Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক কেন পুঁজিবাদী দেশের স্বার্থে কাজ করে?

Anu  Muhammad

আনু মুহাম্মদ

শনিবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৩

ত শতাব্দীতে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সেই সময় বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ১৯৪৩-৪৪ সালের মধ্যে মোটামুটি বুঝা যায়, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন মিত্র শক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করতে যাচ্ছে, এটাও পরিষ্কার হয়ে যায়। জার্মানি, জাপান যুদ্ধে পরাজিত হবে এটা ক্রমেই পরিষ্কার হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব ব্যবস্থা কীভাবে চলবে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তা নিশ্চিত করার জন্যই মূলত বিশ্বব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

এ ছাড়া যুদ্ধে যারা পরাজিত হতে যাচ্ছে, তাদের সম্পদ কীভাবে ভাগ-বাটোয়ারা করা হবে, এসব নিয়ে দরকষাকষি শুরু হয়। সে সময় বিশ্ব অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ব্রিটেন থেকে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস অংশগ্রহণ করেন। এ সভাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হওয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত পুরো বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কেন্দ্র ছিল ব্রিটেন। ফলে যুদ্ধোত্তর বিশ্ব অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হবে, সে-সংক্রান্ত আলোচনা সভা ব্রিটেনই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির ভরকেন্দ্র দ্রুত ব্রিটেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করে, তারা বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্বের আসনে চলে আসে। বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির পরমিাণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। বরং এ যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্র এটা প্রমাণ করতে সামর্থ্য হয় যে, অর্থনৈতিক এবং সামরিক দিক থেকে তারা বিশ্বব্যাপী অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এরই প্রতিফলন হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হবে সে-সংক্রান্ত সভাটি যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হওয়া। কোনো দেশে নীতি নির্ধারণীমূলক সভা হলে সংশ্লিষ্ট দেশটির তাকে প্রভাবিত করার সুযোগ থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সে কাজটিই অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছে। সেই কনফারেন্সের মধ্য দিয়েই বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ গঠিত হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের নাম ছিল ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। কারণ যুদ্ধোত্তর বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন পুনর্গঠনের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আইএমএফকে দায়িত্ব দেওয়া বিশ্বের মনিটারি ব্যবস্থাকে সমন্বয় করার জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদী বিশ্বের জন্য ভীতির কারণ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুরো বিশ্বব্যবস্থার ওপর প্রভাব বিস্তার করুক এটা কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেন চাচ্ছিল না। তাই তারা এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। যুদ্ধ শেষ হবার আগেই তারা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলে। মার্কিন এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর ভবিষ্যৎ বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।

আমরা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এমন কোনো সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা গ্রহণ করে না, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পুঁজিবাদী বিশ্বের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ১৯৪৪ সালে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বিশ্বব্যাংকের প্রধান হবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যতিত অন্য কোনো দেশের কেউ বিশ্বব্যাংকের প্রধান হতে পারবেন না। একটি প্রতিষ্ঠানে যিনি প্রধান হবেন, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের ওপর তা নিয়ন্ত্রণ থাকবে এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থ মন্ত্রণালয় সেটাও বিশ্বব্যাংকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করবে। আর আইএমএফের প্রধান হবেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশের নাগরিক। এভাবে তারা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে নেয়।

পরে আমরা লক্ষ্য করি, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে কাজ করে চলেছে। এখনো তাদের সেই কর্মধারা অক্ষুণ্ন রয়েছে। আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশকে ঋণদান বা আর্থিক সহায়তা করে থাকে, তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের কর্মধারা নানা কারণেই অন্যদের চেয়ে আলাদা। আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে যেসব শর্তারোপ করে, তার সঙ্গে আইএমএফ বিভিন্ন দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে যে শর্তারোপ করে, তার যোগ আছে। আইএমএফ কোনো দেশকে ঋণদানের সিদ্ধান্ত নিলে অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলো সেই দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা করে না। বাংলাদেশ সরকারের একজন উপদেষ্টা প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আইএমএফের ঋণ হচ্ছে চরিত্রগত সার্টিফিকেটের মতো। আইএমএফ যে দেশকে ঋণদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, অন্যান্য ঋণদানকারী সংস্থাগুলো সেই দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা করে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলো বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মাধ্যমে ঋণ গ্রহীতা দেশের ওপর তাদের স্বার্থ চাপিয়ে দেয়। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলো যদি আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে সেসব দেশের অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অনেকটাই রহিত হয়ে যায়। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক। তা হলো, বিশ্বব্যাংক এবং বিশেষ করে আইএমএফ ঋণদানকালে যেসব শর্তারোপ করে, তা সবসময় একই রকম। যেসব দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে দুর্বল, তাদের ক্ষেত্রে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণদানের শর্তাদি তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন হয়। আর যেসব দেশের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী তাদের ঋণদানের জন্য যে শর্তারোপ করা হয়, তা থাকে তুলনামূলকভাবে অনেকটাই সহজ। মূলত এ কারণেই উন্নয়নশীল দেশগুলো একান্ত অপারগ না হলে আইএমএফের কাছ থেকে কখনোই ঋণ গ্রহণ করতে চায় না।

আইএমএফ যেসব শর্তারোপ করে, তা অনুসরণ করে ঋণ গ্রহণ করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশটির উন্নয়ন ধারা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর আধিপত্যে চলে যেতে বাধ্য। ঋণগ্রহীতা দেশের উন্নয়ন আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশ্য নয়। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে কীভাবে ঋণ গ্রহীতা দেশকে কব্জায় রাখা যায়, তাদের কাজ হলো বিশ্বের কোনো দেশে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হলো কি না, তা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিও প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের ওপর বিরূপ থাকে, তাহলে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকও সেই দেশের ব্যাপারে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিশ্বব্যাংকের একটি নিজস্ব মতাদর্শিক কাঠামো আছে। তারা এই মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিশ্বব্যাংকের মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত হন। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন অর্থনৈতিক ইস্যুতে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, বাংলাদেশের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ তাকে সমর্থন করেন। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের কাজের মধ্যে সব সময় এক ধরনের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। মূলত এ কারণেই এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়, টু সিস্টারস। আইএমএফ কোনো দেশের ব্যাপারে সবুজ সংকেত না দিলে বিশ্বব্যাংক সে দেশের কোনো নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। ঠিক একইভাবে বিশ্বব্যাংক যদি কোনো প্রকল্পের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ না করে, তাহলে আইএমএফ সেখানে অর্থায়ন করবে না।

বাংলাদেশ এমনিতেই একটি ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়েছে। কাজেই আগামীতে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক সূত্র থেকে গৃহীত ঋণ যেভাবে বাড়ছে তাতে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের নির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এজেন্ডা হচ্ছে রাষ্ট্রের হাত থেকে সব প্রতিষ্ঠান এবং সম্পদ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, যেসব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোকে ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া এবং বাণিজ্যিকীকরণ করা। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর এবং বাণিজ্যিকীকরণ করা হলে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কৃষি এবং এ ধরনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার করাও তাদের একটি উদ্দেশ্য থাকে। আমাদের দেশে শিক্ষা-চিকিৎসা এত বেশি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, সেখানে ব্যয় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের পাট শিল্প ধ্বংস হয়েছে বিশ্বব্যাংকের শর্তের কারণে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে গ্যাস-বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের শর্তের কারণে। আইএমএফ কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমনোর কথা বলে কিন্তু ভর্তুকি কেন দেয়া হচ্ছে, তা তারা বলে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ উন্নত দেশগুলোতে কৃষি খাতে ব্যাপক মাত্রায় ভর্তুকি প্রদান করা হলেও আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক কিছু বলে না; কিন্তু আমাদের মতো দেশে কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে গেলেই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বেড়েছে। এটা সাধারণ মানুষকে স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য বাড়েনি। এটা বেড়েছে কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার জন্য।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ