রয়্যাল এনফিল্ড কেন স্পেশাল
মোটরসাইকেলের বিখ্যাত ব্র্যান্ড রয়্যাল এনফিল্ড, যা বাইকারদের কাছে স্বপ্ন ও ঐতিহ্যের বাহক। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড হিসেবে এখনো এটি উৎপাদনে রয়েছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাংলাদেশে তার যাত্রা শুরু হচ্ছে ৩৫০ সিসির ৪টি মডেল: হান্টার, বুলেট, ক্ল্যাসিক ও মিটিওর নিয়ে। এ নিয়ে বাইকপ্রেমীদের মাঝে বিরাজ করছে উৎসাহ-উদ্দীপনা। বিশ্বব্যাপী এর কদর অন্যান্য বাইকের চেয়ে অনন্য উচ্চতায়, মূলত এর ক্ল্যাসিক ডিজাইন ও রাজকীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের জন্য। রাজপরিবার থেকে হলিউড, বলিউড এমনকি বিশ্বের নামকরা ধনাঢ্যদের কাছে রয়্যাল এনফিল্ড হলো সৌর্য ও সক্ষমতার প্রতীক। বিশ্বজুড়ে রয়্যাল এনফিল্ডপ্রেমীরা এর ক্ল্যাসিক লুক এবং মজবুত গঠনের জন্য আলাদা সমাদর করেন।
রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রা
বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হলেও রয়্যাল এনফিল্ডের যাত্রা শুরু অস্ত্র তৈরির মাধমে। এর ইতিহাস শুরু ১৮৫১ সালে, যখন এটি ‘ইনফিল্ড অর্মস’ নামে একটি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। অস্ত্র ও বুলেট তৈরিতে পারদর্শী কোম্পানিটি মূলত ইংল্যান্ডের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং সামরিক বাহিনীতে অস্ত্র সরবরাহ করত। শুধু ইংল্যান্ড নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ ব্রিটিশ ভারতেও অস্ত্র বিক্রি করত তারা, যা উপনিবেশিক প্রশাসনের কাজে ব্যবহৃত হতো। যাত্রা শুরুর ৫০ বছর পর তারা মোটরসাইকেল তৈরিতে হাত দেয়। ১৯০০-এর দশকে কোম্পানিটি বাইক উৎপাদনে প্রবেশ করে, যা তাদের ব্যবসার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। প্রথম মোটরসাইকেল হিসেবে ১৯০১ সালে মাত্র ১০ সিসির ‘রয়্যাল এনফিল্ড মডেল ১’ বাজারে আসে এবং এরপর থেকে তারা বাইক শিল্পে তাদের অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। তবে শুরুর দিকে সেসব মোটরসাইকেল কেবল সেনাবাহিনীর সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করত। এমনকি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এ মোটারসাইকেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহার করেছিল।
ডিজাইনে স্বতন্ত্রতা
রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইন তার রেট্রো ক্ল্যাসিক স্টাইলের জন্য বিখ্যাত। এ বাইকের প্রথম ডিজাইনার কে সে বিষয়ে উল্লেখ করা কঠিন, কারণ এটি ছিল সম্মিলিত প্রয়াস। তবে চার্লস ফ্র্যাঙ্ক সেফ ডিজাইনারদের উল্লেখযোগ্য একজন। ১৯০৩ সালে ‘রেয়াররড’ তৈরিতে তার অবদান রয়েছে। তবে রয়েল এনফিল্ড আধুনিক ও ক্ল্যাসিক ডিজাইন হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে রনি হ্যাথওয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। তিনি একে একে বাজারে নিয়ে আসেন ‘ক্ল্যাসিক’ ও ‘বুলেট’-এর মতো জনপ্রিয় মডেলগুলো। যাকে সহায়তা করেছেন মার্ক টমসন, ক্রিস গ্যাম্বেল, যারা মূলত রয়েল এনফিল্ডের ডিজাইনে বৈচিত্র্য এনে একে আধুনিক ও জনপ্রিয় করে তোলেন।
রয়্যাল এনফিল্ডের পুরোনো দিনের ক্ল্যাসিক স্টাইল বিশেষভাবে বুলেট ৩৫০ ও ক্ল্যাসিক ৩৫০ মডেলগুলিতে দেখা যায়। বাইকটির গোলাকার হেডলাইট, ক্রোম ফিনিশিং এবং ভিনটেজ স্টাইলের ফুয়েল ট্যাঙ্ক ডিজাইন একে অনন্য এবং আড়ম্বরপূর্ণ লুক দিয়েছে। আর বডির কথা বলতে গেলে সেখানেও রয়্যাল এনফিল্ড অনন্য। বাইকগুলোর বডি সাধারণত অন্যান্য বাইকের তুলনায় অনেক ভারী হয়। মেটালের তৈরি ভারী বডি ও চেসিস ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে বাইকটি স্থিতিশীল এবং মজবুত থাকে, যা দীর্ঘপথের ভ্রমণে আরামদায়ক হয়। এ ছাড়া রয়্যাল এনফিল্ডে থাকে বড় আকারের ফুয়েল ট্যাঙ্ক, আর ট্যাঙ্কের ডিজাইনে ক্ল্যাসিক রঙের ফিনিশিং থাকে, যার কারণে বাইকাররা রেট্রো নস্টালজিয়ায় ভোগেন। আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো ইঞ্জিনের ‘থাম্পিং’ সাউন্ড। মজার ব্যাপার হলো এই থাম্পিং সাউন্ডের জন্যই বাংলাদেশের বাইকররা বাম্পারে নানান ইকুয়েপমেন্ট যোগ করেন! আবার এ বাইকগুলো এমনভাকে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে সহযেই মডুলার করা যায়। তাই আপনি ইচ্ছেমতো অতিরিক্ত ইকুয়েপমেন্ট যোগ করে মডুলার করতে পারবেন।
রয়্যাল এনফিল্ডের ডিজাইনে আরও কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। যেমন এ বাইকটি যতই আধুনিক হোক না কেন এতে থাকে পুরনো সেই এনালগ মিটার ও ডুয়াল সিট এবং আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা। সিটগুলো সাধারণত লেদার বা প্যাডেড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হয়, যা দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য আরাম নিশ্চিত করে।
রয়্যাল এনফিল্ডের বাজার
রয়্যাল এনফিল্ড ১৯৫০-এর দশক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য মোটরসাইকেল তৈরি শুরু করে। বাইকটি বিশেষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে প্রতীক হয়ে ওঠে, যেখানে অনেক বিপ্লবী এটি ব্যবহার করতেন। বর্তমানে রয়্যাল এনফিল্ডের অন্যতম বৃহৎ বাজার হলো ভারত। বিশেষ করে ‘হিমালয়ান’ মডেলটি পাহাড়ি রাস্তা এবং দূরপাল্লার ভ্রমণের জন্য ভারতে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এমনকি ভারতের উদয়পুরে রয়েছে রয়্যাল এনফিল্ডের বৃহৎ মিউজিয়াম। বর্তমানে ভারত ছাড়াও কোম্পানিটির ৫০টির বেশি দেশে তাদের বাজার রয়েছে।
রাজপরিবারের শক্তি-সামর্থ্যের প্রতীক
রয়্যাল এনফিল্ডের সঙ্গে রাজপরিবারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু। ব্রিটেনের রাজপরিবারের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার রাজপরিবারও এ মোটরবাইক ব্যবহার করত। কারণ এটি তাদের জন্য শক্তি, সম্মান ও ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল।
ভারতের মধ্যে রাজস্থান, বিশেষ করে জয়পুর ও উদয়পুরের রাজপরিবারের সদস্যরা রয়্যাল এনফিল্ডের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজপরিবারও রয়্যাল এনফিল্ডের বড় ভক্ত ছিলেন। এমনকি ইতিহাস বিখ্যাত যোধপুরের মারওয়ারী রাজপরিবারও এ বাইক ব্যবহার করতেন। তাদের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল সংগ্রহে রয়্যাল এনফিল্ডের বিভিন্ন মডেল ছিল, যা রাজকীয় ভ্রমণ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হতো।
অন্যদিকে নেপালের রাজপরিবারেও রয়্যাল এনফিল্ডের ব্যবহারকারী ছিল। নেপালের পাহাড়ি ও দুর্গম রাস্তায় ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত হওয়ায়, এই ব্র্যান্ড নেপালের রাজপরিবারের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
আবার মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রাজপরিবার যেমন- ওমানের সালতানাত এবং অন্যান্য গাল্ফ দেশের রাজপরিবারের সদস্যরাও রয়্যাল এনফিল্ড ব্যবহার করতেন। এমনকি মালয়েশিয়ার রাজপরিবার ও রাজাদের অনুসারীরাও এ বাইক চালাতেন।
সিনেমা-ডকুমেন্টারি ও সাহিত্যে রয়্যাল এনফিল্ড
রয়্যাল এনফিল্ডের বাইকগুলো অনেক সিনেমাতে স্বাধীনচেতা ও প্রভাবশালী চরিত্রের প্রতীক হিসাবে ঠাঁই করে নিয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমায় এর আধিক্য দেখা যায়। ‘যাব তক হ্যায় জান’ সিনেমায় শাহরুখ খানকে রয়্যাল এনফিল্ড চালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়া ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস ফাস্টেস্ট ইন্ডিয়ান’ ‘থ্রি ইডিয়টস’ ও ‘জিন্দেগি নেহি মিলেগি দোবারার মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোতেও রয়্যাল এনফিল্ডের দৃশ্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া ‘রয়্যাল এনফিল্ড: দ্য লিজেন্ড রাইডস অন’ নামে একটি অসাধারণ ডকুমেন্টারি রয়েছে, যেখানে এর ইতিহাসহ নানান দিক তুলে ধরা হয়েছে।
আবার রয়্যাল এনফিল্ডের বাইকগুলো মূলত সাহিত্যে প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক শক্তি, স্বাধীনতা এবং অ্যাডভেঞ্চারের প্রতীক হিসেবে। যদিও সরাসরি কোনো উপন্যাস রয়্যাল এনফিল্ডকে কেন্দ্র করে লেখা হয়নি। তবে বিভিন্ন ভ্রমণ লেখকদের লেখা উপন্যাস ও আডভেঞ্চার গল্পে রয়্যাল এনফিল্ড উল্লেখ রয়েছে।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রিয় বাইক
পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই রয়্যাল এনফিল্ড ব্যবহারে ক্রেজ দেখিয়েছেন। ১৮শ শতকের একজন প্রখ্যাত পদার্থ ও রসায়নবিদ মাইকেল ফ্যারাডে, যিনি বিদ্যুৎ ও চুম্বকত্বের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি রয়্যাল এনফিল্ড বুলেট ব্যবহার করতেন, যা তার সময়ের জন্য অত্যন্ত অত্যাধুনিক বাইক ছিল। ব্রিটিশ ভ্রমণ লেখক টেড সাইমন রয়্যাল এনফিল্ড ব্যবহার করে বিশ্বভ্রমণ করেছেন। সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তার লেখা বইও বাজারে পাওয়া যায়।
আবার হলিউড সুপারস্টার ব্র্যাড পিট রয়্যাল এনফিল্ডের বিশাল ভক্ত। তিনি কয়েকটি ক্ল্যাসিক এনফিল্ড মডেল ব্যবহার করেন। হলিউড তারকা জর্জ ক্লুনিও রয়্যাল এনফিল্ডের একজন অনুরাগী। এমনকি সম্প্রতি না ফেরারা দেশে পাড়ি দেওয়া বিজনেস আইকন রতন টাটা রয়্যাল এনফিল্ডের ভক্ত ছিলেন। তিনি প্রায়ই নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহের জন্য এনফিল্ড কিনেছেন।
সর্বোপরি বলা যায়, রয়্যাল এনফিল্ড শুধু একটি বাইক নয়, এটি স্বাধীনতা, সাহসিকতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এর ক্ল্যাসিক ডিজাইন, মজবুত গঠন এবং চালানোর অভিজ্ঞতা একে বিশ্বের অন্যতম পরিচিত ব্র্যান্ডে পরিণত করেছে। সারা বিশ্বে বাইকাররা একে ভালোবাসে, কারণ তারা মনে করেন এটি তাদের জীবনধারার প্রতীক। ঐতিহ্যবাহী মডেল এবং মজবুত কাঠামোর জন্য এটি বহু প্রজন্মের বাইকারদের প্রিয়। আজও রয়্যাল এনফিল্ড তার গুণাবলীর কারণে বাইকপ্রেমীদের মন জয় করে চলছে। সেজন্য রয়্যাল এনফিল্ড অন্য বাইকের চেয়ে আলাদা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে