায় নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি মাঠে। ভেবেছি ভিড় কমলে বের হব। মেয়েদের জন্য বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করা একটি জায়গা ছিল মঞ্চের কাছে। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন সেখানে, আমি ছিলাম তার কাছাকাছি। খালাম্মার সঙ্গে কথা বলে বের হই একটু পরে। বের হবার পথে একজন বাদাম বিক্রেতার কাছ থেকে বাদাম কিনলাম। বাদাম বিক্রেতা আমার হাতে বাদাম দিয়ে বলল, ‘মুইছা গেছে, মুইছা গেছে পূর্ব পাকিস্তান’। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তার দিকে তাকাই আমি! নিজেও তো জানি, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে একবারও পূর্ব পাকিস্তান বলেননি। বাংলা, পূর্ব বাংলা, বাংলাদেশ বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সেই অসাধারণ ভাষণে তিনি তর্জনী তুলে পরিষ্কার বলেছিলেন, ‘আর দাবায়ে রাখবার পারবা না।’ বাক্যটি ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করতেন, তাহলে বলতেন, ‘আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ তিনি প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেননি। আঞ্চলিক শব্দ সহযোগে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ের এ বিশাল দরোজা খুলে দিয়েছেন, যে দরোজা পথে বেরিয়ে এসেছে বাঙালি চরিত্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য।
৭ মার্চের ভাষণে সেদিন তিনি সেই বাক্যটির পর বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই বাক্যটি তিনি প্রমিত বাংলায় বলেছেন। কি আশ্চর্যভাবে তিনি জাতীয় পটভূমি থেকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় উন্নীত হয়েছেন, মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রতিটি দেশের জন্য সর্বজনীন সত্য। মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এককভাবে হয় না, এর জন্য প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন, সাহায্য এবং সহযোগিতা। তাই বাক্যটি উচ্চারিত হয় প্রমিত বাংলায়। বাঙালি জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে মেলবন্ধনের প্রত্যাশায়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম। সেদিনের বক্তৃতায় তার উত্থিত সেই অমিতবিক্রম তর্জনীর সঙ্গে কণ্ঠস্বর যখন একই সমান্তরালে পৌঁছে যায়, তখনই বাঙালির অভিনব জীবন আস্বাদের স্পৃহা প্রবল হয়ে ওঠে।
‘আর দাবায়ে রাখবার পারবা না’- এই পঙক্তিটির চিত্রকল্প কল্পনা করলে কেমন দাঁড়াবে? ধরে নেওয়া যায়, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটি জনগোষ্ঠী তার ঘাড়ের ওপর শোষকের পা নিংড়ে নিতে চায়, তার জীবনের নির্যাস; কিন্তু কতদিন পা দাবিয়ে রাখবে? একে-দুয়ে মাথা ওঠাতে থাকে। সেই পা অস্বীকার করে উঁচু হয়ে উঠতে চায় মাথা। ঘাড় উঁচু করে তাকাতে শুরু করে আকাশের দিকে। শাসকের দুই পা দুই হাতে ধরে টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। ভেবে নেওয়া যায় যে, এমন অজস্র উঁচু হয়ে ওঠা মাথার চিত্রকল্প নিয়েই রচিত হয়েছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’- কী আশ্চর্য মেলবন্ধন! এভাবেই বুঝি কবিতার ভাষার সঙ্গে রাজনীতি এক হয়। মুখোমুখি দাঁড়ায় কবি ও রাজনীতিবিদ। মনে হয় না কি ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবো না’ পঙক্তিটিও একটি কালজয়ী পঙক্তি?
আমি ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি যখন লিখি, তখন একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের একটি ঘটনা। আমার শিক্ষক গবেষক-ফোকলোরবিদ অধ্যাপক আবদুল হাফিজ মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতা করেছেন। স্বাধীনতার পরে সেই ঘটনাটি আমাকে বলেছিলেন। যশোরের একজন মা দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর জন্য বোবা সন্তানটি মিলিটারির হাতে তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে। একজন গ্রামীণ নারীর এই আত্মত্যাগ একটি ভাষণের অনুপ্রেরণায় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...।’ বাঙালি নারী এই বাক্যেই বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাদের কী করতে হবে। এই বেদবাক্য মাথায় তুলে নিজেদের সাধ্যমতো কী করতে হবে, তার সব করেছেন। কোথাও কোনো দ্বিধা ছিল না।
একজন স্বল্পশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে তারামন বিবি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। তার শক্তি এই ভাষণের অনুপ্রেরণা থেকে এসেছে। একটি জনজীবন সে ভাষণটিকে কীভাবে ধারণ করেছে, শুধু বাংলার নারী সমাজের দিকে তাকালে এ উপলব্ধি সবার হবে। সিলেটের কাঁকন বিবির কথা বলা যায়, যিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রসদ সরবরাহ করেছেন, অস্ত্র সরবরাহ করেছেন; আবার পাকিস্তানি সেনার ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ তাদের করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই অমিত ডাক শুনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই দিন ৭ মার্চের সেই সভায় নারীদের হাতেও বাঁশের লাঠি ছিল। এ ভাষণটি মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই ভাষণ কী করে দেশের সীমানা অতিক্রম করল, এটা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা। তিনি বলেছেন যে, বিদেশে কোনো একটি জায়গায় একজন কাশ্মীরের গেরিলাযোদ্ধার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। নানা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এভাবে কি আপনারা অন্য দেশের ওপর নির্ভর করে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেন? সেই গেরিলাযোদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলেছিল, Are you from Bangladesh? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উন্নয়নশীল বিশ্বের ছোট ছোট দেশের জনগণের কাছে এভাবেই পৌঁছে গেছে। এ পৌঁছে যাওয়া শুধু একটি ঘটনা নয়। এর পেছনে আছে হাজার বছরের একজন মানুষের অভিজ্ঞান নিয়ে হাজার বছরের ইতিহাসকে নিজের মধ্যে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়া।
ইতিহাসে তিনিই অমর, যিনি সমগ্র জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন- ইতিহাস তারই পক্ষে, যিনি সময়ের বিচারে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেন। এ সংজ্ঞায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের সেই মহামানব, সময় যাকে সৃষ্টি করেনি, যিনি সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন, যিনি কঠোর স্বরে নিজস্ব ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেছিলেন সব কালের উপযোগী এবং সব দেশের জন্য প্রযোজ্য একটি অমর পঙক্তি- ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ রক্ত দেওয়া অর্থবহ হয় নিজের জীবন উৎসর্গ করার প্রতিজ্ঞায়। এই প্রতিজ্ঞা মুক্তিকামী মানুষের ঘরে ঘরে উচ্চারিত না হলে মুক্তির লক্ষ্য অনিবার্য হয়ে ওঠে না। ইউনেস্কোর বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছালে এই ভাষণের তীব্রতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে মানুষের চেতনায়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনই প্রতিফলিত হয় ভাইয়েরা আমার উচ্চারণে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আত্মিক যোগ ঘটে এই সম্বোধনে। এ যোগ দেশ ও সমাজের পরিপূরক। সেখানে মানুষ যেমন রাষ্ট্রের অধিকার পাবে, তেমন পাবে মনুষ্যত্বের চেতনায় মানবিক মর্যাদা। এই ভাষণ বিশ্বের সামনে তুলে ধরল বাংলাদেশের অর্জন।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ঘোষণা দিলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ। ইউনেস্কো জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা। এই স্বীকৃতি ইতিহাসের বড় সময় ধরে বিশ্বজুড়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। বলতেই হবে, বাঙালি-বাংলাদেশের ইতিহাস এই ৭ মার্চের ইতিহাস। ইউনেস্কোর মাধ্যমে বাঙালির অর্জন বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে মানুষের মানবিক অধিকারকে নিশ্চিত করে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে