Views Bangladesh Logo

আমেরিকায় অবৈধ অভিবাসী

বাংলাদেশের অভিবাসী বিষয়ে ট্রাম্পের নীতিনির্ধারণী কী হবে?

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

বৈধ অভিবাসীদের প্রতি খড়গহস্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো ২০ জানুয়ারি অভিষিক্ত হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘এই মুহূর্তে আমেরিকার স্বর্ণযুগ শুরু হলো’ বলে ভাষণ শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা সব দেশের ঈর্ষার কারণ হব। কাউকে আমাদের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের সুযোগ দেব না। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান নীতিই হবে “আগে আমেরিকা”। আমাদের সার্বভৌমত্ব আর নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। বিচারের দাঁড়িপাল্লায় পুনঃভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। আমেরিকা আগের চেয়ে বহুগুণ মহান ও ব্যতিক্রম হবে। আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে আছি। আমেরিকার পতন আজ থেকে শেষ হয়ে গেল। ঈশ্বর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আমেরিকাকে আবার মহান করার জন্য।’

ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব আর রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্যই হলো প্রবল তর্জন-গর্জন-আস্ফালন। প্রথম মেয়াদেও তিনি এরকম বহু আওয়াজ তুলেছিলেন; তাতে যে আমেরিকা আগের চেয়ে খুব বদলে গিয়েছিল তা না; তবে, ওবামা-আমলের চেয়ে যুদ্ধ কিছু কমেছিল সত্যি। এবারও বাইডেন-প্রশাসনকে এক হাত নিয়েছেন তিনি; অভিষেক অনুষ্ঠানে মুখ কালো করে বসে থাকা জো বাইডেনের সামনেই হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললেন, ‘আজকেই আমি কিছু ঐতিহাসিক নির্দেশনায় স্বাক্ষর করব, যার মধ্য দিয়ে আমেরিকার পুনর্গঠন শুরু হবে।’

আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতা অধিগ্রহণের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাইডেন প্রশাসনের ‘ধ্বংসাত্মক নীতিগুলো’ বাতিল করবেন। তাই ট্রাম্প অভিষেক গ্রহণের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল করা হয়। কারণ নতুন প্রশাসন ‘সিবিপি অন’ অ্যাপ বাতিল করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে মূলত সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের জন্য আগে থেকেই বুকিং করতে হয়। অভিষেক ভাষণেও ট্রাম্প জোর গলায় বলেন, ‘সমস্ত অবৈধ প্রবেশ পথ জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ হবে। লক্ষ লক্ষ অবৈধ অভিবাসী যে যেখান থেকে এসেছে তাদের সেখানে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। ম্যাক্সিকোর অভিবাসীদের ঠেকাতে আমার যে নীতি সেটা আবার পুনর্বহাল করব। ধরে ধরে ছেড়ে দেয়ার যে চর্চা সেটার এবার ইতি টানব আমি। বানের পানির মতো দলবেঁধে আমাদের দেশে ঢুকে পড়া অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে দক্ষিণ সীমান্তে সৈন্য পাঠাব।’

এর মধ্যে যেটা দেখা গেছে, নিউজ উইক-এর এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘সিবিপি অন’ অ্যাপের তোয়াক্কা না করেই একদল শরণার্থী, যারা বিভিন্ন দেশ থেকে আগত, দক্ষিণ ম্যাক্সিকোর সীমান্ত অঞ্চলজুড়ে ঘুরছে আমেরিকায় প্রবেশের জন্য; বড় বড় দশটি দলে তারা প্রায় ২ হাজার মানুষ; সীমান্ত রক্ষকদের বাধার সম্মুখীন হয়ে তারা আবার ম্যাক্সিকোর দিকেই ফিরে যায়। এখন তাদের গতি কী হবে জানতে চাইলে তারা বলেন, আপাতত ম্যাক্সিকোর বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়ে দিন কাটানো, পরে আমেরিকান সরকারের নীতি পরিবর্তিত হলে চেষ্টা করবে আমেরিকায় প্রবেশের।

বড় বড় দলগুলোকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে ম্যাক্সিকো সরকার। তারা এখন বস্তুত শরণার্থী; পথে পথে ঘোরা ছাড়া তাদের গতি নেই। এরকম হাজারো, লক্ষ মানুষ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে; যারা অনেক দিন ধরে আমেরিকায় প্রবেশের সুযোগ খুঁজছিলেন; তাদের জন্য সামনে এখন খুবই অনিশ্চিত সময়। আর আমেরিকার ভেতরেই যারা এখন অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আছেন তাদের কী অবস্থা? তারা এখন কিছুটা ভয়ে ভয়ে লুকোচুরি করে দিন কাটাচ্ছেন। ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিলেন তখনো অনেকটা এরকম অবস্থা হয়েছিল, পরে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তারা আশা করছেন এবারও হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। ট্রাম্প প্রথমে যেমন হুমকি-ধামকি দেন পরে ততটা চড়াও হন না।

ম্যাক্সিকো সীমান্ত দিয়ে অসংখ্য অবৈধ বাংলাদেশিও প্রবেশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রে। তাদেরও কিছুটা সমস্যা হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ আমেরিকাতে খুব বেশি অবৈধ নাগরিক কখনো পাঠায়নি। তবে কয়েক হাজার বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী আমেরিকায় আছে। তারা হয়তো ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে থেকে গেছে। বা আত্মীয়স্বজন হিসেবে, ছাত্র হিসেবে এসে থেকে গেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এখন প্রিয় মানুষ ইলন মাস্ক। ইলন মাস্ক চান কর্মী মানুষ আমেরিকায় থাকুক। ডোনাল্ড ট্রাম্পও এটাই চান। তাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, যারা এসে গেছেন, কাজেকর্মে সেটেল্ড হয়ে গেছেন তারা হয়তো থাকতে পারবেন। কিন্তু পরবর্তীতে অবৈধ পথে আমেরিকায় প্রবেশ অনেকের জন্যই কঠিন হবে। ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেও হয়তো আগের মতো থেকে যেতে সমস্যা হবে।


অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্প খুব তোড়জোড় করলেও, আশ্চর্য বিষয়, অভিষেক ভাষণে তিনি একবারও ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করলেন না। অথচ ট্রাম্প অভিষিক্ত হওয়ার এক দিন আগেই গাজা যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে কিছু না বললেও তিনি জোর দিলেন পানামা খাল নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ঘোষণায়। ট্রাম্পের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ ওই পানিপথের চারপাশে চীনের প্রভাব বাড়ছে এবং চীনই কার্যত পানামা খাল পরিচালনা করছে। তার এমন অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে অস্বীকার করেছেন পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো। তিনি বলেছেন, তার দেশ নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে এই খাল পরিচালনা করছে।

বিশ্বজয় করে নেয়ার একটা আধিপত্য ট্রাম্পের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আকাশেও যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায় থাকবে বলে জানান নতুন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, মার্কিন নভোচারীরা মঙ্গল গ্রহে গিয়ে বিজয়ের নতুন ইতিহাস রচনা করবেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক কীরকম হবে এ নিয়েও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও অন্তর্বর্তী সরকার চিন্তিত। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ডেমোক্রেটদের ঘোরতর সমর্থক তা ট্রাম্প ভালো করেই জানেন। গতবার ট্রাম্প জেতার পর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক দল আমেরিকান নাগরিক তাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প তাদের কাছে ইউনূসের খোঁজ করে বলেন, ‘আমাকে হারানোর জন্য ডেমোক্র্যাটদের তহবিলে মোটা চাঁদা দেয়া ওই ক্ষুদ্রঋণ ব্যবসায়ী কোথায়?’

নির্বাচনে জয়ের পরপরই ট্রাম্প টুইট করেছিলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগও সেটা এখন ক্যাশ করতে চাচ্ছে। ভারতের প্রভাবশালী ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় আওয়ামী লীগের সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সেটাই বড় করে দেখালেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক এখন নির্ভর করে ড. ইউনূসের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের ভিত্তিতে। নওফেল বলেছেন, বাংলাদেশে এখন ইসলামী উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে, যেটা আঞ্চলিকভাবে যেমন আন্তর্জাতিকভাবে বিপজ্জনক, ট্রাম্প সেটা হতে দিতে চাইবেন না।

ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক ভালো; এবং বাংলাদেশের বিষয়ে ট্রাম্প মূলত মোদি সরকারের নীতিই বাস্তবায়ন করতে চাইবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে; অন্তত ট্রাম্পের সাম্প্রতিক আচরণে এরকমটাই মনে হয়েছে। এর মধ্যে ড. ইউনূসের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈরী সম্পর্কও বাংলাদেশনীতিতে মার্কিন নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলবে। তবে, আশার কথা হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বাইরে মার্কিন থিং-ট্যাঙ্কের আলাদা বিচার বিবেচনা ও নীতিনির্ধারণী আছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এটা অনেকেই খোলাখুলি আলোচনা করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইশরাতেই বা সমর্থনে হাসিনাকে সরে পড়তে হয়েছে। সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক অনেক দিক দিয়েই চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ এখন চীন-ভারত-মার্কিন রাজনীতির কঠিন-কঠোর ভূরাজনীতির শিকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যতের নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার এটা কীভাবে সামাল দেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তথ্যসূত্র: সিএনএন, দ্য হিন্দু, নিউজ উইক, বিবিসি বাংলা

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ