আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন সুরক্ষার ঐতিহ্য নেই কেন?
গত বছর শেষবার গিয়েছিলাম বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম বাড়িটির কিছু উন্নতি হয়েছে। চারদিকে দেয়াল দেয়া হয়েছে, দর্শনার্থীদের বসার জন্য সুন্দর বেঞ্চ বানানো হয়েছে, পুকুর পাড়টা বাঁধাই করা হয়েছে। এর কারণ, বাড়িটি পিকনিক স্পট হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়। পাশেই ‘জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স’, স্কুল-কলেজ। ছোট একটি রুমে জগদীশ চন্দ্র বসুর নানা স্মৃতিচিহ্ন রাখা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে তার লেখা চিঠি, হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, তাকে লেখা রবি ঠাকুরের চিঠি, ক্রেসমোগ্রাফের ছবি, রয়্যাল সোসাইটিতে দেয়া বক্তৃতার কপি, তার পোট্রেটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো ছোট একটি রুম।
আমাদের দলের শ’খানেক লোকের মধ্যে দু-চারজন কৌতূহলী লোকই সেই রুমে ঢুঁ মারলেন। বেশির ভাগই মাঠে, পুকুরপাড়ে ঘুরে, নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে, গান শুনে কাটালেন। কমপ্লেক্সে দায়িত্বরত একজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম অল্প লোকই আসে জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে বুঝতে-জানতে। সবাই জানেন তিনি একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, গাছেরও প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন, অনেকে এও জানেন যে তিনিই প্রথম রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন; কিন্তু তার কাজের ব্যাপক-বিস্তৃতি পরিধি সম্পর্কে খুব অল্প লোকেরই ধারণা আছে।
জগদীশ চন্দ্র বসু শুধু বিজ্ঞানী না, একজন দার্শনিক ছিলেন, শেষ বয়সে তার জীবনযাপন ছিল প্রকৃতির আশ্রয়, তার সম্পর্কে আরও জানলে আমরাও সহজ-সুন্দর প্রকৃতিনির্ভর মানুষ হতে পারতাম। তারচেয়েও বড় কথা, বাড়িটি এখন কিছুটা সুন্দরভাবে সাজানো হলেও প্রকৃত জগদীশ চন্দ্র বসুর স্মৃতি সেখানে অনুপস্থিত। এখানে একটি বড় গবেষণাগার হতে পারত; কিন্তু তা না হয়ে হয়েছে পিকনিক স্পট! তাও মন্দের ভালো। কারণ, বছর কয়েক আগে গিয়ে ওই বাড়ির চত্বরে গরু চড়তে দেখেছিলাম। পুকুরপাড়টাও ছিল ভাঙা।
আর ঐতিহ্য-সংরক্ষণ মানে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন নয়। ওই বিশেষ স্থান ও ব্যক্তিকে ঘিরে কোনা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনও জরুরি। যেন সাধারণ মানুষ ওই বিশেষ ব্যক্তি ও স্থান সম্পর্কে সম্মক ধারণা অর্জন করতে পারেন। যেমন, সোনারগাঁর পানাম নগরের কথাই ধরা যাক। বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত জায়গাটি অনেকেটা অবেহেলার সঙ্গেই ফেলে রাখা হয়েছে। সামনে একটা ছোট্ট সাইনবোর্ডে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে পানাম নগরের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে কেবল, আর কোনো ব্যবস্থা নেই স্থানটি সম্পর্কে বিশেষভাবে জানার-বোঝার।
সামনে একটি ছোট্ট গেট, টিকিট কেটে দর্শনার্থীদের ভেতরে ঢুকতে হয়। প্রতিদিন হাজারো দশনার্থী পানাম নগর দেখতে যান। তাদের টিকিটের টাকা কোথায় ব্যয় হয় কে জানে! নগরটির আশপাশের জায়গা আবর্জনায় ভর্তি। রোদ-বৃষ্টিতে কোথাও বসার আশ্রয়স্থল গাছতলা অথবা কোনো দালানের নিচে। অথচ পাশেই সুন্দর একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ করা যেত। সেখানে কোনো স্ক্রিনে স্থানটি সম্পর্কে আরও বিস্তৃত ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে পারত তথ্যচিত্র আকারে।
সবচেয়ে করুণ অবস্থা পানাম নগরের সামনে প্রায় চারশ বছরের পুরোনো মুঘল আমলের সেতুটির। সেতুটি ভেঙে পড়ার দশা এবং সংরক্ষণের কোনো তাগিদ নেই। তার মানে যত্ন নেই, আশপাশে নজর নেই, কোনোরকমে নগরটি দেয়াল ঘিরে জাদুঘরে রূপান্তর করেছে, ব্যস, দায়িত্ব শেষ।
এ অবস্থা দেখা যাবে বগুড়ার মহাস্থানগড় গেলেও। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের এই পুরাকীর্তি খনন করে পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ভিটা, যার সঙ্গে বাংলার অনেক ইতিহাস ও মিথ জড়িত। এসব মিথ কবি জীবনানন্দ দাশ তার অনেক কবিতায় ব্যবহার করেছেন। যেমন, জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে আছে কালিদহ সাগরের কথা, বেহুলা ও চাঁদ সওদাগরের কথা। এসব স্থান মহাস্থানগড়ের আশপাশে।
প্রাচীর বেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে মৌর্য, গুপ্ত, গৌড়, পাল এবং সেন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু এই ঐতিহাসিক নিদর্শনও যে খুব ভালোভাবে সংরক্ষিত তা বলা যাবে না। বিশাল অঞ্চলটি দর্শকের জন্য উন্মুক্ত এবং অনেক দর্শকই জানেন না বাংলার এই অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তিটি আসলে কীসের নিদর্শন! সাধারণ মানুষ একটি দর্শনীয় স্থানে বেড়াতে যান কেবল, কিছু দেখতে যান বা আবিষ্কার করতে যান বলা যাবে না। এর কারণ সাধারণ মানুষের মনে আমরা ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে আগ্রহ জন্মাতে পারিনি। এর কারণ আমাদের ইতিহাসচর্চা নেই। আর ইতিহাসচর্চা ছাড়া ঐতিহ্য-প্রীতি জন্মায় না।
আমরা কথায় কথায় বলি, বাঙালি ঐতিহ্যপ্রিয় জাতি। ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই; কিন্তু বাস্তবে দেখা যাবে ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের তেমন জানাশোনা নেই। ঠিক কত বছর গত হলে বলা যায় একটি বিশেষ স্থান বা ঘটনা ঐতিহ্যের অন্তর্গত? আনুমানিক সময় ধরা যায় পঞ্চাশ বছর। কোনো কিছু ঐতিহ্যে রূপ পেতে হলে অন্তত তিনটি প্রজন্ম ওই বিশেষ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তৃতীয় প্রজন্ম যখন পিতামোহের কোনো শিক্ষা-দীক্ষা-প্রথা-আচার-অনুষ্ঠান তার পরবর্তী পুরুষের কাছে ছড়িয়ে দেবার বাসনায় লালন-পালন করে তাহলে তাকে বলা যায় ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। ঐতিহ্য একটি পরম্পরাগত শিক্ষা। যার মধ্য দিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই আদর্শ-মূল্যবোধ ধারন ও বহন করে।
আমাদের দেশে দেখা যায় ঐতিহাসিক কিছু নিদর্শন সংরক্ষণ করা হয় ঐতিহ্যের নামে; কিন্তু তার মূল যে আত্মা, সেটা বহন করার বা বিকাশের কোনো সংস্কৃতি দেখা যায় না। এর কারণ আমরা ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে কেবল বর্তমানের মোহ নিয়েই মুগ্ধ। হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য বাদ, একেবারে হাল-আমলের ইতিহাস-ঐতিহ্যই তো আমরা বহন করতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-সময়কার অন্যান্য ইতিহাস-নিদর্শনের প্রতি আমরা দেখিয়েছি চরম অবহেলা।
কখনো কখনো সুযোগ পেলে অপমান করতেও ছাড়ি না। দলমত নির্বিশেষে ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে একটি সর্বজনীন জাতিগত রূপ আছে, সেটা আমরা জানি না। বড় বড় ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বাদ দিয়ে যদি ছোট ছোট ঐতিহাসিক-নিদর্শনের কথা বলি তাহলে কান্না আসবে। সেগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সমানে ভেঙে ফেলা হচ্ছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সিনেমা হলগুলো। পুরোনো ঢাকার শতবর্ষী বাড়িগুলো মালিকপক্ষের খেয়াল-খুশিমতো ভেঙে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল ইমারত।
সরকারিভাবে যেমন আমাদের ঐতিহাসিক-নিদর্শন, ঐতিহ্য সুরক্ষার তাগিদ নেই, ব্যক্তিগতভাবেও নেই; কিন্তু পুরোনোকে সংরক্ষণ ছাড়া কোনো জাতি সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। কবি বলেছেন, ‘হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে কাজ করে যাও গোপনে গোপনে...’; কিন্তু আমাদের ঐতিহাসিক-নিদর্শন সংরক্ষণের ঐতিহ্য বা প্রবণতা নেই কেন?
এটি অবশ্যই সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়। আমি সমাজতাত্ত্বিক নই। নিতান্তই সাধারণ একজন সাংবাদিক ও লেখক। তার কাণ্ডজ্ঞান থেকে কিছু ধারণা, অনুমান করতে পারি কেন ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের প্রতি আমাদের এত অনীহা। কারণটা খুব বেশি জটিল নয়। আসলে ইতিহাস-ঐতিহ্য বা ঐতিহাসিক- নিদর্শনের প্রতি আমাদের আগ্রহ নেই কয়েকটি কারণে। প্রথম কারণ অবশ্যই আমাদের সীমাহীন দরিদ্রতা। হাজার বছর ধরে এ বাংলার মানুষ দিন এনে দিন খেয়ে টিকে থেকেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মতো অবকাশ, অবসর তার জীবনে ছিল না। রাষ্ট্রও ছিল ভঙ্গুর এবং তা বেশির ভাগ সময়ই বিজাতির শাসনে। সুলতানরা, মুঘলরা কেউ সে অর্থে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের শাসক ছিল না। ইংরেজদের তো প্রশ্নই আসে না। শেষ পর্যন্ত যে পাকিস্তানি শাসন এলো ২৩ বছরের জন্য তাও ঔপনিবেশিক। দীর্ঘকাল ধরে লড়াই-সংগ্রাম করে টিকে থাকতে থাকতে এই অঞ্চলের মানুষ আর নিজস্ব ঐতিহাসিক-নিদর্শন সংরক্ষণের তাগিদ বা প্রেরণা জন্মায়নি।
দ্বিতীয় কারণটা আরও মারাত্মক। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। এ দেশের পুরাকীর্তি, স্থাপত্য, ঐতিহাসিক-নিদর্শনগুলো বেশির ভাগই হিন্দুদের তৈরি। ফলে দেশভাগের পর তারা আর সেগুলো সংরক্ষণের উৎসাহ দেখায়নি। হাজার বছরের পুরোনো যে পুরাকীর্তিগুলো পরবর্তীতে উদ্ধার করেছে বা সংরক্ষণ করেছে তার কারণ তা সুদূর অতীতের বিষয় বলেই।
তৃতীয় আরেকটি কারণ আছে, সংরক্ষণের বিষয়টি আসলে বুর্জোয়া-সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। ইউরোপে যখন বুর্জোয়া-বিপ্লব হয়, তখন তারা অতীতের ইতিহাস-ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়েই বেড়ে উঠেছে। তাই দেখা যায় ইংরেজরা শেকসপিয়রের বাড়ি সংরক্ষণ করেছে অতি যত্নের সঙ্গে, তাই দেখা যায় স্ট্র্যাটফোর্ড-আপঅন-অ্যাভন বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যপ্রিয় মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে; কিন্তু আমরা কি দৌলত কাজী বা চন্দ্রাবতীর কোনো ঐতিহাসিক-নিদর্শন সেভাবে সংরক্ষণ করতে পেরেছি? তাদের শেকসপিয়রের মতো প্রতিভা হয়তো নেই, আর প্রতিভা ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক ও রাজনৈতিক; কিন্তু এ কথা তো সত্য যে, দৌলত কাজী বা চন্দ্রাবতীর ইতিহাস আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিধর্ম নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণেই আমরা আজও লালনের স্মৃতিধাম নিয়েই এক হতে পারলাম না। এখনো লালন আখড়া নিয়ে চলছে কত কথা! কিন্তু এভাবে যদি আমরা ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক-নিদর্শনা ভুলতে থাকি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম জানবে কী? তারা দেখবে এ জাতি একেবারেই শূন্যগর্ভ, ভাববে এ জাতি হয়তো আকাশ থেকে পড়েছে। তাই এখনো হয়তো আমাদের সময় আছে ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার, কালের ধুলোয় টিকে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার।
কামরুল আহসান: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে