উদ্বোধনী সংখ্যা ৫ : বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য-ইতিহাস
দিন শেষে সব ছবিই অতীতের ছিটেফোঁটা। অতীতের এই টুকরো টুকরো দৃশ্য দিয়ে যে ইতিহাস দাঁড় করানো হয় তাই ‘ভিজ্যুয়াল হিস্ট্রি’ বা দৃশ্য-ইতিহাস। দৃশ্য-ইতিহাসের ছবিগুলো সচেতন বা অসচেতনভাবে তৈরি করা হয় যার বিষয়বস্তু প্রধানত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, সময় ও সংস্কৃতি। দৃশ্য-ইতিহাস এক বা একাধিক চিত্রের মাধ্যমে ব্যক্ত হতে পারে। শুরুতে হাতে আঁকা ছবি, ম্যুরাল ও ভাস্কর্যে দৃশ্য-ইতিহাস খোঁজা হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ক্যামেরা প্রায় একাই পৃথিবীর দৃশ্য-ইতিহাস রচনার দায় কাঁধে তুলে নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ক্যামেরায় ধারণ করা হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্য-ইতিহাস।
সিনথিয়া ফ্রিল্যান্ড তার ‘ইন্ট্রোডাকশন টু আর্ট থিওরি’ গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘নির্দেশিত কতগুলো নিয়ম মেনে তৈরি চিত্রকর্ম কখনোই মাস্টারপিসের জন্ম দেয় না।’ আর ‘রিগার্ডিং দ্য পেইন অব আদার্স’ বইয়ে সুজান সনটাগ বলেছিলেন, ‘নারকীয় ঘটনার ছবি আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, যখন ঠিকঠাক আলোর কাজ কিংবা গঠনের ছাপ তাদের মধ্যে থাকে না।’ মাঝে মাঝে ভাবি, সম্ভবত এসব কারণেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বহু ছবি ‘মাস্টারপিস’ হয়ে উঠতে পেরেছে। মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো বহুল ব্যবহৃত ছবি বের করে দেখুন, খুব নিয়ম মেনে ছবিটি তোলা হয়নি। যুদ্ধের ডামাডোলে নিয়ম মানার সুযোগ ও সময়ইবা কোথায়! আর আমরা তো জানি, দৃশ্য-ইতিহাস নির্মাণে কাঁচা হাতের একটি স্ন্যাপশটও গুরুত্ব পেতে পারে।
মুক্তিসংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ছবি : আনোয়ার হোসেন
বাংলাসাহিত্যে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন যতটা জায়গা পাওয়ার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে ততটা জায়গা পায়নি। শিল্পকলার দুটি মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ তার যথাযথ স্থান পেয়েছে, এক. সংগীত এবং দুই. আলোকচিত্রকলা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত উঁচু দরের অজস্র গান আর কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। আর এত বৈচিত্র্যপূর্ণ আলোকচিত্র আছে যে, স্বীকার করতেই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ ওই ছবিগুলো ছাড়া। ছবিগুলো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনায় শুধু সাহায্যই করে না, এককভাবে ইতিহাস বিনির্মাণও করে।
সুজান সনটাগ তার ‘অন ফটোগ্রাফি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আলোকচিত্র সাক্ষ্য দেয়। এমন কিছু, যার সম্পর্কে আমরা শুনি কিন্তু সন্দিহান থাকি, তার একটি আলোকচিত্র বিষয়টিকে প্রমাণ করে দেয়।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি ক্যামেরার যথাযথ ব্যবহার না হতো তাহলে পূর্ব-পাকিস্তানে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা কি মাত্রায় বর্বরতা চালিয়ে ছিল, তা অনুধাবন করা যেত না। ছবির ভয়াবহ সব দৃশ্য আমাদের যেভাবে নাড়া দেয়, কারও মুখ থেকে শোনা বয়ান ততটা নাড়া দিত না, এমনকি বিশ্বাস করাও হয়তো কঠিন হতো। আলোকচিত্রগুলো আমাদের সন্দেহমুক্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধে নারী। ছবি : সাইদা খানম
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো শুধু ভয়াবহ চিত্রই ফুটিয়ে তোলেনি, বীরত্বগাথাও রচনা করেছে। সেসব ছবি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আমাদের সাহসী ও অনুপ্রাণিত করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। তার মানে ছবিগুলো না থাকলে, আমরা যে বীরের জাতি, তা প্রমাণ করাও কঠিন হয়ে পড়তো। কেননা কথায় বলে, চোখের আড়াল মানেই নাকি মনের আড়াল। ক্যামেরা মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের চোখের আড়াল হতে দেয়নি। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কোনো প্রমাণ রেখে তারা যুদ্ধ করেননি। আলোকচিত্রগুলো সেই ঘাটতি অনেকাংশে পূরণ করেছে।
রোঁলা বার্থ তার ‘ক্যামেরা লুসিডা’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আলোকচিত্র কখনোই সত্যিকার অর্থে স্মৃতি নয়, বরং সে স্মৃতিকে আটকে দেয়, দ্রুত অস্মৃতিতে পরিণত করে।’ তার মতে, ‘প্রতিটি আলোকচিত্র উপস্থিতির সনদপত্র।’ অন্তত মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর ক্ষেত্রে আমি তার সঙ্গে একমত। আমাদের হাতে থাকা জ্বলজ্বলে ছবিগুলোই মুক্তিযুদ্ধকে স্মৃতিতে পর্যবসিত হতে দেয়নি, তা আমাদের কাছে সবসময়ের বর্তমান। আমরা দেখেছি, কারণ যাই হোক—আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লিখিত ইতিহাস নিয়ে নানা সময়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে; কিন্তু আমরা কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোনো ছবি নিয়ে বিতর্ক দেখেছি? আলোকচিত্রের দিকে আঙুল তোলা কঠিন- কেননা, তা ‘উপস্থিতির সনদপত্র।’
ভারতে শরণার্থী শিবিরে এক বাঙালি নারী। ছবি : রঘু রাই
মোটা দাগে সংবাদচিত্রের দুটি দিক থাকে, প্রায়োগিক ও শৈল্পিক। ছবিতে এই দুটি গুণের সহাবস্থান কঠিন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর শৈল্পিক গুণ না থাকলেও খুব ক্ষতি হতো না। ছবির সময় ও মুহূর্তের কারণেই ছবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু আমরা ভাগ্যবান, অন্তত বহুল পুনরুৎপাদিত ছবিগুলোতে শৈল্পিক গুণও অটুট। শুধু তাই নয়, এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের আলোকচিত্র চর্চাকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
শিল্পসমালোচক ও লেখক সুজান সনটাগ বলেছেন, ‘যুদ্ধের ছবিতে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়াটা হৃদয়হীন দেখায়। যতই হোক, ধ্বংসের কোনো নিসর্গদৃশ্যও কিন্তু নিসর্গদৃশ্যই। ধ্বংসস্তূপেও সৌন্দর্য রয়েছে।’ প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক জেমস ন্যাক্টওয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ট্র্যাজিক মুহূর্তমাত্রই যে অসুন্দর, তা ঠিক নয়। জীবনের অসংখ্য স্ববিরোধিতার এটিও একটি, যা শিল্পসাহিত্যের অন্যতম থিম। সম্ভবত এ জন্যই ইমেজগুলো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।’ বাঙালি পরিচয়টি কিছুক্ষণের জন্য ভুলেও যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর দিকে তাকাই, দেখব- ছবিগুলো একই সঙ্গে হৃদয়বিদারক ও হৃদয়গ্রাহী। আমরা অনেক সময় চোখের পানিতে ছবিগুলোর সৌন্দর্যকে ধুয়ে ফেলি। ছবির তথ্যের পাশাপাশি ছবির সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা জরুরি। যে দর্শক মুক্তিযুদ্ধ কি জানে না, এই যুদ্ধের বীরত্ব ও গণহত্যা সম্পর্কে যে অসচেতন তার চোখে প্রথমে পড়বে ছবির সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য আলোচনাই তাকে ছবির ‘ব্যাকগ্রাউন্ডে’ নিয়ে যাবে।
একাত্তরে রায়ের বাজার বদ্ধভূমি। ছবি : রশীদ তালুকদার
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে ফটোসাংবাদিকতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। তবে আমাদের দেশে ফটোসাংবাদিকতার উত্থান ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে। তা একাত্তরে এসে সমৃদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়। বাংলাদেশের আজকের ফটোসাংবাদিকতা একাত্তরেরই ফসল। দেশে চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের শিল্প-আন্দোলনে আলোকচিত্রীরা ছিলেন না। সেসময় আলোকচিত্রীর সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা; কিন্তু গণ-আন্দোলনগুলোতে আমরা আলোকচিত্রের বলিষ্ঠ অবস্থান দেখলাম, প্রথমে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, তারপর ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে এবং শেষে একাত্তরের জনযুদ্ধে। একাত্তরের ফটোসাংবাদিতা বা আলোকচিত্রকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের সম্মিলিত উদ্যোগটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বাংলাদেশে ফটোসাংবাদিকতার ইতিহাস, ভাষা, কৌশল ও নান্দনিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একাত্তরের ফটোসাংবাদিকতার প্রসঙ্গ বারবার আসবে।
বর্বরতার শিকার এক বীরাঙ্গনা। ছবি : নাইব উদ্দিন আহমেদ
যে দেশি-বিদেশি আলোকচিত্রীরা মহান মুক্তিযুদ্ধকে ক্যামেরার রিলে বয়ন করেছেন তাদের একটি তালিকা তৈরি এবং ছবিগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা জরুরি ছিল। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এসেও আমরা তা করতে পারিনি। আর হ্যাঁ মুক্তিযুদ্ধের একগুচ্ছ উঁচু দরের ছবি থাকলেই হবে না, সেসব ছবি কে বা কারা দেখছেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন এক সময়ের প্রবেশ করেছি, যেখানে রাজনৈতিক কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে দুটি দল দাঁড়িয়ে গেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ছবির ব্যঞ্জনা দুঃখজনকভাবে আপেক্ষিক হয়ে পড়েছে। ‘ওয়েস অব সিইং’ গ্রন্থে জন বার্জার বলেছেন, ‘আমরা কী জানি অথবা বিশ্বাস করি, তা দিয়েই প্রভাবিত হয় কোনো কিছুকে আমরা কীভাবে দেখি।’ সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো অসাড় যদি না থাকে, সেগুলো পাঠ করার মতো দর্শক।
লেখক : সাংবাদিক ও আলোকচিত্রকলার শিক্ষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে