Views Bangladesh Logo

পর্ব ২

আমরা তো চাই দেশটি রাষ্ট্রহীন না হোক

Mamunur Rashid

মামুনুর রশীদ

নাট্যজন মামুনুর রশীদ একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের প্রধান পথিকৃৎ। টেলিভিশনের জন্যও অসংখ্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন অসংখ্য টেলিভিশন নাটকে। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। সম্প্রতি তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, শিল্পী-সাহিত্যিকদের অপমান ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ন্যারেটিভ নিয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।

ভিউজ বাংলাদেশ: শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জামিল আহমেদ সম্পর্কে আপনার কী ধরনের প্রত্যাশা আছে ব্যক্তিগতভাবে?

মামুনুর রশীদ: আমি ব্যক্তিগতভাবে ওনাকে খুব সম্মান করতাম, এখনো করি। অবশ্য মানুষের জীবনে ভুল-ক্রটি থাকতে পারে। তিনি খুব প্রফেশনাল লোক, শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত। থিয়েটারের ব্যাপারে তার ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার যথেষ্ট সুনাম আছে। সেদিক থেকে তো তিনি খুবই ভালো। আমি ভেবেছিলাম তিনি বিষয়গুলোকে একেবারে ভেতর থেকে বুঝবেন; কিন্তু একটা চিন্তা মনে হয় তার ভেতরে আছে ‘নিউ ন্যারেটিভ’ তৈরি। এই ‘নিউ ন্যারেটিভ’ তৈরির চিন্তা থেকেই এই অঘটনগুলো ঘটছে। অথচ আমরা যে ন্যারেটিভগুলো এতদিন তৈরি করে এসেছি, তার সঙ্গে তো উনিও ছিলেন। আমার সঙ্গে উনি একাধিক নাটকে কাজও করেছেন। আলো-সেটের কাজ করেছেন। সেদিক থেকে তার একটি আর্টিস্টিক এক্সিলেন্স আছে।

আমি দেখেছি, যাদের আর্টিস্টিক এক্সিলেন্স থাকে তারা পলিটিক্সটা বুঝে। যেমন মোটাদাগে একটি উদাহারণই দিই- সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ যদি আপনি দেখেন দেখবেন কী ব্যাপক রাজনৈতিক ম্যাসেজ আছে তার মধ্যে। ‘পথের পাঁচালী’র মধ্যে আছে। সত্যজিৎ রায়ের জীবনের শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’; সেখানেও কিন্তু আছে। উৎপল দত্ত যখন জেলে ছিলেন, সত্যজিৎ রায় রাস্তায়ও দাঁড়িয়েছেন তার মুক্তির জন্য। ওনার সবচেয়ে বড় সমস্যা, ওনার যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এটা ঠিক আমরা বুঝতে পারি না। সোসাইটির কাছে যে কমিটমেন্ট সেটাও আমরা বুঝতে পারি না। এই দুটি না বোঝার কারণেই বোধ হয় এই ঝামেলা-জটিলতাগুলো।

ভিউজ বাংলাদেশ: সোস্যাল মিডিয়াতে অনেক তরুণ প্রজন্মের লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী অভিযোগ করেছেন, জামিল আহমেদ স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন- ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মামুনুর রশীদ: এটা নিয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেয়া কঠিন। তবে আমার মনে হয় এর মধ্যে আংশিক সত্যতা আছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: গণঅভ্যুত্থানের পাঁচ মাস চলে গেছে। এই পাঁচ মাসের ভেতরে আমাদের কালচারে রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের আঘাত এসেছে। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সংস্কৃতিকর্মীরা আগে যে ধরনের আর্থিক সুবিধাগুলো পেতেন, সেগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। নাটক মঞ্চে কম হচ্ছে, কবিতার অনুষ্ঠান কম হচ্ছে, শিল্প-সংস্কৃতির অনুষ্ঠানগুলো প্রায় নেই বললেই চলে। এই না থাকাতে কী ধরনের সমাজে ম্যাসেজ যাচ্ছে?

মামুনুর রশীদ: খুব দুঃখজনক। আপনি যেটা বলেছেন, এটা যথার্থ সত্য কথা বলেছেন যে, গত পাঁচ মাসে সংস্কৃতিকর্মীরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। শুধু তাই না, এর চাইতে গভীর এবং জটিল যেটা, সেটা হচ্ছে সবাই একটা অসাধারণ ডিপ্রেশনে ভুগছেন। জাতি যেমন অনিশ্চয়তায় ভুগছে- কবে নির্বাচন হবে, কবে রাজনৈতিক দল আসবে, কবে এই অনিশ্চয়তার অবসান হবে- তার জন্য যেমন অপেক্ষা করছে, শিল্পীদের অবস্থাও তাই। সব জায়গায়, সব সংগঠনে একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। একটা না, একাধিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। আমাদের নাটকের যারা শিল্পী, তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে অকারণে। বড় কোনো কারণ থাকত, তাহলে একটা কথা। এখানে তো স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপার নেই; কিন্তু তার মধ্যেও হঠাৎ উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে কারও কারও মধ্যে। সংগঠনগুলো নানাভাবে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিভক্তির ফলে যেটা দাঁড়াচ্ছে। আমি তো শিল্পী, লেখক-সাহিত্যিক সবার সঙ্গে কাজ করি। সংকটকালেও কাজ করেছি।

আমাদের কতগুলো সংকট আছে আপনাকে আগেই বলেছি। বিশেষ করে বাংলাদেশে শিল্পীদের ব্যাপারে কোনো শাসকগোষ্ঠীরই কোনো উদ্বেগ দেখিনি এখন পর্যন্ত। অর্থনৈতিকভাবে সব শিল্পী সফল নয়। অনেক ভালো শিল্পী-অভিনেতা আছেন, আমাদের সঙ্গে তারা অভিনয় করেন; কিন্তু তাদের হয়তো অর্থনৈতিক সাফল্যটা আসেনি। এই লোকগুলো কী করে বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকে অল্প আয়ে। কাজ শুরু হয়ে গেলে তারা কিছু কাজ পায়। অন্তত মাসে যদি চার-পাঁচ দিন কাজ পায়, তাহলে কিন্তু তাদের বাড়ি ভাড়াটা হয়, খাওয়ার অবস্থাটা হয়, ওষুধ কেনার টাকাটা হয়। সেদিন এক বয়স্ক অভিনেত্রী আমাকে বলছিলেন, ভাই-আমার তো ওষুধ কেনার পয়সাও হচ্ছে না। তার মানে সারা মাসে উনি এক দিন-দুদিনও কাজ পাচ্ছেন না।

আমরা করতাম কি, সংগঠনগুলো থেকে চেষ্টা করতাম। যখন মাত্র একটি টেলিভিশন ছিল- বাংলাদেশে টেলিভিশন, তখন কিন্তু বয়স্ক শিল্পীদের আমরা কাজে নিতে বলতাম। অন্তত দুটি পার্ট দিয়ে হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখানেও যখন প্যাকেজ নাটক এলো তখনো কিন্তু আমরা এটা মাথায় রেখেছি; কিন্তু এখন শিল্পীদের কী যে দুর্ভাগ্য! করোনার সময় কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তখন আমাদের সংগঠনগুলো থেকে টাকা সংগ্রহ করে নানানভাবে ব্যবস্থা করেছি। তাদের বাড়ি বাড়ি খাবার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি। এটাও করতে হয়েছে। এই শিল্পীদের যে সংকটটা, শিল্পীদের ওয়েলফেয়ার দেখারও কেউ নেই। এখন তো আরও নেই।

এখন পলিটিক্যাল পার্টি ক্ষমতায় থাকলে সুবিধা হয়। সেটা হচ্ছে আমরা একজন মন্ত্রী-এমপিকে গিয়ে ধরতে পারি, এই অবস্থা, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা হলেও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়; কিন্তু এদের তো (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) আমরা কাউকেই চিনি না। কিছু এনজিও লোক উপদেষ্টা হয়ে বসেছেন, জনবিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণভাবে, তাদের কেউ চিনে না। এবং তারাও কোনো সামাজিক দায় গ্রহণ করার প্রয়োজনবোধ মনে করেন না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, গত দুদিন আগে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের খুনি মেজর আবার স্বহিমায় ফিরে এসেছেন। তিনি এসে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন আরেক রাজাকারপুত্রকে। সেখানে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নয়, মাত্র ৩ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। এই ন্যারেটিভকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন।

মামুনুর রশীদ: উনি কি ৩ লাখ গুনেছেন? যে ন্যারেটিভটা এতদিন ধরে বলা হয়ে আসছে, এতদিন তিনি তার বিরোধিতা করেননি কেন? এতদিন বলেননি কেন? এতদিন তার বলা উচিত ছিল। তিনি অনেক মারাত্মক কথা বলেছেন, ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় বাংলাদেশ বেতার থেকে আমরা একটা ঘোষণাই শুনেছি- আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে আমরা হত্যা করেছি। তো সেই লোকটাই ৫০ বছর পর বলছে যে, উনি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। কী আশ্চর্য কথা। আর জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা না। জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কি ডালিমের কাছ থেকে নিতে হবে? এমন নানা কথা তিনি বলেছেন, যেটা খুব ইরিলিভেন্ট- অপ্রয়োজনীয়। ইতিহাসের কাছে একটি দায় রয়েছে, সে হত্যাকারী। আরেকটি দায় সে তৈরি করল এই সাক্ষাৎকার দিয়ে।

আমাদের দেশে প্রবাসী কিছু ইউটিউবার আছে। প্রবাসে খুব নিরাপদে থাকেন। আমরা যারা দেশে থেকে, বছরের পর বছর ধরে, ৫২ বছর ধরে প্রতিবাদ করেছি, আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছি। নানারকম সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছি। লিখেছি, টকশোতে বলেছি। আমরা কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বলেছি। ওনাদের কোনো ঝুঁকি নেই। ওনারা অনেক দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এই বিভ্রান্তির অবসান হওয়া দরকার। একজন আছে পিনাকী। ওরে বাপরে বাপ। সে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর। তার কোনো কোনো কথায় মনে হয়, সে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে সার্ভ করছে। বাংলাদেশের যে গোষ্ঠীটা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরোধিতা করেছিল, তাদের সে নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তার বক্তব্যে। আবার এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধেও সে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে।

আমরা তো চাই দেশটি রাষ্ট্রহীন না হোক। সরকার যখন থাকে না, তখন কিন্তু দেশ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। দেশ তো ধরেন হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের এই ভূখণ্ড; কিন্তু রাষ্ট্রটা তো জনগণ বানায়। রাষ্ট্র, সরকার, সেনাবাহিনী, আমলাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রটা বানায়। আমাদের এখানে একটা সিচুয়েশন হয়েছিল যখন দেশ ছিল কিন্তু রাষ্ট্র ছিল না; কিন্তু এখন একটি রাষ্ট্র আছে, তারা সংবিধান মানছে, দেশের আইন কানুন মানছে। কতটা মানছে সেটা অন্য ব্যাপার।

গত ৫২ বছর ধরে আমি সবসময় বলে আসছি, আমরা রাষ্ট্রকে মানবিক করতে পারিনি। রাষ্ট্রটাকে জনগণের করতে পারিনি। এটা আমি বলেছি। আসলেই তো, আমাদের রাষ্ট্রটা কি মানবিক? সব মানুষের রাষ্ট্র হতে পেরেছে এটা? মাত্র কয়েকজন মেজর রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে দেশটাকে হাইজাক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মানে আমাদের যে শাসকগোষ্ঠী, তার আয়তনও খুব ক্ষুদ্র। সবশ্রেণির মানুষের যে অংশগ্রহণ থাকে রাষ্ট্রে, সেটা কিন্তু আমাদের দেশে নেই। অতীতের সরকারগুলোরও ছিল না। এখন যারা আছে তাদের তো থাকার প্রশ্নই আসে না। কাজেই একটা রাষ্ট্র এখন আছে, সেটাকে প্রবাসীরা- বিশেষ করে পিনাকী ভট্টাচার্য একে আঘাত করছে, ওকে আঘাত করছে, তাকে আঘাত করছে। অনেক আঘাতই তাৎপর্যপূর্ণ এবং যুক্তিযুক্ত। এটা একটা সমস্যা। ইলিয়াস আরও করছে। তো, দেশে থাক, ঝুঁকি নাও, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে থাক, তারপর সমালোচনা কর কোনো অসুবিধা নেই।

(চলবে)


আরও পড়ুন

প্রথম পর্ব
মূলধারার সংস্কৃতিচর্চা থেকে আমাদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ