উদ্বোধনী সংখ্যা ৫ : বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনা
উদ্বোধনী সংখ্যা ৫ : বাংলা সাহিত্যের সম্ভাবনা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
কোনো সাহিত্যের সম্ভাবনা অন্তর্নিহিত থাকে তার ভাষার মধ্যে। আর ভাষার প্রাণ সজীব থাকে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে; কিন্তু কোনো ভাষাকে বিস্তার লাভের জন্য বেশি প্রয়োজন, সেই ভাষার অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যের অর্থনৈতিক বাজার খুব ছোট কিন্তু এই ভাষার জনগোষ্ঠী বিশাল। মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব ভাষা তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বাংলায় কথা বলেন ২২ কোটির বেশি মানুষ। এই ছোট অর্থনৈতিক বাজারে লেখক, প্রকাশক ও সংশ্লিষ্ট সহযোগীরা খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করতে পারেন না। এই বিষয়টি বাংলা সাহিত্য সম্ভাবনার অন্যতম অন্তরায়। তবে বিশ্বাস করি, এই অন্তরায় আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কাটিয়ে উঠবে।
বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরের পুরোনো। চর্যাপদ আমাদের ভাষার আদি নিদর্শন। অষ্টম শতক থেকে বাংলা সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপে বিবর্তিত হয়। বাংলা ভাষালিপি ও ভাষার ব্যবহার বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা ভাষার মধ্যে শব্দগত ও উচ্চারণগত সামান্য পার্থক্য রয়েছে। বাংলার নবজাগরণ ও সাংস্কৃতিক বিকাশে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তথা বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালি অস্তিত্বের যোগসূত্র রয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের ভাষা আন্দোলন বাংলাকে নতুন জীবন দান করেছে। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইন বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাও ভাষা বিস্তারে বড় সাফল্য এসেছে। সেইসঙ্গে ভাষাশহীদদের সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করাও আমাদের জন্য গর্বের বিষয়; কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষায় প্রচলিত হয় কিংবা সমাজের উচ্চবিত্তরা তাদের সন্তানদের কোন ভাষা শিক্ষায় বড় করেন। আমাদের উচ্চ আদালত কোন ভাষা দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের নাগরিক তৈরি না করে শুধু বিশ্ব নাগরিক তৈরি করা করা কি ঠিক? এটিই এখন বড় প্রশ্ন?
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স) তালিকায় বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে বাংলাদেশ। আমরা জানি জ্ঞানই জীবনপ্রদীপ। জ্ঞান দ্বারাই লিখিত ও পঠিত হয় সাহিত্য। এ কারণে আমাদের জনসংখ্যা বেশি হলেও পাঠকসংখ্য কম; কিন্তু পাঠকসংখ্যা কম হলেও অন্যান্য ভাষার তুলনায় লেখকসংখ্যা কম নয়। বেশি বেশি লেখকসংখ্যার যেমন ভালো দিকও আছে তেমন মন্দ দিকও আছে। মন্দ দিক হলো প্রচুর পরিমাণ মানহীন বই প্রকাশিত হলে পাঠক বিভ্রান্ত হয়ে সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই এই দিকটি এখন নতুন প্রজন্মকে গভীরভাবে ভাবতে হবে।
বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী? এ প্রশ্ন কেবল সাহিত্যিক কিংবা পাঠকদের নয়, অধিকাংশ বাংলাভাষীর। কারণ, স্বাধীনতার ৫২ বছরে একটি শ্রেণি, বড় পরিসরে ইংরেজিতেই কথা বলে। তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কিংবা সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাতে করে দেশীয় সংস্কৃতির সংকট তৈরি হচ্ছে। একজন মানুষ একাধিক ভাষা শিখতে পারে এটা দোষের নয় বরং বিরাট গুণ বলা যেতে পারে; কিন্তু অন্য শিখতে গিয়ে যেন মাতৃভাষার অবজ্ঞা না হয় সেদিকেও খেয়াল করতে হবে। খেয়াল করতে হবে যেমন ব্যক্তিকে সেইসঙ্গে রাষ্ট্রকেও।
অনেক বাঙালি আছেন, যারা ইংরেজিতে লিখে সুনাম কুড়িয়েছেন। যেমন বাঙালি তরুণী মেঘা মজুমদার। তার ‘আ বার্নিং’ নামের ৩২০ পাতার প্রথম উপন্যাসের প্রশংসা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ‘দ্য নিউ ইয়র্কার-এর পাতায় পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। বলা যেতে পারে দুই দশক আগে এমনই এক বাঙালি মেয়ে ঝুম্পা লাহিড়ীর গল্প সংকলন ‘ইন্টারপ্রেটর অব ম্যালাডিজ-এর কথা। সেটাও ছিল লেখকের প্রথম বই। আর প্রকাশ মাত্রই সেই বই নিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল পশ্চিমা দুনিয়ায়।
তাহমিমা আনামের অ্যা গোল্ডেন এজ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত। এ ছাড়া তাহমিমা আনাম ‘দ্য গুড মুসলিম’ গ্রন্থের রচয়িতা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জিয়া হায়দার রহমান ২০১৪ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ প্রকাশ করেন। ২০১৫ সালে গ্রন্থটি সাহিত্যে জেমস ট্যাইট ব্ল্যাক প্রাইজ অর্জন করে। প্রথম বইয়ের জন্যই জিয়া হায়দার সমুজ্জ্বল প্রশংসা এবং অভিনন্দন লাভ করে, ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’-এর ভাষায় যা ‘আশ্চর্যজনকভাবে অর্জিত’।
২০০৩ সালে মনিকা আলীর ব্রিক লেন ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য ছোট তালিকাভুক্ত হয়। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ফায়েজা হাসানাতের প্রথম ছোটগল্প সংকলন দ্য বার্ড ক্যাচার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ-এ লিঙ্গ আকাঙ্ক্ষা, পারিবারিক ভালোবাসা এবং পরিচয় ও পরিবার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। শাজিয়া ওমরের ‘লাইক অ্যা ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই’ গ্রন্থে ঢাকার মাদকাসক্ত বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নেশাচ্ছন্ন ও ধোঁয়াশাময় জীবন পরিস্ফূটিত হয়েছে। রাশিদ আসকারী ইংরেজি ভাষায় গল্প লেখার মতো যথেষ্ট শৈল্পিক মেধার প্রদর্শন দেখিয়েছেন। তার ছোট গল্পের সংকলন নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান অ্যান্ড আদার স্টোরিস (২০১১) ফরাসি ও হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কাজী আনিস আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন মাই হ্যান্ডস’ বইটিও ইতোমধ্যে দারুণ সারা ফেলেছে। এভাবে অনেকের নাম বলা যেতে পারে যেমন, সাজিয়া ওমর, ফারাহ গজনবি, মাহমুদ রহমান, মারিয়া চৌধুরী, মুনিজ মজনুর, সাদ হোসেন, শর্বরী আহমেদ, শ্রাবন্তী নার্মিন আলি, জাভেদ জাহাঙ্গীর, আইমদী হোসেন, নুজহাত মান্নান, রুমানা সিদ্দিক, রুবানা হক, লীমান সোবহান, আজফার হোসেন, আদিব খান, নিয়াজ জামানসহ অনেক সাহিত্যিকের। এই বিষয়টি দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের লেখার বিষয়বস্তু জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে, শুধু ভাষার মাধ্যম হচ্ছে ইংরেজি।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত দুঃখবোধে মাতৃভাষা ছেড়ে আবার ফিরে এসেছেন। অথচ তার অমর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এখন পেঙ্গুইন থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত হয়েছে। কবিগুরু তার গীতাঞ্জলির অনুবাদ তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে এনে দিয়েছেন বিরল সম্মান। নীরদ সি চৌধুরী ইংরেজিতে আত্মজীবনী লিখেছেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা ও চর্চা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।
সবচেয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে।
সাম্প্রতিক এ ধারা অব্যাহত থাকায় গবেষকরা মনে করছেন, ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ যেমন বাড়ছে, তেমনি এ ভাষার প্রসার ও চর্চা বেড়ে চলেছে।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে প্রথম বারের মতো বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের মাধ্যমে জাতিসংঘের সদস্য পৃথিবীর সব দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে পারে, বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি জাতির জন্য রয়েছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তার নাম বাংলাদেশ। তাই নতুন প্রজন্মকে আশা হারালে চলবে না, বরং সমস্যা চিহ্নিত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক: কথাশিল্পী ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে