Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কারণ ছিল পরিকল্পিত

Mustafa Mahmud  Hussain

মুস্তাফা মাহমুদ হুসাইন

বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ যখন উত্তাল, তখনই হঠাৎ করে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর কারণ হিসেবে দায়ী করেছিলেন আন্দোলকারীদের। তিনি বলেছিলেন, অগ্নিসংযোগের কারণে ডেটা সেন্টার পুরোপরি বন্ধ হয়ে যায়; কিন্তু সাম্প্রতিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আদতে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর পুরোটাই ছিল পলকের মিথ্যাচার। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ জানাতেই এই প্রতিবেদন পাঠকের সামনে হাজির করা হলো। মিথ্যার ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশের ডিজিটাল অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে এর কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে তা এই প্রতিবেদনে দেখানো হবে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট অবকাঠামোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ফলে কী মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল তা বোঝার জন্য আমাদের বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবার সামগ্রিক অবকাঠামো সম্পর্কে ধারণা পেতে হবে। দেশের ডিজিটাল ইকোসিস্টেম ইন্টারনেট সার্ভিস মাধ্যমে চলে। এর মধ্যে ডেটা সেন্টার, সাবমেরিন, টেরিস্ট্রিয়াল ফাইবার অপটিক কেবল এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোও নেটওয়ার্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।

বাংলাদেশের ইন্টারন্টে অবকাঠামোটি বেশ জটিল এবং অনেক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত:

১. সাবমেরিন কেবল:
বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন হয় সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে, যা দক্ষিণ পূর্ণ এশিয়া-মধ্য পূর্ব-পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তারের মাধ্যমে সংযোজিত হয়েছে। এই কেবল এসেছে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট আদান-প্রদানে এই কেবলগুলোই বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রিত করে। বাংলাদেশের ডেটা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় এই কেবলই মূল পরিচালক শক্তি।

২. ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবলস (আইটিসি):
সাবমেরিন কেবল ছাড়াও ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে সংযুক্ত করার জন্য আইটিসির কেবলগুলো ব্যবহৃত হয়। আন্তর্জাতিক ডেটা ট্রাফিকের জন আইটিসি সম্পূরক রুট প্রদান করে।
৩. ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি)
স্থানীয় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার-এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক ডেটা আদান-প্রদান পরিচালনা করে আইআইজি। আইআইজি দুদেশের মধ্যস্থতাকারী হিসাবেও কাজ করে। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট চলাচল আইআইজির মাধ্যমে দেশে প্রবেশ এবং বহির্গমন করে।

৪. কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক:
কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক হলো বিশ্বব্যাপী বিতরণ করা সার্ভারের নেটওয়ার্ক। ডাটা ব্যবহারকারীর কাছে যা আরো দক্ষতার সঙ্গে (ওয়েবসাইট, অ্যাপস এবং মিডিয়া) সরবরাহ করে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং পরিষেবাগুলোর মতো উচ্চ-ট্র্যাফিক প্ল্যাটফর্মগুলো সর্বোত্তমভাবে নিশ্চিত করাই এর কাজ।

৫. ইন্টারনেট সার্ভিস সেবা:
গ্রামীণ, রবি এবং বাংলালিংকসহ বেশ কয়েকটি যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান করে।
মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা পরিচালনার মাধ্যমে এই সেবা প্রদানকারীরা শহর ও গ্রামীণ এলাকায় সংযোগ নিশ্চিত করে।

৬. ডেটা সেন্টার:
ঢাকার মহাখালীর খাজা টাওয়ারে দেশের ডেটা স্টোরেজ। এই ডেটা স্টোরেজ ডেটা প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। খাজা টাওয়ারে রয়েছে বড় কয়েকটি কোম্পানির ডেটা সেন্টার, যারা অনেক আইআইজি ও আইএসপি কোম্পানিকে সেবা দেয়। এই সেবাগুলো শের মধ্যে ডিজিটাল তথ্যের প্রবাহ বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।

৭.নিয়ন্ত্রক সংস্থা:
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের তত্ত্বাবধান করে। অতিরিক্তভাবে, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে, ইন্টারনেট ট্র্যাফিক পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৮. দেশব্যাপী টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক:
বাংলাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ দাঁড়িয়ে আছে এর বিস্তৃত ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের মধ্যে। হাজার হাজার কিলোমিটার ফাইবার তারগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে আছে, যা শহর এবং আন্তর্জাতিক বহির্গমনের মধ্যে উচ্চগতির ডেটা ট্রান্সমিশনকে সহজতর করে৷

সে সময়ে সরকারের ভূমিকা

বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে ছাত্ররা আন্দোলন করলে ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই জুনাইদ আহমেদ পলক মৌখিক আদেশে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কথা বলেন। এর জন্য তিনি আন্দোলনকারীদের দায় করে বলেছিলেন ডেটা সেন্টার পুড়ে গেছে; কিন্তু আদতে এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। আগুনে ডেটা সেন্টারের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কারণ ছিল আন্দোলনকারীদের ওপর দোষ চাপানো এবং যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটানো। এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া আর কিছুই না।


সাবমেরিন কেবল এবং আইটিসি অপারেটরদের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ ব্লক করা:
নির্দিষ্ট সময়কালে ডেটা পরিবহনের জন্য ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হয়। সাবমেরিন কেবল অপারেটরদের স্থানীয় আইএসপির মাধ্যমে পলকের নির্দেশে ব্যান্ডউইথ সীমিত করা হয়। এতে বহির্বিশ্বের সঙ্গে কার্যত বাংলাদেশের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেহেতু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ট্রাফিকের সিংহভাগ এই কেবলের মধ্য দিয়ে যায়। তাই ব্যান্ডউইথ ব্লক করায় শহর ও গ্রামেও একইরকম প্রভাব পড়ে। শহরের কিছু পরিমাণ নেট পেলেও গ্রামের মানুষ নেট বঞ্চিতই থাকে বলা যায়।

যারা টেরিস্ট্রিয়াল লিঙ্কের মাধ্যমে সম্পূরক সংযোগ প্রদান করে, সেইসব আইটিসি অপারেটরদেরও একইভাবে ব্যান্ডউইথ সীমাবদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। যা প্রায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়ারই শামিল। এভাবে সরকার বাংলাদেশকে কার্যত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। বাংলাদেশের বাইরের মানুষ নেটের মাধ্যমে আর বাংলাদেশের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।

আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে- এর মাধ্যমে প্রবেশাধিকার সীমিত করা:
সাবমেরিন কেবল লেভেলে ব্যান্ডউইথ ব্লক করার পাশাপাশি, সরকার আইআইজিকে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। আইআইজি বাংলাদেশের ইন্টারনেট এবং গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মধ্যে ডেটার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। আইআইজিকে আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস সীমাবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়ে সরকার দেশের বাইরে হোস্ট করা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এবং প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার সীমিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে গুগল, ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্রধান প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার বন্ধ করা।

এই স্তরে প্রবেশাধিকার বন্ধ করা মানে সারা দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া। জিজিটাল বিশ্ব থেকে বাংলাদে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্কের (সিডিএন) কৌশলগত ব্লকিং:
কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক উচ্চ-ট্রাফিক ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশন থেকে ডেটা সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সিডিএন ব্লক করার জন্য অপারেটরদের নির্দেশ দিয়ে সরকার নিশ্চিত করেছে যে ব্যবহারকারীরা ফেসবুক, ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামের মতো বড় গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মগুলো অ্যাক্সেস করতে পারবেন না। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় রাখতে আন্দোলনকারীরা ব্যাপকভাবে এই প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করেছিল।

সিডিএন ব্লক করার অর্থ হল যে কিছু ব্যবহারকারীর ইন্টারনেটে সীমিত প্রবেশাধিকার থাকলেও সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সেবা পাবেন না। ব্যান্ডউইথ সমস্যার সঙ্গে সিডিএন ব্লক ইন্টারনেট সেবা কার্যত বন্ধই করে দিয়েছে।

মিথ্যা অজুহাত: আগুন লাগানোর ফাঁদ:
ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার কারণ হিসেবে সরকার দাবি করেছে ডেটা সেন্টারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি আন্দোলনকারীরা। এর মধ্যে মহাখালির ত্রাণ পুনর্বাসন কেন্দ্রও আছে। পলকের মতে, এই আগুনে ফাইবার-অপটিক কেবলের বিশাল ক্ষতি হয়েছে, যে কারণে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে গেছে।

পলক দাবি করেছেন, শত শত কিলোমিটার ফাইবার-অপ্টিক কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ডেটা সেন্টার ধ্বংস হয়ে গেছে। দায় এড়ানোর জন্য এবং প্রতিবাদকারীদের উপর দোষ চাপানোর জন্য এই মিথ্যা অজুহাত দেয়া হয়েছিল। নিরপেক্ষ তদন্তে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে এই আগুনে দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলেছিল।

তদন্তে দেখা গেছে যে আগুনের মাত্রা ছিল খুবই কম। ইন্টারনেট বন্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে এর জন্য দায় ছিল সরকারের মিথ্যা ফাঁদ। সাবমেরিন কেবল অপারেটর, আইআইজি এবং আইটিসিকে সরাসরি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সারা দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ কর দেয়ার জন্য।
ইন্টারনেট বন্ধের পেছনে প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়া:
দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোকে ব্যাহত করার জন্য ডিজাইন করা বেশ কয়েকটি উন্নত প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম এবং প্রোটোকল ব্যবহার করে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল:

১. বর্ডার গেটওয়ে প্রোটোকল ম্যানিপুলেশন: ইন্টারনেট জুড়ে স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেমের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে বর্ডার গেটওয়ে প্রোটেকল (বিজিপি)। বিজিপি ঘোষণায় হেরফের করে, সরকার রাউটিং টেবিল পরিবর্তন করতে পারে এবং ডেটা বাংলাদেশে প্রবেশ বা প্রস্থান করতে বাধা দিতে পারে। মূলত দেশের ইন্টারনেটকে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিজিপির মাধ্যমে।

২. ডিএনএস ফিল্টারিং এবং ডিএনএস বিষাক্তকরণ: ডোমেন নেম সিস্টেম (ডিএনএস) আইপি ঠিকানাগুলোতে ডোমেন নাম অনুবাদ করার জন্য দায়ী। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মের ডোমেন নামগুলো সমাধান করতে ডিএনএস সার্ভারগুলোকে বাধা দিয়ে সরকার নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটগুলোতে অ্যাক্সেস ব্লক করার জন্য ডিএনএস ফিল্টারিং নিযুক্ত করেছে। আন্দোলনকারীদের ব্যবহৃত যোগাযোগ প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার আটকাতে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করা হয়েছিল।

৩. গভীর প্যাকেট পরিদর্শন (ডিপিআিই): ডিপিআই নির্দিষ্ট ধরনের ডেটা প্যাকেট শনাক্ত করে ইন্টারনেট চলাচল করার অনুমতি দেয়। ডিপিআই মোতায়েন করার মাধ্যমে, সরকার অন্যান্য পরিষেবাগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ না করে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে, যেমন মেসেজিং অ্যাপের যোগাযোগকে বেছে বেছে ব্লক বা থ্রেট করতে পারে। বিক্ষোভের সময় তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ডিপিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

৪. সিডিএন ব্লকিং: সিডিএন ব্লক করা ব্ল্যাকআউট কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। যেহেতু সিডিএনগুলো ব্যবহারকারীদের কাছাকাছি সামগ্রী ক্যাশে করে, তাই তাদের ব্লক করা প্রধান প্ল্যাটফর্মগুলোতে অ্যাক্সেস ব্যাহত করে যা দ্রুত এবং দক্ষ সামগ্রী সরবরাহের জন্য তাদের ওপর নির্ভর করে। ব্যান্ডউইথ থ্রটলিং এর সঙ্গে এই ব্লকেজ, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিষেবা অ্যাক্সেস করার ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার অর্থনৈতিক প্রভাব:
ইন্টারনেট বন্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে আইসিটি খাতে। বাংলাদেশের আইসিটি খাত দেশের জিডিপিতে প্রায় ১ দশমিক ২৮ শতাংশ অবদান রাখে। রপ্তানি আয়ে বছরে প্রায় ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে। দীর্ঘায়িত শাটডাউনের কারণে লক্ষ লক্ষ ডলার ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ই-কমার্স এবং আইটি পরিষেবাগুলোর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর জন্য।

ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোর কাজ অনেক কমে যায় তাতে। অনলাইন নির্ভর ব্যবসাগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফ্রি ল্যান্সার কর্মীরা তাদের কাজ সময় মতো শেষ করতে পারেন না। ফলে অনেক কাজ হাত ছাড়া হয়ে যায়। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বিদেশি ক্লায়েন্ট দেশের স্থিতিশীল ইন্টারনেট পরিষেবা বজায় রাখার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অনলাইন ব্যাংকিং, টেলি স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা প্ল্যাটফর্মের মতো প্রয়োজনীয় ডিজিটাল পরিষেবাগুলোতেও প্রবেশাধিকার ব্যাহত করেছে। ডিজিটাল যোগাযোগ ও নেটনির্ভর পরিষেবাগুলো বন্ধ হলে যাওয়ার ফলে লাখ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক দৈনন্দিক জীবনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গ্লোবাল এবং সাইবার সিকিউরিটি ইমপ্লিকেশন:
ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া মূলত বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা ও নাগরিক স্বাধীনতাকেই হুমকির মধ্যে ফেলেছে। যদিও সরকার দাবি করেছে, দেশের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করতে হয়েছিল; কিন্তু সরকার চাইলে জনগণকে কতখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাও এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সরকার মূলত নিজের কর্তৃত্ব জাহির করেছে। এতে বোঝা যায়, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা হলেই সরকার সরাসরি জনগণের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।

বিশ্বব্যাপী, রাজনৈতিক অস্থিরতার সম্মুখীন দেশগুলোতে ইন্টারনেট বন্ধ করা একটি ক্রমবর্ধমান সাধারণ কৌশল হয়ে উঠেছে। ভারত থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত সরকার ভিন্নমত দমন করতে এবং তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেছে। এই ঘটনাগুলো প্রায়ই উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি, ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা এবং নাগরিক স্বাধীনতার অবক্ষয় ঘটায়।

প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছুড়ে ফেলা:
সরকার প্রথমে যেমন দাবি করেছিল জুলাই মাসে ইন্টারনেট বন্ধ আগুন লাগার কারণে ঘটেছিল, আসলে আদতে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এর বদলে এটি ছিল আন্দোলন দমন করার একটি কৌশল। যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার এটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছিল। এটি একটি প্রযুক্তিগত দমন। ইন্টারনেট বন্ধ, ব্যান্ডউইথ, সিডিএন অ্যাক্সেস এবং আন্তর্জাতিক গেটওয়ে ব্লক করার মাধ্যমে এটি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলেছিল।

বাংলাদেশকে যদি সামনে এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে অবশ্যই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সরকার কোনোভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। ভবিষ্যতে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। ভবিষ্যতের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো বোঝার জন্য এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। স্পষ্ট আইনি তত্ত্বাবধান এবং জবাবদিহি ছাড়া এই ধরনের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা যেন আর কখনো না ঘটে।

মুস্তাফা মাহমুদ হুসাইন: টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ