Views Bangladesh Logo

আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতির পোস্টমর্টেম-২

গণতন্ত্র সংকুচিত হওয়ায় সংকটের জন্ম

Aranya  Kahleel

অরণ্য কাহলীল

‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’; যার অর্থ হলো, ‘গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য।’ আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়া স্টেটে তার দেয়া গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে। এটি সর্বজনবিদিত একটি সংজ্ঞা। গণতন্ত্রের মূলনীতি নিয়ে খুব সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, গণতন্ত্রে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের বহুত্ববাদী ব্যবস্থা, ক্ষমতা পৃথকীকরণ ও শাখাগুলোর স্বাধীনতা থাকা জরুরি।

সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব- এগুলো গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। এ উপাদানগুলোকে দেখা হয়, গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণাগুলোর প্রতীক হিসেবে। আর এসব গড়ে ওঠে মানুষের মৌলিক অধিকার, সমান সুযোগ ও একে অপরের প্রতি সহানুভূতির ওপর ভিত্তি করে; কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রে কমবেশি এসব উপাদানের খেলাপ হয়েছে বারবার। তবে সবচেয়ে বেশি খেলাপ হতে দেখা গেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। দলটির প্রায় ১৬ বছরের টানা শাসনামলে রাজনৈতিক সাম্য ছিল না বললেই চলে। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতাও সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। ফলে হোঁচট খেয়েছে গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের মূল বিষয় হচ্ছে নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’ হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে সে নির্বাচন হতে হবে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ। নির্বাচনে কারচুপি বা জবরদখল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুকে পেরেক ঠোঁকে। এছাড়া গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের প্রাধান্য দেয়া, মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা, স্বাধীন ও সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, জনগণের প্রতি নিরাপত্তা বাহিনীর দায়বদ্ধতা- ইত্যাদি বিষয়ও খুব গুরুত্বপর্ণ। এগুলো উপেক্ষিত হলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। যা গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যার কুফল ভোগ করতে হয় রাজনৈতিক দলগুলো বা সরকারকে।

এবারে আসা যাক, প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা দোর্দণ্ড প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের পতনের কথায়। গভীর বা হালকা যেভাবেই পর্যালোচনা করা হোক না কেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানাভাবে এসব বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে গণতন্ত্র সংকুচিত হতে হতে নানা সংকটের জন্ম দিয়েছে। যার সূত্র ধরে আওয়ামী লীগকে শুধু ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়নি, দলের নেতাকর্মীদের গা-ঢাকা দিতে হয়েছে।

পর্যবেক্ষকমহল মনে করছে, বাকস্বাধীনতায় অব্যাহত হস্তক্ষেপ, জনগণের অধিকার রক্ষায় উদাসীনতা, আইনের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করা, সুশাসন নিশ্চিত করতে না পারা, রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলা, নিজেদের মতো করে রাজনীতির গতিপথ তৈরির প্রচেষ্টাসহ একলা চলো নীতি আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত করেছে।

রাজনীতির জন্যই একাধিক রাজনৈতিক শক্তি এবং জনগণের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের পাশাপাশি অত্যন্ত শক্তিশালী বিরোধী দল থাকে। যাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারে। সরকার বিপথে চললে সঠিক পথে গমনের জন্য চাপ দিতে পারে। পক্ষে-বিপক্ষের সবার কথা শুনে রাজনীতির চাল চালতে হয়। রাজনীতির কূটনীতিতে মিত্রকে যেমন আস্থায় রাখার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হয়, তেমনি শত্রুকেও চিরশত্রু বানাতে নেই। রাজনীতির প্রয়োজনে বিতর্ক-সমালোচনা থাকবে, বৈরিতাও স্বাভাবিক। এর মধ্যেও কথা বলার মতো পরিবেশ বা সহযোগিতার মতো পরিস্থিতি বজায় রাখতে হয়। তবেই একটি দেশে গণতন্ত্র বিকশিত হয়।

কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী বড় দল বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছে বরাবরই। নিজ দলের পাশাপাশি ক্রিয়াশীল অন্যান্য দলের ক্রিয়ায় সবসময় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ এটি ভুলে গিয়েছিল যে, দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ জনগণ তাদের পক্ষে থাকে। বাকি ৬০ বা ৬৩ শতাংশ দলটির বিরোধী অবস্থানে সবসময় থাকে। এই ৬০ বা ৬৩ শতাংশ বিভিন্ন দলের পক্ষে থাকলেও আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করার লক্ষ্যে সবসময় একাট্টা থাকে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগ। বক্তব্য-বিবৃতি থেকে শুরু করে হামলা-মামলা-নির্যাতন সবই করা হয়েছে এ দলটির নেতাকর্মীদের ওপর। এটি জনগণের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে অব্যাহতভাবে। সবশেষ পতনের ঠিক আগে আগে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করে ওই সময়ের জন্য রাজনৈতিক ভুল চাল চেলেছে। নানা সূত্র ধরে সব রাজনৈতিক শক্তিকে একসঙ্গে বিরুদ্ধ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা সামাল দেয়ার মতো সক্ষমতায় ফাটল ছিল। ফলে পাল্টা চালে আওয়ামী লীগকে পরাস্ত হতে হয়েছে।

শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ১৪ দলীয় জোটের প্রায় সব দল এবং মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টিও ছিল কোণঠাসা। ১৪ দলের নেতারা সরকারের সঙ্গে অব্যাহতভাবে থাকলেও বারবার উপেক্ষিত হয়েছেন। আর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চলেছে নানা ক্যারিকেচার। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জীবিত থাকাকালে তাকে যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি তার অবর্তমানে জাতীয় পার্টিকে দ্বিখণ্ডিত করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করেছে; কিন্তু রাজপথে বা সংসদে কোথাও বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির অবস্থানে জাতীয় পার্টিকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।

পর্যবেক্ষকমহল মতে, নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়া ঠিক করে বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলটির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির প্রক্রিয়াকে ন্যূনতম ক্রিয়াশীল রাখা হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তা না করে, শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাদের এককভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ইচ্ছা আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলেছে। এর বদলে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করা হলে আওয়ামী লীগ এভাবে সংকটে পড়তো না।

বিশ্লেষকদের দাবি, প্রবল আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের মতো করে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে গিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত করেছেন। এই ভুলের মাত্রা এতটা বিস্তৃত হয়েছিল যে, নির্বাচনে প্রার্থী না পাওয়ায় নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছে। ফলস্বরূপ শুধু সাধারণের মাঝে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তাই নয়, বরং নিজ দলের বিভিন্ন স্তরেও ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। সে কারণে তৃণমূল বা বঞ্চিত ত্যাগী নেতারা চরম বিপদের মুহূর্তেও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সাহস দেখাননি।

১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রবাসে দীর্ঘজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে শেখ হাসিনার প্রথম বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার তিনি নিশ্চিত করবেন। সে লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘসময় লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, বিএনপি আমলে ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার থাকার অভিযোগ প্রমাণ করেছিলেন শেখ হাসিনাই; কিন্তু তিনি যখন ক্ষমতায় থাকার জন্য যেনতেন নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলেন, বড় দলগুলোকে উপেক্ষা করলেন, জনগণ সেটি ভালোভাবে নেয়নি।

পরপর দুটি নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম ভোট বঞ্চিত হওয়ায় বিষয়টি ওই শ্রেণিকে আওয়ামী লীগ-বিরোধী করে তুলেছিল ঘোরতরভাবে। ভোটের এই রকমফের দেশের জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। এর সঙ্গে একদিকে দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতির কারণে জনজীবনের নাভিশ্বাস অন্যদিকে বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নিয়ে নানা ধরনের রন্ধনপ্রক্রিয়া মানুষকে শেখানোর প্রচেষ্টা, রোজার সময় কিসের বদলে কি খাবে; দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে সেগুলোর প্রেসক্রিপশন দেয়া সাধারণ জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

মূলত ক্ষমতায় থাকার প্রচেষ্টায় একাধিকবার বিজয়ী হওয়ায় পরিবেশ-পরিস্থিতি ও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। নেতাকর্মীদের একচ্ছত্র ও অন্ধ সমর্থনে বছরের পর বছর দল প্রধানের পদে থাকলেও শেখ হাসিনা ত্যাগী নেতাকর্মীদের কাছ থেকে অনেকটা দূরবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। এক্ষেত্রে বিগত জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচন কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, গণতন্ত্রকে নিজের মতো করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা শেখ হাসিনার একটি বড় ভুল ছিল। তিনি সর্বজনবিদিত সংজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ বলে নতুন একটি প্রক্রিয়া চালু করতে চেয়েছিলেন। তারই অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে রাজনৈতিক অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করেছেন। যা তাকে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ফলে তিনি ভুলে গেছেন, উন্নয়নের পাশাপাশি রাজনৈতিক সুশাসন ও সহাবস্থানের সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তার কথা। যা তার জন্য বিপদাপন্ন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

(চলবে)

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ