Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

পর্ব ১

পেলে-পুষে ইলিশকে আমাদের জলসীমায় রাখতে হবে

Dr. Md. Anisur Rahman

ড. মো. আনিছুর রহমান

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

ইলিশ গবেষক ড. মো. আনিছুর রহমান। দায়িত্ব পালন করেছেন চাঁদপুরের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা নদীকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক হিসেবে। এখন এলপিআরে আছেন। ইলিশ গবেষণা, জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ড. আনিছুর রহমানের। মা ইলিশ রক্ষায় ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ও ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ মুহূর্তে কী কী ব্যবস্থাপনা ও পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইলিশের দাম আকাশচুম্বি হওয়ার পেছনের খবরসহ ইলিশ কেন আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সারথি এবং সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতির অনুষঙ্গ এবং পররাষ্ট্রনীতিরও প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠল- সেসব বিষয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কে এম জাহিদ

ভিউজ বাংলাদেশ: বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ মাছের সম্পর্ক কেমন?

ড. আনিছুর রহমান: বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটি আমাদের জাতীয় মাছ এবং ঐতিহ্যেরও প্রতীক। এর স্বভাবটাই পরিভ্রমণশীল বা মাইগ্রেটরি, বৈচিত্র্যময়। ট্রান্সবাউন্ডারি ইস্যুতেও শক্তিশালী। কোনো একটি সাগরের মাছকে নদী বা পুকুরের মিঠা পানিতে ছেড়ে দিলে অস্মোপলিটন প্রেসার সহ্য করে সে আর টিকে থাকতে পারে না। আবার মিঠা পানির একটি মাছকে সাগরে ছেড়ে দেয়া হলে অস্মোপলিটন ও অস্মোরেগুলেটরির সঙ্গে অন্যান্য কারণে সেও টিকতে পারবে না; কিন্তু একমাত্র ইলিশ, যে উভয় পরিবেশেই স্বাচ্ছন্দ্যে চড়ে বেড়াচ্ছে। এই অভিযোজন ক্ষমতা যেন বাঙালির শৌর্য-বীর্যেরই প্রতীক। প্রতিকূলতায় টিকে থাকার ক্ষমতার এই পারস্পরিক সম্পর্কের কারণেও এই মাছ আমাদের অতি আপন ও অতিপ্রিয় মাছ।

ভিউজ বাংলাদেশ: বিশ্বজুড়ে কত প্রজাতির ইলিশ আছে? উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা?

ড. আনিছুর রহমান: বিশ্বজুড়ে পাঁচ প্রজাতির ইলিশ আছে। ১১টি দেশে ইলিশ পাওয়া গেলেও উৎপাদনে বাংলাদেশই প্রধান ও প্রথম স্থানাধিকারী। বিশ্বের প্রায় ৮৬ শতাংশ ইলিশের মালিক আমরা।


বাংলাদেশের জলসীমা বঙ্গোপসাগর, নদনদী ও তার মোহনা এবং একই সঙ্গে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। তবে প্রধান স্টেকহোল্ডার আমরা। দেশের সুবিশাল এই জলসীমায় ইলিশের পাঁচটি প্রজাতির মধ্যে তিনটি পাওয়া যায়। প্রথমটি হচ্ছে আমাদের জাতীয় মাছ টেনুয়ালোসা ইলসা (Ttenualosa ilisha), যাকে আমরা পদ্মার ইলিশ বলি। দ্বিতীয়টি টেনুয়ালোসা টলি (Tenualosa toil), যাকে আমরা চন্দনা ইলিশও বলে থাকি। আর তৃতীয়টি হচ্ছে, ইলিশ কেলি বা কানাগুর্তা, স্থানীয় ভাষায় যাকে গুর্তা ইলিশও বলা হয়। গুর্তা ও চন্দনা ইলিশ কিন্তু পদ্মার ইলিশের মতো পরিভ্রমণশীল স্বভাবের নয়। আমাদের জাতীয় ইলিশ মাছটি সাগর-নদী ও মোহনা বেয়ে সবখানেই অবাধে চলাচল করতে পারে ও এর অভিযোজন ক্ষমতাও অনেক বেশি। এমনকি, অন্য দেশেও চলাচল করতে পারে। ভৌগোলিক সীমারেখা সে বোঝে না। সমুদ্র দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের যে কোনো দেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে অন্য দেশ-সাগর-মহাসাগরেও চলে যেতে পারে।


অতএব, তাকে পেলে-পুষে ভালোবাসা দিয়েই বাংলাদেশের জলসীমায় রাখতে হবে এবং সেজন্য যা যা করা দরকার, তাই-ই করতে হবে আমাদের।

ভিউজ বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইলিশ এখন ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মাছ’ হয়ে উঠেছে। আবার ‘কূটনীতিরও হাতিয়ার’ হচ্ছে। এর কারণ কী?

ড. আনিছুর রহমান: মাছের রাজা ইলিশ আমাদের স্বাদ, পুষ্টি ও প্রোটিনের চাহিদা মেটাচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি ও উৎসবাদিতে এর নানাবিধ ব্যবহারের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যও অনেক বেশি। অনেক অনুষ্ঠানাদি তো এই মাছ ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। আমাদের দেশে তাই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জিআই পণ্য।


ইলিশ ডিম ছাড়তে, খাবার খেতে নদী ও নদীর মোহনায় এসে ধরা পড়ছে। সাগরেও ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। গড় হিসাবে বাংলাদেশে গত দুই-তিন বছরে ইলিশের উৎপাদন ক্রমেই বেড়ে এ বছর দাঁড়িয়েছে রেকর্ড প্রায় ৫ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টনে। এসব কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উচ্চ্যমূল্যে রপ্তানির পাশাপাশি ‘পররাষ্ট্রনীতির হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করায় ইলিশ এখন ‘কূটনৈতিক সম্পর্কেরও’ অনুষঙ্গ। দেশের জনগণকে আগে ইলিশের স্বাদ নেয়ার অধিকার দিতে হবে। এটি আমাদের ঐতিহ্যিক ও ভৌগোলিক অধিকার। সব মানুষের কাছে এই মাছকে সহজলভ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে সরকার যে চেষ্টা করছে, তাও ইতিবাচক।

ভিউজ বাংলাদেশ: মৎস্য অধিদপ্তরের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, ২০০৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন থেকে প্রায় ৬ লাখ টনে পৌঁছেছে। তবুও দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না কেন? আবার দামও ক্রেতার নাগালের বাইরে কেন?

ড. আনিছুর রহমান: ২০০২-০৩ সালে তো ইলিশ প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল। উৎপাদন ছিল মাত্র ১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টনের মতো। সেখান থেকে সমস্ত গবেষণার ফলাফল কাজে লাগিয়ে ও উচ্চ ব্যবস্থাপনায় এখন ৫ লাখ একাত্তর হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। গবেষকদের পাশাপাশি সম্প্রসারণকর্মী, জিও-এনজিও ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ গণমাধ্যমগুলোও এর স্টেকহোল্ডার। গণমাধ্যমের প্রচার-প্রচারণাও জনসচেতনতা বাড়িয়েছে, নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে ভূমিকা রেখেছে। তবে এটি এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সব হিসাব বা পরিসংখ্যান অনুসারেই ইলিশের উৎপাদন বাড়ায় বাজারে দাম কমে জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে আসার কথা ছিল। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা, ইলিশের দাম দিনকে দিন বাড়ছেই। এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ মানুষ হাতই দিতে পারছেন না। যেমন, এ বছরের শুরু থেকেই ইলিশের বাজার চড়া ছিল। ভারতে রপ্তানির ঘোষণায় দাম বেড়েছে আরেক দফা, যা কাম্য ছিল না। ইলিশের দাম নিয়েই এখন বাজার-ঘাট থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে, সমাজে ও দেশজুড়ে সবখানেই সমালোচনা। তা তো হবার কথা ছিল না। কথা ছিল, সবাই কিনতে পারবেন, ইলিশের স্বাদ নিতে পারবেন দেশবাসী।

তাহলে গলদটা কোথায়? সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। আর কাজও করতে হবে সবাইকেই। গবেষক হিসেবে আমি বলতে চাই, একটি বা এক কেজি ইলিশ সাগর-নদী-মোহনায় ধরা থেকে মাছ-ঘাট ও পরিবহন খাত পার হয়ে বাজারে আসা পর্যন্ত কত খরচ হয়, আর কত দামে বিক্রি হচ্ছে, সে গবেষণা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। উৎসস্থল থেকে মাছটি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে কয়টি ধাপ অতিক্রম করে আর কোন ধাপে কত টাকা খরচ পড়ে, যে কারণে এর দাম এতটা বেড়ে যায়? যতটা বেড়ে যায় তা অসম্ভব। এতটা কোনোমতেই বাড়তে পারে না। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এখানে অন্য কিছু কারসাজি কাজ করে। এটাকেই এড্রেস এবং সমাধানে কাজ করতে হবে। দাম অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিংও সময়ের জরুরি দাবি। বাজারে যদি তথাকথিত সিন্ডিকেট কাজ করে, তবে যথোপযুক্ত প্রমাণসাপেক্ষে তা ভেঙে দিতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার জেলেদের চাল ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। এদিকে ইলিশের দাম এতো চড়া হলেও জেলেদের জীবন-মান উন্নত হচ্ছে না কেন? সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় কেন?

ড. আনিছুর রহমান: হতদরিদ্র জেলেরা পরিবারকে ফেলে রেখে ১০/১৫ দিনের জন্য গভীর সমুদ্রে চলে যান ইলিশ শিকারে। সঙ্গে জাল, নৌকা বা ট্রলার, জ্বালানি ও খাবার নিয়ে যান। অনেক সময় তারা বড় ঝড় ও ঢেউয়ের তোড়ে হারিয়ে যান। তারপরও বংশ পরম্পরায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পেশায় নিয়োজিত আছেন। বাজারে উচ্চমূল্যে ইলিশ বিক্রি হলেও জেলেরা কিন্তু তা পাচ্ছেন না। কারণ, অধিকাংশ জেলেরই নিজস্ব জাল বা ট্রলার নেই। তারা মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যান। আর ট্রলারভর্তি মাছ এনে ফিশারিঘাটের মহাজন বা দাদনদারদেরই দেন। মহাজনরা সেগুলো স্থানীয় দামে কিনে নেন। তারপর নিজেদের বহন করা সব খরচ কেটে রেখে বাকি টাকা দেন জেলেদের। যা দেন, তাতে তাদের দৈনিক ভাতা, শ্রম বা মজুরির দাম- কোনোটাই ওঠে না। আবার ভোক্তা যে উচ্চমূল্যে ইলিশ কিনছেন, তার এক অংশও পাচ্ছেন না জেলেরা। লাভের অংশ পাচ্ছেন মহাজন থেকে নানা স্তরের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। এগুলো বৈষম্য।


শুধু মূল্য সমন্বয়ই নয়, নিষেধাজ্ঞা থেকে মাছ ধরার সময়সহ সারা বছরই জেলেরা যেন পরিবার-পরিজন নিয়ে চলতে পারেন, তাদের এমন কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। যেন তাদের জীবন-মান চলনসই ও সচ্ছল হয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: ইলিশের ভৌগোলিক কোনো সীমানা নেই। আমাদের দেশে নিষেধাজ্ঞা চলার সময় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা অবাধে ইলিশ শিকার করেন। পাশের দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা না মানা এবং সমন্বয়হীন নিষেধাজ্ঞায় কি বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে?

ড. আনিছুর রহমান: আমরা পুকুরে বা যে কোনো জায়গায় যদি মাছ চাষ করি, তাহলে তা বাড়বে। পুকুরে পোনা ছাড়ি, খাবার দেই, তার ওপরই মাছ বাড়ে। আবার আমরা যদি সাগর, নদী-মোহনাকে পুকুর মনে করি আর সেখানে যদি ইলিশ মাছের পোনা ছাড়ি, তাকে যত্ন আত্তি করি, খাবার ও ব্যবস্থাপনা দেই, একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত তাদের চলাচলে বাধা না দেই বা শিকার না করি এবং ওইসব জায়গাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করি। তাহলে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়বে। যেমন, এই চলমান পুকুররূপী সাগরে এ বছর আমরা ইলিশের পোনা ছাড়ছি ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২২ দিনের চলমান নিষেধাজ্ঞায়। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়াই হলো পোনা ছাড়া। আর ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল- এই ৬০ দিন যে জাটকা নিধনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়, শুধু তারা যেন খেয়ে ও অবাধ চলাফেরা করে ১২/১৩ সেন্টিমিটার থেকে ২৬/২৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে।

জাটকা ইলিশ না ধরে,অবাধ চলাফেরার মাধ্যমে বড় হতে দেয়ার অবাধ সুযোগ তৈরি করাই হলো খাওয়া-দাওয়া দেয়া। তাহলে তার মাইগ্রেটরি চরিত্রের কারণে বিশ্বের যে প্রান্তেই যাক না কেন, ডিম ছাড়ার সময় আবার বাংলাদেশের যে জলসীমায় সে বড় হয়েছে, নিরাপত্তা পেয়েছে, সে অবশ্যই ওই জলসীমায় ফিরে আসবেই। ২-৪ শতাংশ যদি ভারতে চলেও যায়, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। তবে ইলিশ শিকারে বাংলাদেশ যে দুই সময়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়, তা পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সময়ের সঙ্গে মেলে না। তারা যে সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়, তারা মনে করে, সেটাই ঠিক; কিন্তু আমরা মনে করি, আমাদেরটাই ঠিক। এই সমন্বয়হীনতা দূর করে ওই দুই দেশের দুই সময়ের মধ্যেও সমতা বা সমন্বয় আনা অত্যন্ত জরুরি। বাংলা বর্ষপঞ্জি এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার সঙ্গে মিল রেখে কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে সমস্যার সমাধান সুরাহা করতে হবে। তা না হলে আমরা তিন দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কারণ, এই বিশাল জলরাশি ইলিশে ভরে গেলে কাউকেই অন্য কারও জলসীমায় গিয়ে জোর করে বা চুরি করে অথবা সমুদ্রআইন অমান্য করে ইলিশ শিকার করতে হবে না। এখন যেমন ভারত বা মিয়ানমারের জেলেরা নিষেধাজ্ঞা চলার সময় বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে ইলিশসহ অন্য মাছও ধরে নিয়ে যান। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে, তেমনটি আর হবে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশে পাওয়া ইলিশের স্বাদ পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি? কেন দেশের ইলিশ এত সুস্বাদু?

ড. আনিছুর রহমান:  পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে যত ইলিশ পাওয়া যায়, আর বাংলাদেশের জলসীমায় যেসব জাতের ইলিশ পাওয়া যায়, সেগুলো একই জাতের নয়। প্রথমত, জাতের কারণে ইলিশের স্বাদের ভিন্নতা আসে বা হয়। তারপর আবাসস্থল অর্থাৎ লবণাক্ততা কম-বেশির কারণে হয়। পানির গুণাগুণের ওপরও নির্ভর করে এর স্বাদ। মিঠাপানি আর লবণাক্ত পানির তারতম্যোর কারণেও স্বাদ কম-বেশি হয়। কত বেশি দিন স্বাদু পানিতে বা নদীর জলস্রোতে ইলিশ ছিল, তার ওপরেও স্বাদ হয়। কী জাতীয় খাদ্য সে গ্রহণ করেছে, তার ওপরও নির্ভর করে ইলিশের স্বাদ। জলের উপাদান কার্বনডাই অক্সাইড, হার্ডিনিফ্যাল, স্যালানিটি, পিএইচ ও এলকালিনিটি বা খারকতাসহ আরও যেসব গুণাগুণ থাকা জরুরি, আমাদের দেশের জলসীমায় সেগুলোর সবই ভালোমাত্রায় আছে। ফলে এখানে তৈরি খাবারগুলো খেতে এবং এ পানিতে থাকতে পছন্দ করে ইলিশ।

পদ্মা-মেঘনা নদী ও এর মোহনার পানিতে রয়েছে ফাইটো প্লাঙ্কটন বা ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা ও জু প্লাঙ্কটন বা ক্ষুদ্র প্রাণিকণার মতো ইলিশের অত্যন্ত পছন্দের খাবারগুলো। রয়েছে ডায়াটম এবং ডাইনোফ্ল্যাজেলেট, সাইটোপ্লাঙ্কটন, নিটজিয়া, ড্যাফনিয়া, বসনিয়ার মতো মাছটির জন্য অতি সুস্বাদু খাবারসহ নানা উপাদানও। সেগুলো খেয়েই তারা বড় ও মোটাতাজা হয়। খাবারগুলো খেয়ে তাদের শরীরে যে ফ্যাটি অ্যাসিড জমে, বিশেষ করে ওমেগাথ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের কারণেই তারা সুস্বাদু হয়। আবার বয়সভেদে ইলিশের খাবারের পরিমাণ ও পার্থক্যের কারণেও এদের স্বাদের ভিন্নতা আসে।


আমাদের দেশে পাওয়া সাগর ও নদীর ইলিশের স্বাদে ভিন্নতা আছে। সাগরের ইলিশের চেয়ে পদ্মার ইলিশ দেখতেও সুন্দর, স্বাদও বেশি। কারণ, সাগরের ইলিশ গভীর সাগরে ওই একই ধরনের খাবার খেলেও তাদের শরীরের গঠন, রঙ ও চর্বিতে ভিন্নতা থাকে। যেমন, সাগরের ইলিশ একটু সরু লম্বাটে হয়, দেখতে একটু কম উজ্বল ও ধুসর হয়। আর সাধু পানি বা নদীর মোহনার ইলিশ উজ্বল রঙের একটু চর্বিযুক্ত চ্যাপ্টা ও মোটা হয়। এই চর্বির কারণেই মূলত স্বাদ ও গন্ধের পার্থক্য ও তারতম্য হয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের ইলিশের স্বাদ এখন কি আগের দিনের মতোই আছে? রান্না করলে ২-৩ বাড়ি দূরে থেকে এখন আর গন্ধ বা ঘ্রাণ পাওয়া যায় না কেন? 


ড. আনিছুর রহমান: আগে যেসব জাল দিয়ে মাছ ধরা হতো, সেগুলো ছিল হাতেবোনা বা ম্যানুয়াল জাল। আর এখন যে সমস্ত জাল বা ডিভাইস ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর সবই আধুনিক ও অটোমেটিক মেশিনে তৈরি। আগে নৌকা বা ট্রলারে করে পরিপুষ্ট বড় ইলিশ ধরা হতো নদীতে বা নদীর মোহনায়। আর এখন মাছ ধরা হয় বড় বড় জাহাজ বা ট্রলারে করে কারেন্ট জাল দিয়ে। আবার কোন দিক দিয়ে ইলিশ দলবেঁধে চলাচল করছে- সেটিও ইকোফিশ ফাইন্ডার মেশিন বা ট্রুলে নির্ণয় এবং অটোমেশিনের কারেন্টজাল বা চায়না দুয়ারির মতো ক্ষতিকর অনেক রকমের জাল দিয়ে টনকে টন মাছ শিকার চলছে। এই মাছগুলো পরিপুষ্ট বা বয়স্ক না হতেই তাদের ধরা হচ্ছে। আর যাচ্ছেতাইভাবে পরিবহন ও বাজারে সরবরাহ হচ্ছে। সঠিক স্বাস্থ্য ও সঠিক বয়সী না হতেই এবং সুস্বাদু খাবার পাওয়ার আগেই তারা মারা পড়ছে। ফলে সুস্বাদু হয়ে উঠছে না। আবার সময়, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনও ইলিশ বড় ও সুস্বাদু না হওয়ার পেছনে দায়ী।

নদীর মানসম্মত পানিতে ইলিশ আসে ডিম ছাড়তে এবং পছন্দের সুস্বাদু খাবার খেতে; কিন্তু দূষিত ও বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত হয়ে আমাদের দেশের নদী-খাল-বিলের পানির মান খারাপ ও অনিরাপদ হচ্ছে। এসব পানিতে যে খাবার তৈরি হচ্ছে তাও বিষাক্ত, দুর্গন্ধযুক্ত, দূষিত ও অনিরাপদ। এসব কারণে এখন নদীতে ইলিশ আসছে কম এবং যারা আসছে, তারা এসব খাবার খেয়ে আর আগের মতো সুস্বাদু হচ্ছে না। আমরা তাই যে ইলিশই কিনে রান্না করছি, তার স্বাদ ও ঘ্রাণ আগের মতো পাচ্ছি না। এদিকে ভোক্তাদের শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হচ্ছে চাঁদপুরের ইলিশ নিয়েও। বলা হচ্ছে, পদ্মার ইলিশ; কিন্তু তা সত্য নয়। সুতরাং, আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের পাশাপাশি বৃষ্টি না হওয়া এবং পানি দূষণের মতো বিষয়গুলোকেও ধর্তব্যে আনতে হবে। এ থেকে উত্তরণ না করতে পারলে ভবিষ্যতে ইলিশ পাওয়া নিয়েও আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ব।

(চলবে)

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ