প্রথম পর্ব
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। গত ২৯ নভেম্বর তিনি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, নতুন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনের রূপরেখা বিষয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা জানি যে আপনি বর্তমানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান। সংস্কারের কাজ কীভাবে চলছে এবং কতদূর এগিয়েছে সে বিষয়ে আমাদের একটু বলুন।
বদিউল আলম মজুমদার: প্রাথমিকভাবে আমরা আইন-কানুন, বিধিবিধান সব পর্যালোচনা করেছি। লাইন বাই লাইন পড়েছি। এর মাধ্যমে আমরা কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু চিহ্নিত করেছি। অংশীজনের সঙ্গে আমরা মতবিনিময় করেছি। আমরা তাদের মতামত নেয়ার চেষ্টা করেছি। সুপারিশ নেয়ার চেষ্টা করেছি। বিভিন্নভাবে আমরা তা করছি। কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কাছে এসে তাদের সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে রাখছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও দিচ্ছে। একই সঙ্গে আমরা বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করছি। এ ছাড়াও আমরা ওয়েবসাইট স্থাপন করেছি। আমাদের ইমেইল এড্রেস আছে, ফেসবুকও ব্যবহার করছি মানুষদের কাছ থেকে মতামত নেয়ার জন্য। বিভিন্নভাবে আমরা তাদের মতামত, সুপারিশ নেয়ার চেষ্টা করছি। তাদের অনেক দাবি-দাওয়া আছে, সেগুলোও জানার চেষ্টা করছি। তাদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা আমাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করব।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই সংস্কারের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য বিগত সরকার যে আইন করেছিল, সেই আইন নিয়ে বিতর্ক ছিল, সেই বিতর্ক আইনবিদদের কাছ থেকে এসেছে, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এসেছে, আপনাদের কাছ থেকে এসেছে, এখন সংস্কার করতে গিয়ে ওই আইনটি কতটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে আপনাদের কাছে? নিশ্চয়ই আপনারা এটা পর্যালোচনা করেছেন।
বদিউল আলম মজুমদার: ২০২২ সালে আউয়াল-কমিশন গঠনের আগে, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ নিয়ে একটা আইনের খসড়া তৈরি করেছিলাম সুজনের পক্ষ থেকে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের একটি আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়া হবে বলে উল্লেখ আছে; কিন্তু ১৯৭২ সালের পর ২০২২ সালের আগে আমাদের দেশে এই আইনটা প্রণীত হয়নি। ২০২২ সালে একটা খসড়া প্রণয়ন করে আমরা তৎকালীন আইনমন্ত্রীর কাছে দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এখন এই আইন করার সময় নেই; কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে একটা জনমত সৃষ্টি হয়। এরপর তখনকার সরকার তড়িঘিড়ি করে একটা আইন পাস করে। আসলে আগে যে যে প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়া হতো, সেই প্রজ্ঞাপনটাই জাতীয় সংসদে আইন আকারে পাস করা হয়। ফলে এ আইনটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না; কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ওই আইনটি ব্যবহার করেই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে এবং অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেয়।
আইনটি ত্রুটিপূর্ণ নিঃসন্দেহে। তবে এই ত্রুটিপূর্ণ আইন দিয়েই যদি সঠিক ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা যায়, তাহলে সঠিক ব্যক্তিরা নির্বাচন কমিশন হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এবার সেটাই হয়েছে। আগের ত্রুটিপূর্ণ আইনে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হলেও আমি যতটুকু দেখেছি, যাদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে হয়েছে, তারা সম্মানীত ব্যক্তি, তারা দল নিরপেক্ষ ব্যক্তি। তারা যাদের নাম সুপারিশ করেছেন এবং যারা নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও আমি আশা করি, তারা সঠিক ব্যক্তি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি বলতে চাচ্ছেন, বিদ্যামান যে আইনের ভিত্তিতে এখন অনুসন্ধান কমিটি করা হলো এবং অনুসন্ধান কমিটির মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন করা হলো, সেই নির্বাচন কমিশনকে গ্রহণযোগ্য বলা যায়।
বদিউল আলম মজুমদার: বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে। যাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে, আমরা আশা করব, তারা নির্দলীয় ব্যক্তি। আমি যতটুকু শুনেছি, আমি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তারা পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি নন। আমরা যতটুকু শুনেছি। আমি আশা করব, তাদের মাধ্যমে একটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়ার একটা সময়সীমা আছে, আপনারা কি আশা করছেন এর মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন?
বদিউল আলম মজুমদার: আমরা তো আশা করছি পারব। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে, আমরা এর মধ্যেই সুপারিশ পেশ করতে পারব।
ভিউজ বাংলাদেশ: যখন আপনারা সংস্কার কমিশনের কাজ করছেন, তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসেছে, আপনারা যে সুপারিশ করবেন, এখন তো সংসদও নেই যে, এই সুপারিশ কোনো আইন দ্বারা সিদ্ধ হবে, আপনারা শুধু সুপারিশ করছেন, সুপারিশ করার পরও পরবর্তীতে যে সরকার নির্বাচিত হবে, কতটুকু আশা করা যায়, তারা এটা গ্রহণ করবে? এর আগেও কিন্তু এরকম সুপারিশ ছিল; কিন্তু পরে নির্বাচিত সরকার তা বাস্তবায়িত করেনি।
বদিউল আলম মজুমদার: আমরা আশা করব আমরা যে সুপারিশগুলো করব এই সুপারিশগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে। বসে তারা কিছু বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। আমরা যে সুপারিশগুলো করব, তার কিছু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে, কিছু নির্বাচন কমিশন বাস্তবায়ন করতে পারবে। যেগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে না, বিশেষত সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব আসবে, আমি আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা ক্ষমতায় যাবে তারা সেগুলো বাস্তবায়ন করবে।
এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। অতীতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেসব অঙ্গীকার করেছে তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। একটা উদাহরণ হলো, ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটা নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করা হয়, যার শিরোনাম ছিল- দিন বদলের সনদ। তারা সবকিছু বদলিয়ে ফেলবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনবে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মূল উপড়ে ফেলবে, বিকেন্দ্রীকরণ হবে, দলীয়করণ হবে না আর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দলীয়করণ হবে না আর, ইত্যাদি। সবকিছু পরিবর্তন করে ফেলবে। দিন বদল করে ফেলবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলো একদমই বাস্তবায়িত হয়নি। আমি আশা করব, গত জুলাই-আগস্ট মাসে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, যতগুলো প্রাণ ঝরেছে, যত মানুষ আহত হয়েছে, তাদের আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করবে। তারা নতুনভাবে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করবে। যে বিষয়গুলো পরিবর্তন দরকার, যে সুপারিশগুলো আমরা করব, ঐকমত্যের ভিত্তিতে তারা সেগুলো আগামীর নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনারা যে প্রস্তাবনাগুলো দেবেন, সেগুলো তো বিদ্যমান সংবিধানের আলোকেই; কিন্তু আপনি বলেছিলেন সংবিধান সংস্কার হতে পারে, যদি সংস্কার হয়ে যায় এবং তার পরে যদি কোনো কনফ্লিক্ট হয়, সে বিষয়গুলো আপনারা কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার: কতগুলো সংস্কার তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারবে না। সংবিধান সংস্কার করতে পারে একমাত্র সংসদ। সংসদ করতে চাইলে সংবিধান সংস্কার হবে না। সংবিধান সংশোধন পুরোপুরি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের ওপর। আর এগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা নির্বাচন কমিশন যেসব সংস্কার করবে তাও নির্ভর করে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর। নির্বাচিত সরকারের কথাই শেষ কথা। তারা যদি চায় পরিবর্তন হবে, তারা যদি না চায় পরিবর্তন হবে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত দেশে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ থাকা। অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না। জুলাই-গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে আমাদের যে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আমরা দেখতে পাচ্ছি, নানাভাবে নানারকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং কোনোভাবেই সেটা শেষ হচ্ছে না। এরকম পরিবেশ চলতে থাকে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করা কতটা সম্ভব হবে?
বদিউল আলম মজুমদার: অবশ্যই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য যে স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার, তা তৈরি করার জন্য সবারই দায়িত্ব আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব আছে, নাগরিকদের দায়িত্ব আছে। আমরা সবাই যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি, তাহলে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলমান করার স্বার্থে আমরা সবাই যেন দায়িত্বশীল আচরণ করি, আমি সেটাই আশা করব।
(চলবে)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে