এবার ভোটে ফ্যাক্টর হচ্ছেন যেসব ভোটার
অবশেষে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা, বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোট বর্জন, নাশকতা, প্রতিরোধ এবং জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন মহলের উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার ২৯৯ আসনের ভোটে লড়ছেন ২৮টি রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৯৬৬ প্রার্থী। এর মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। মোট ভোটার ১১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ জন। এর মধ্যে ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪ হাজার ৮৭৯ জন নারী আর পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৪ লাখ ৫ হাজার ৭২৪ জন।
ভোটযুদ্ধে হেভিওয়েট প্রার্থীদের দিকে সবার আগ্রহ থাকলেও ভোটাররা একটু চিন্তাশীল, দায়িত্ববান এবং কৌশলী হলে পাল্টে যেতে পারে ভোটের ফল। ভোটাররা যদি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সৎ, যোগ্য, মেধাবি এবং পরোপকারী প্রার্থীদের ভোট দেন, তাহলে রাঘব-বোয়াল প্রার্থীরা নাকানি-চুবানি খেতে পারেন।
এবারের নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা নাকি বেশি সচেতন; এমন আওয়াজ সব দিকে। তারা কালো টাকা, পেশিশক্তি, অসৎ, বিদেশে অর্থ পাচারকারী এবং দুর্নীতিবাজদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাবে না–এমন রব উঠেছে। তবে, বাস্তবে তা কতটা মানা হচ্ছে, তা ভোটের ফলাফলই বলে দেবে।
নির্বাচনে হেভিওয়েট প্রার্থীদের দিকে গণমাধ্যমের ফোকাস বেশি হওয়ায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। তাদের মতে, মিডিয়া কেবল ডাকসাইটে এবং আলোচিত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তৃণমূল বিএনপির প্রচারকে ফোকাস করছে, স্বতন্ত্র বা অন্যদের বেলায় যা নগন্য।
এবার নির্বাচনে যেসব ভোটার ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হতে পারে, তারা হলেন, যারা প্রথম ভোটার হয়েছেন বা তরুণ ভোটার, নারী ভোটার, গার্মেন্টস শ্রমিক, চা বাগানের শ্রমিক, সমতল এবং পাহাড়ের আদিবাসী, নিম্ন আয়ের মানুষ, সুইপার বিশেষ করে দলিত ও হরিজন, মুচি, বেঁদে সম্প্রদায়, নিম্ন বর্ণের মানুষ, ড্রাইভার, ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন: কাদিয়ানী, আহলে হাদিস ও শিয়া। এ ছাড়া, ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় একসঙ্গে থাকা বিহারি সম্প্রদায় ভোটে ফ্যাক্টর হতে পারেন।
২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর সরকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার পর নির্বাচনি আইন সংশোধন হয়েছে। এখন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ভোটে দাঁড়াচ্ছেন এবং দলবেঁধে কেন্দ্রে গিয়ে ভোটও দিচ্ছেন। এ ছাড়া বস্তিবাসী, ভাসমান বা ফ্লোটিং ভোটাররা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হবেন।
এবার নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে পারে ইসলামিক বা ধর্মীয় ভোট। সারা দেশে অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে। এর বেশির ভাগ সুন্নিদের দ্বারা পরিচালিত কওমি মাদ্রাসা। যেসব মাদ্রাসা হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণে তাদের ভোট কোন প্রার্থী পাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রার্থীদের অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভোটের প্রচার-প্রচারণা চালাতে হয়েছে; করতে হয়েছে ক্যালকুলেশন। এখন দেখার বিষয় কতটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্নে ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারছেন!
এবার দলীয় প্রার্থীরা ভোটারদের কতটা মন জয় করতে পেরেছেন সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের মূল শক্তি দলীয় ভোটার। অনেক প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজের ভোট যেমন আছে, তেমনি যোগ হতে পারে মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট।
এ ছাড়া, প্রার্থীর বাবা-দাদার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় পরিচয় ও ইমেজ, বংশ পরিচয় (যেমন চৌধুরী, কাজী, খান, দেওয়ান, মিয়া, মোল্লা বংশসহ নানা ইস্যু ভোটে ফ্যাক্টর হবে। ঘোষণা দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে না এলেও মামলা, হামলার ভয়ে তাদের স্থানীয় ভোটাররা ভোট দিতে আসে কী না, তা দেখার বিষয়!
এবার প্রার্থীদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হলো একদিকে বিএনপি-জামায়াত জোটের দলীয় কর্মী-সমর্থক এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে নাও পারে। অন্যদিকে, স্থানীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচ, এলাকার হিসাব-নিকাশ, আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞ্যাতিগুষ্ঠীর লোকজন ভোটে দাঁড়ালে ভোট না দিয়েও পারা যাবে না। তবে সব কিছু ছাপিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দলীয় বিষয়!
এবার প্রভাবশালী অনেক প্রার্থী জনসংযোগের সময় হুমকি দিয়ে বলেছেন, যেসব ভোটার নির্বাচনের দিন ভোট দিতে আসবেন না, তাদের বয়স্ক ভাতা, দুস্থভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সরকারি ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বাদ দেয়া হবে। এটি নির্বাচনি আচরণবিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন! সব দল ভোটে না থাকায় ‘নন আওয়ামী লীগার’ যেসব ভোটার ভোট দিতে যাবেন না, বলে মন স্থির করেছিলেন, তারাও এখন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের হুংকারে ভয় পেয়ে ভোট দিতে যেতে পারেন।
মূলত ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি বাড়া এবং ভোটের দিন রক্তক্ষয়ী সংঘাত বা হতাহতের পরিমাণ কম হলে নির্বাচন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ নির্বিঘ্নে পাড়ি দিতে হলে প্রার্থীদের উচিত হবে হাতে-পায়ে ধরে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে অথবা স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি, মুরুব্বি বা ধর্মীয় নেতা বা মসজিদের ইমামদের সহযোগিতায় ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। তাহলেই ভোটের টার্নওভার বাড়বে।
ঢাকার অনেক এলাকায় বস্তি আছে। এখানে নিম্ন আয়ের মানুষ গাদাগাদি করে থাকে। গুলশানের কড়াইল বস্তি, মহাখালীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প, মিরপুরের কালশি বিহারি ক্যাম্প, আগারগাঁও, মিরপুরে মোল্লার বস্তি, কারওয়ান বাজার এলাকা, তেজগাঁও, টিটিপাড়া, জুরাইন, শ্যামপুর, কামরাঙ্গীর চরসহ বিভিন্ন এলাকায় নিম্ন আয়ের ভোটারের হার অন্য এলাকার চেয়ে বেশি। বস্তিবাসী শহরে ভোটারদের কারণে এবার অনেক আসনের রেজাল্ট পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে!
ইসলামিক ভোটের হিসাব-নিকাশ দারুণভাবে প্রভাবিত করে নির্বাচনে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে সাতশর বেশি কওমি মাদ্রাসার প্রায় নব্বই ভাগই হেফাজতে ইসলামের দখলে। কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাকের তথ্য মতে, দক্ষিণের চেয়ে ঢাকার উত্তরে মাদ্রাসা ও ভোটার বেশি। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, ফরিদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, পল্লবী, লালবাগ, বারিধারা ও উত্তরায় কওমি মাদ্রাসা বেশি। এর মধ্যে সূত্রাপুরের ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, লালবাগ মাদ্রাসা, মোহাম্মদপুরের জামেয়া রহমানিয়া, মোহাম্মদিয়া, মিরপুরের আরজাবাদ মাদ্রাসা, জামেউল উলুম, পল্লবীতে মিরপুর-৬ নম্বর এবং বারিধারার মাদানিয়া মাদ্রাসা অন্যতম। সব মিলিয়ে ঢাকায় মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক মিলে হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক ভোটার কয়েক লাখ। সুতরাং, মাদ্রাসার এই ভোটব্যাংক শেষ পর্যন্ত কোন কোন প্রার্থী কীভাবে বাগিয়ে নেন তার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে ভোটের ফল।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, সিলেট এবং বরিশাল বিভাগে ‘জেলা কোটা’ বিরাট ফ্যাক্টর। নোয়াখাইল্লা ভোটার, বরিশাইল্লা ভোটার, চাটগাঁইয়া, ফেনী, কুমিল্লা, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, চাঁপাই, রংপুর ছাড়াও উত্তরবঙ্গ কোটার ভোটাররা নির্বাচনি ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভোটের ডামাডোলের মধ্যে গোপনে মেজবান, পিকনিক, মতবিনিময়, খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা অনুষ্ঠানের নামে জেলা সমিতিগুলো প্রোগ্রাম করেছে।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা গ্রুপ খুলে নির্বাচনি প্রচার করেছেন অনেক প্রার্থী, ভোটার এবং তাদের সমর্থকরা। এক্ষত্রে জেলা সমিতি, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই গ্রুপ, এসএসসি, এইচএসসির বিভিন্ন ব্যাচ এবং গ্রুপ বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তাই ডিজিটাল প্রচার-প্রচারণার কারণে অনেক আসনে ভোটের হিসাব পাল্টে যেতে পারে।
টাকাও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয় ভোটের ক্ষেত্রে। শিল্পপতি, কালো টাকার মালিক প্রভাবশালী অনেক প্রার্থী এবং তাদের কর্মীরা রাতের আঁধারে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হাতে নগদ টাকা দিয়ে ওয়াদা করান। অনেক সময় টাকা দেয়ার সময় তারা পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করান। এখন তো ডিজিটাল যুগ, তাই অনেক প্রার্থী নগদ টাকা দিতে গড়িমসি করে বা ভয় পান। সবচেয়ে ভালো লেনদেন হলো বিকাশ কিংবা নগদের মাধ্যমে ডিজিটাল লেনদেন। তাই ভোটকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের অ্যাকাউন্টে ঢুকছে অর্থ। এখানেও অবৈধ অর্থের মালিক প্রার্থীদের জয়জয়কার!
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) মুখ্য পরিচালক ড. আবদুল আলীমের মতে, ভোট ‘বায়িং’ বা কেনাবেচা এই উপমহাদেশের অপরাধমূলক একটি প্রাচীন সংস্কৃতি। তবে এখন ডিজিটাল সিস্টেম হওয়ায় অনেক প্রার্থী তার লোকদের দিয়ে গরিব ও নিম্ন আয়ের ভোটারদের অনলাইনে অর্থাৎ বিকাশ বা নগদ বা রকেটের মতো অ্যাপসের মাধ্যম অর্থ লেনদেন করছে, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, যা নির্বাচন কমিশন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভোট বায়িং নিয়ন্ত্রণে এদেশে আইন থাকলেও এর কঠোর প্রয়োগ নেই।
ড. আলীমের মতে, নিয়মিত ভোট কেনাবেচা ঠেকানো খুব কঠিন কাজ, এটি নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবে গোয়েন্দা নজরদারি ও তৎপরতাও দৃশ্যমানভাবে বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সহযোগিতা নিতে হবে বাংলাদেশে ব্যাংকের। তারা মোবাইলে অর্থ লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় অস্বাভাবিক লেনদেনকারী বিকাশ, নগদ. ইউপে, রকেটসহ নানা অ্যাপসে নজরদারি করে এসব অসাধু ব্যক্তিদের ধরে আইনের কাছে সোপর্দ করতে পারলেই ডিজিটাল ভোট বেচাকেনা কিছুটা হলেও কমতে পারে।
এদিকে, সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজনের প্রধান সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলছেন, ডিজিটাল ভোট কেনাবেচা বন্ধে সাধারণ ভোটারদের সচেতন করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নানা অনুষ্ঠান এবং ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দলের প্রার্থী এবং ভোটারদের সচেতন করে তোলার কাজ তাদের করার থাকলেও এ নিয়ে ইসির দৃশ্যমান কোনো কর্মকাণ্ড এবার দেখা যায়নি। তবে দলগুলো যদি কালো টাকার প্রভাবমুক্ত সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন দিত, তাহলে এসব অসাধু প্রার্থী নিজের ওপর আস্থা রাখতেন; তাদের ভোট কিনতে হতো না।
নির্বাচনে ভোটের খেলা হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি; এই খেলায় বিজয়ী হওয়া এক ধরনের চতুরতা, চ্যালেঞ্জ, কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার বিষয়। তবে ভোটকে রিগিং বা কারচুপিমুক্ত করতে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
সুতরাং সহস্র উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, প্রতিরোধ, বর্জন ও সংশয় পাস কাটিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, কারচুপিহীন ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মন জয় করে কারা আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন, সে অপেক্ষায় আজ দেশবাসী!
লেখক: সাংবাদিক এবং বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে এমফিল গবেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে