রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের হালচাল
গত ৩ মার্চ রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় মসজিদের মাইকে ‘ডাকাত’ ঘোষণা দিয়ে নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেক নামে দুজন জামায়াতে ইসলামীর কর্মী বা সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের কাছে একটি অস্ত্র ছিল যা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় লুণ্ঠিত থানার অস্ত্র বলে ধারণা করা হচ্ছে। অস্ত্র একটি নয়, নিহতদের পালিয়ে যাওয়া সঙ্গীদের হাতেও অস্ত্র ছিল এবং তাদের এলোপাতাড়ি ছোড়া গুলিতে ৫ গ্রামবাসী আহত হয়েছেন।
মিডিয়ার বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগের পতনের পর সাতকানিয়া এলাকা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয় জামায়াত ক্যাডার নেজাম, আবু ছালেক, আবু তাহের আদাইয়া, জাহেদ ও রিফাতরা। পুলিশের ভাষ্যমতে, নিহত সালেকের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা ও বিভিন্ন ঘটনার পাঁচটি মামলা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয় জামায়াত নেতার মতে তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলাম বেশ খোশমেজাজে আছে, তারা আগামী নির্বাচনে জয়লাভের কথাও ভাবছে। তাদের ভাবনা একেবারে অমূলক নয়, কারণ তাদের সমর্থক বেড়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আনুকুল্য পাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনসমর্থনে বিএনপি ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী; কিন্তু মাঠপর্যায়ে বিএনপির কর্মীদের লাগামহীন চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জনগণ কিছুটা বিরক্ত। তবে বিরক্ত হলেও বিএনপির বিরাট কর্মীবাহিনী রয়েছে, এখন মাঠ তাদের দখলে। অনুকূল পরিবেশে বিএনপির কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিএনপির কর্মীদের নেতিবাচক ভূমিকায় জামায়াতে ইসলাম প্রচারে কিছুটা সুবিধা পেয়ে যায়; তারা প্রচার করছে যে, জামায়াতে ইসলাম ব্যতীত সব দলের নেতাকর্মী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ এবং দুর্নীতিপরায়ণ। জনগণের কিয়দংশও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিমত দিচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির শাসন জনগণ দেখেছে, এই তিনটি দলের চরিত্রগত পার্থক্য খুব কম, এই তিনটি দলের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজিতে সিদ্ধহস্ত, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বেপরোয়া, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন।
যে বিএনপির নীতিনৈতিকতা নিয়ে জামায়াত এখন প্রশ্ন তুলছে, সেই বিএনপি সরকারের অংশীদার ছিল এই জামায়াত। এই অংশীদারিত্ব থাকা সত্ত্বেও জামায়াত নিজেদের বিএনপি থেকে আলাদা ভাবছে, কারণ তাদের দলের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চুরি বা দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। তারা এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তবে এই চ্যালেঞ্জ জাতীয় পার্টি ব্যতীত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিও দিতে পারে। কারণ এই দুটি দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির কোনো অভিযোগ অদ্যাবধি প্রমাণিত হয়নি। সরকার বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব দুর্নীতির অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে খারিজ হয়ে যায়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির দুর্ভাগ্য যে, তাদের শীর্ষ নেতা এরশাদ সাহেব শাস্তি ভোগ করায় জাতীয় পার্টি এই চ্যালেঞ্জটা দিতে পারছে না। তবে তিনিও দুর্নীতির দায়ে জেল খাটেননি, জেল খেটেছেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দেয়া পিস্তল নিজের কাছে রাখার জন্য। আইন তাকে শাস্তি দিলেও জনগণ কিন্তু তাকে প্রত্যাখ্যান করেনি, জেলে বন্দি এরশাদ সাহেবকে পাঁচ পাঁচটি আসনের জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।
বিএনপির দুর্নীতি প্রচার করে জামায়াত ভোটের মাঠে সুবিধা করতে পারবে না। কারণ শীর্ষ নেতারা দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকলেও দলীয় নেতাকর্মীরা তা বিশ্বাস করে না। জনগণও একই ধাঁচে গড়া। জনগণ জেনেশুনেই দুর্নীতিবাজদের ভোট দেয়; কারণ জনগণের দুঃখকষ্টে দুর্নীতিবাজের দুর্নীতির টাকার গরজ বেশি। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ধনীদের মনোনয়ন দিয়ে থাকে, কীভাবে ধনী হলো তা বিবেচ্য নয়। দেশের অধিকাংশ মসজিদ, মাদ্রাসা দুর্নীতিবাজের টাকায় গড়া এবং দুর্নীতিবাজের টাকায় চলে। তাই বিএনপির কর্মীদের মাঠ দখল, ঘাট দখল, বাজার দখলের বদনাম দিয়ে জামায়াত জনগণের মন জয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ বিএনপিও এখন আর জামায়াতকে ছেড়ে কথা বলছে না, জামায়াতের বিরুদ্ধে বিএনপির যে অভিযোগ সবার দৃষ্টি কেড়েছে তা হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর ইসলামী ব্যাংক দখল করা।
প্রশাসন দখল করার অভিযোগও জামায়াতের বিরুদ্ধে রয়েছে। মাঠ দখলে বিএনপি এগিয়ে থাকলেও প্রশাসন দখলে নাকি জামায়াত এগিয়ে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে আওয়ামী লীগের ট্যাগ না থাকলে বাকিরা নিরপেক্ষ। কারণ যারা আন্দোলন করেছে তারা ছাত্র, তাদের কোনো দল ছিল না, নেতা ছিল না, আমলা ছিল না। তাই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া তাদের নিজস্ব কোনো লোক নেই, ছাত্রদের বাধ্য হয়ে বিএনপি আর জামায়াতের আমলা নিয়ে তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এখন ছাত্ররা নতুন দল করেছে; কিন্তু প্রশাসনে তাদের নিজস্ব লোক নেই, ফলে বিএনপি এবং জামায়াতকে তোয়াজ করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় ছাত্রদের দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ আওয়ামী লীগ ফোবিয়ায় আক্রান্ত থাকলে এগুতে পারবে না। পেশিশক্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের উত্থান ঠেকাতে গেলে দেশে অশান্তি বিরাজ করবে, যা ছাত্রদের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কাম্য নয়। পার্টির জনভিত্তি প্রতিষ্ঠায় জনসমর্থন প্রয়োজন। জনগণের আস্থা অর্জনে জাতীয় নাগরিক পার্টির করণীয় নির্ধারণ করা জরুরি।
সব অঘটনের দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পুরোনো প্রবৃত্তি নতুন করে দেখা দিয়েছে, এর ফলে পুরোনো শাসনামলের মতো আসল অপরাধী নিষ্কলুষ থাকছে। দলবেঁধে জোটবদ্ধ হয়ে যুবককুল দরজা-জানালা ভেঙে বিভিন্ন বাড়িঘরে পুলিশের মতো তল্লাশি করছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করার যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে, সংশ্লিষ্ট যুবকরা বাড়ি তল্লাশি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মুখ দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। যুবকরা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য তা শনাক্ত করার গরজও কারও নেই, অন্তর্বর্তী সরকারকে হেয় করার অভিসন্ধি থেকে এই কাজগুলো হচ্ছে কিনা তা বিবেচনায় নেয়া ফরজ। এই যুবকদের না থামানো হলে দায় বর্তাবে অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির ওপর; কিন্তু দৃশ্যমান এই ঘটনাগুলোর দায় পতিত আওয়ামী লীগের ওপর চাপানো হলে জনগণের নিকট তা সব ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য হবে না।
শুরু করেছিলাম জামায়াতে ইসলামের দুই কর্মীর হত্যা নিয়ে, সাতকানিয়ায় তাদের দলীয় কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে। জামায়াতে ইসলাম সন্ত্রাসমুক্ত দল হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। এক সময় তারা যে বিরোধী পক্ষের পায়ের রগ কেটে দিত তা তারা স্বীকার করে না। চট্টগ্রাম এবং রাজশাহীতে রগ কাটার নজির বেশি, কারণ এই দুটি এলাকায় ছাত্রশিবির অনেক শক্তিশালী। এখন দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের সময় থানার অস্ত্র লুটের সঙ্গেও তারা জড়িত। তাহলে কথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামের সন্ত্রাসের পার্থক্য জনগণের নিকট স্পষ্ট হবে কী করে! একাত্তরে জামায়াতে ইসলাম ভারতের ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি বলে তারা ভারতে যায়নি; কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভের নায্যতা স্বীকার করে। জামায়াতের আমির সম্প্রতি বলেছেন, আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নামের পূর্বে ‘মওলানা’ উপাধি থাকায় তিনি ভারতে স্থান পাননি, তারা গেলেও পেতেন না। তাহলে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বা হেমায়াত উদ্দিন বীর বিক্রমের মতো দেশে মুক্তি বাহিনী গঠন করেননি কেন? কেন মুক্তি বাহিনীর প্রতিপক্ষ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস গঠন করল জামায়াত?
জামায়াত নৈতিকতার মানদণ্ডে নিজেদের যতই আলাদা মনে করুক না কেন, আলাদা হওয়া কঠিন, কারণ এই দেশের অধিকাংশ লোক দ্বিচারিতায় অভ্যস্ত- কিছু মানুষ প্রর্থনাও করে, আবার ঘুষও খায়; আবার দুর্নীতিও করে; ইহুদি-নাসারাদের পছন্দ না করলেও আমেরিকা-ইউরোপের ভিসা পেলে বর্তে যায়, ভারতবিদ্বেষী লোকও ভারতে বেড়াতে যায়, বাদ্যযন্ত্রযোগে গান শোনা নাজায়েজ মনে করলেও কাওয়ালি গানের ভক্ত। তবে আওয়ামী লীগ আমলে নিপীড়িত জামায়াত ইত্যবসরে অনেক অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, জনসমর্থনও বাড়াতে সমর্থ হয়েছে, বিএনপির জন্য জামায়াত ভোটের নির্বাচনে এককভাবে থ্রেট না হলেও আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের সহায়তায় থ্রেট তৈরি করার অনুকূল পরিবেশ পেয়েও যেতে পারে।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে