২০২৪-এ তিনটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা
২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। রেকর্ড পরিমাণ বন্যা হয়েছে এবং এমন সব দেশে বন্যায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যারা কখনো বন্যা দেখেনি। রোমানিয়া, অস্ট্রিয়া চেক রিপাবলিকের মতো দেশগুলোকে ভুগতে হয়েছে। এ বছরই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তাপ রেকর্ড করা হয়েছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সর্বাধিক আন্তর্জাতিক উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেছে। মহাকাশেও দেখা গেছে ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা। মে মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত সূর্যে ভয়ানক ঝড় বয়ে গেছে। এই সৌরঝড় ছিল বিজ্ঞানীদের জানা অন্য যে কোনো সৌরঝড়ের তুলনায় ১০ গুণ শক্তিশালী। অন্যদিকে বছরের শেষে এসে নাসার পাঠানো স্পেসক্রাফট ঘণ্টায় ৪ লাখ ৩০ হাজার মাইল গতিতে সূর্যের কাছাকাছি, অর্থাৎ মাত্র ৩৮ লাখ মাইল দূরে পৌঁছে গেছে। এটি মানুষের পাঠানো সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন মহাকাশযান। এর আগে সূর্যের অন্য কোনো মহাকাশযান এত কাছে পৌঁছতে পারেনি।
এ বছর রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে ভারত জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানিতে সরকার টিকে গেলেও আসন হারিয়ে দুর্বল হয়েছে। দীর্ঘকাল পর যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীল দলের পরাজয়ের পর লেবার পার্টি মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। বেশ কয়েকটি ছোট বড় দেশে শাসনভার পরিবর্তিত হয়েছে। হয় আন্দোলনের মুখে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে। এ বছরই ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে প্রথম ব্যাপকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সেইসঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল গাজা যুদ্ধ প্রসারিত হয়েছে, ইসরায়েল এ বছর লেবানন আক্রমণ করেছে। মিয়ানমারে সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব অনেক কিছুই সালতামামিতে উঠে আসবে। বছর শেষে গোনা শুরু হয়েছে ঘটনাবলি; কিন্তু তিনটি ঘটনা আমাদের চোখে পড়েছে, যার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্যগত মিল রয়েছে। আর সেই সাদৃশ্য হলো, তিনটি ঘটনাই ঘটে গেছে দ্রুত সময়ের মধ্যে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে।
সর্বপ্রথম ঘটনাটি হলো বাংলাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়া। ঘটনাটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, অনেকের ঘোর এখনো কাটেনি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০১৩, ১৪, ১৮ সালে বড় ধরনের আন্দোলন হয়েছে, যেখানে লাখ লাখ লোক যোগ দিয়েছিল। সে আন্দোলনগুলো দমন করে তিনি নিশ্চিন্তে শাসনকাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন; কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এলে শেষ পর্যন্ত তা শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিনের মসনদ টলিয়ে দেয়। ছাত্রদের দাবি ছিল খুবই যৌক্তিক এবং তা বাস্তবায়নের কোনো জটিলতাই ছিল না; কিন্তু তা একেবারেই কেয়ার করেনি হাসিনা সরকার। দেখতে দেখতে অন্দোলনে সাধারণ মানুষ যোগ দিতে থাকে। একপর্যায়ে ওই আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবিতে পরিণত হয়। অবশেষে তিনি ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। তার পতনের মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি যে এই আন্দোলনে তার সরকারের পতন ডেকে আনবে। এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের সরকার পতনের দাবিও ছিল না।
দ্বিতীয় ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনবিষয়ক। ৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী ধারণা ছিল, ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বভাবসুলভ অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে। কর ফাঁকি থেকে শুরু করে ফৌজদারি মামলা। যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রচারমাধ্যম ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখেছে; কিন্তু নির্বাচনে বিস্ময়কর ফল দেখা গেছে। এমনকি রিপাবলিকান পার্টি কংগ্রেস ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি অঙ্গরাজ্য সুইং স্টেট হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে পেলসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্য মুখ্য হয়ে ওঠে।
নির্বাচনে দেখা যায় সব সুইং স্টেটে রিপাবলিকান, অর্থাৎ ট্রাম্পের দল এগিয়ে গিয়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ ভোট ও হিসপ্যানিক ভোট উল্লেখযোগ্য হারে ট্রাম্পের পক্ষে যায়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট পেয়েছিলেন ৮ শতাংশ এবং হিসপ্যানিক ভোট পেয়েছিলেন ৩২ শতাংশ; কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনে তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৩ শতাংশ এবং ৪৫ শতাংশে। তিনি অভিবাসনবিরোধী হলেও দক্ষিণ আমেরিকার অভিবাসীরা তাকে কেন এতসংখ্যক ভোট দিয়েছে, তা সত্যিই অবাক করার মতো। তিনি আগামী ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
আর তৃতীয় ঘটনাটি সিরিয়ার। ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে রাশিয়ায় চলে যান। বাশার আল আসাদের পিতা হাফেজ আল আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে প্রায় ২৯ বছর সিরিয়ায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২০০০ সালে তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় হাফিজের দ্বিতীয় পুত্র বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। হাফেজ আল আসাদের জ্যেষ্ঠপুত্র বাসেল আল আসাদ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করায় দ্বিতীয় পুত্র বাশার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন গ্রহণ করেন। অর্থাৎ হাফেজ আল আসাদ একটি অলিখিত শক্তিশালী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন; কিন্তু আরব বসন্তের সময় সিরিয়ায় বাশারের পতনের জোর আন্দোলন শুরু হয়।
বিভিন্ন আরব দেশ থেকে ক্ষমতাসীন শাসকরা উৎখাত হলেও রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তায় বাশার টিকে থাকেন; কিন্তু শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এক যুগেরও বেশি সময় গৃহযুদ্ধ চললেও কখনো মনে হয়নি আসাদকে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হচ্ছে; কিন্তু ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বরের ঠিক এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ করেই হায়াত তাহরির আলশামস নামে সশস্ত্র সংগঠন সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহর আলেপ্পো থেকে অগ্রসর হতে শুরু করে; এবং এতকাল পর এত বড়বড় বিদ্রোহ স্তব্ধ করার পরও এবার শুরুতেই আসাদ বুঝতে পারেন শেষ রক্ষা হলো না। ফলে বিদ্রোহীরা বাশারের পতনের যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী আসমা আল আসাদ তিন সন্তান নিয়ে প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পরে রাশিয়ায় চলে যান। আসাদের বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়রাও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
অবশ্য আসাদের হঠাৎ করেই পতন যে অনিবার্য তা না বোঝার কোনো কারণ ছিল না। তার দুই সমর্থক দেশ রাশিয়া এবং ইরান অন্য দুটি যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। রাশিয়াকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে ইউক্রেন তথা ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধে। অন্যদিকে ইরান এতটাই ইসরায়েল লেবানন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে যে, তার সামর্থ্য নেই বাশার আল আসাদকে পেছন থেকে আর সমর্থন জানানোর। ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের বড় একটি অংশ দীর্ঘদিন সিরিয়ায় অবস্থান করেছে এবং বাশার সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে; কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহদের সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে তারা লেবাননে চলে যায়। ফলে বাশারবিরোধীরা সেই স্থান দখল করে নেয়।
অবশ্য এই তিনটি ঘটনাই অতি দ্রুত পরিবর্তন আনলেও তিনটি ঘটনারই পেছনে দীর্ঘ পটভূমি রয়েছে। শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট কারচুপির পর থেকেই জনমত তার বিপক্ষে যেতে শুরু করে। তখন থেকেই তিনি একরকম প্রশাসনের সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। দেশের মানুষও প্রায় ভুলে গিয়েছিল যে শেখ হাসিনাকেও ছেড়ে যেতে হবে। তিনি যেন চিরজীবনের জন্য ক্ষমতায় বসেছিলেন; কিন্তু মাত্র দুসপ্তাহে সবকিছু ওলোটপালট হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনেও এমন একটি আবহ ছিল যে, ডেমোক্র্যাটরাই সরকার গঠন করবে; কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক সরাসরি রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের পক্ষে যোগদানের পর থেকেই পরিস্থিতি ঘুরে যেতে থাকে। আর বাশার আল আসাদের চলে যাওয়াটা হতে পারতো আরও ১২ বছর আগে। সেটা অস্বাভাবিক হতো না; কিন্তু মাত্র সাত দিনের নোটিশে আসাদের দেশত্যাগ বিশ্বকে নাড়া দিয়ে গেছে। ১৪ বছরে যে শেখ হাসিনা ক্ষমতা আকড়ে ছিলেন তাকে যেতে হয়েছে ১৪ দিনের আন্দোলনে। ২৪ বছর যে বাশার আল আসাদ ক্ষমতা ধরে ছিলেন, তাকে মাত্র ৭ দিনের নোটিশে দেশত্যাগ করতে হয়েছে।
প্রতিটি বছরেই কিছু ওলোটপালট হয়, নতুন নতুন ডেভেলপমেন্ট দেখতে পাওয়া যায়। ২০২৫ সাল শুরু হচ্ছে। এ বছরও পৃথিবীতে ভালো-মন্দ অনেক ঘটনাই হয়তো ঘটবে। কোনোটা প্রত্যাশিত, কোনোটা অপ্রত্যাশিত। সে জন্য আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে প্রতি বছরের মতোই সবারই আশা থাকবে পৃথিবীতে যেন শান্তি আসে, যাতে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্ধ হোক পৃথিবীর যুদ্ধ, সংঘাত ও নিরীহ মানুষের প্রাণহানি। আগামীর জন্য এ কামনাই আমরা করতে পারি শুধু।
মহসীন হাবিব: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে