সরকার কী পারবে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে?
দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ১১ জানুয়ারি আবারও সরকার গঠন করেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। টানা চারবারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও সরকারকে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যদিও সরকার স্বীকার করেছে বিরোধী দলগুলোর ক্রমাগত চাপ ও ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করাই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ৬টি বড় ঝুঁকি আছে। ৭১টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ করে এর দেখা পেয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের দেশীয় পার্টনার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। জরিপের ফল বলছে-আগামী দুই বছর দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি সংকট, বৈষম্য, সরকারি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং বেকারত্বের হার বাড়বে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, উল্লিখিত সংকট ছাড়াও বিদেশে অর্থ পাচার, খেলাপি ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, ডলার সংকট, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় নাকাল দেশের অর্থনীতি। এগুলো সমাধানের দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
সিপিডি বলছে, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এর বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। এ ছাড়া, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ যা নভেম্বরে গিয়ে নেমে আসে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশে। চলতি বছর জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৪২ শতাংশে ঠেকেছে। এ কারণে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অর্থাৎ গত বছর যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৪২ পয়সায়, কিন্তু মানুষের আয় সেই অনুপাতে বাড়েনি।
সরকার জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে। আরেকটি সংকট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া। একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর আশঙ্কাজনকভাবে কমে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছিল ১৯ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে। এটা কিছুটা বেড়ে চলতি জানুয়ারির মধ্যভাগে ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ২ হাজার ৩৮ কোটি ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানোর পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে হবে। এটি করা গেলে বিনিয়োগের জন্য যুতসই পরিবেশ ফিরে আসবে।
বিশ্লেষকরা কী বলছেন?
একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, নতুন সরকারের সামনে অর্থনৈতিক নানা চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন সমস্যা হলো জিনিসপত্রের মারাত্মক ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি হয়েছে যে, মানুষ বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সরকার আশা করছে, মূল্যস্ফীতি সংকট কাটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করবে; তবে এটি কঠিন হবে। ড. জাহাঙ্গীরের মতে, প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। কারণ কৃষি খাত এখনো মার খায়নি। শিল্প ও তৈরি পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, রপ্তানি খাতের বাজারও ইতিবাচক। রেমিট্যান্স প্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। এই ধারা চলতে থাকলে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫-এ পৌঁছুবে।
অন্যদিকে, জিনিসপত্রের দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক এই অর্থনীতিবিদ। তার মতে, করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী ডলারের দাম বাড়ায় বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। কাঁচামালের দাম বাড়ায় খরচ বাড়ার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্বালানি সংকট। তাই গত দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাড়ে ১২ শতাংশে ঠেকেছে।
তবে ডলারের দাম স্থিতিশীল হলে, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাতে রপ্তানি বাড়লে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বাড়লে জিনিসপত্রের দাম কিছুটা কমতে পারে। জাহাঙ্গীর আলম জানান, শাক-সবজি ও খাদ্যের উৎপাদন আগের চেয়ে ভালো। তবে, মার্চ-এপ্রিল নাগাদ খাদ্য সংকটের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি নাও হতে পারে। কারণ, সরকারি পর্যায়ে খাদ্য শস্যের মজুত ভালো এবং আসছে বোরো মৌসুমে ফসলের উৎপাদন নিরাপদ আছে। সরকার তৎপর হলে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে এনে চলতি বছর মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫-এর মধ্যে রাখা সম্ভব। এটি করা গেলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলমের মতে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আমাদের অগ্রগতি নির্ভর করছে। তাই শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে সরকারকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে মধ্যস্বত্ত্বভোগী অতি মুনাফালোভীদের চিহ্নিত করতে হবে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে বাজারে স্বস্তি আসবে। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল রাখতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। এটি সম্ভব হলে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসবে। তবে, শক্ত হাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন এই অর্থনীতিবিদ।
এদিকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) অধ্যাপক ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, সরকারের সামনে রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জই বেশি। সবার আগে দরকার নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। এটিই বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও তাদের আয় বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের কাজের জায়গা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, জরুরি পণ্য সঠিক দামে বিক্রি করতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন ড. আহসান হাবিব। তবে, ডলার সংকট কাটাতে বিলাসবহুল ও সেমি বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি বন্ধ করতে হবে।
গুরুত্ব দিতে হবে জরুরি ও নিত্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে। বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ জানিয়ে তিনি বলেন, অর্থ পাচার বন্ধে দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে। জ্বালানি সংকট কমানো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলে বিদেশে অর্থ পাচার কমে আসবে। কারণ দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও কালো টাকার মালিকরা দেশে নিরাপদ বোধ করে না বলেই অর্থ পাচার করে। এ ছাড়া, রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবাসীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দেন তিনি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আহসান হাবিবের মতে, সরকারের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। ঋণ খেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তবে সবার আগে প্রয়োজন সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের (নন পারফর্মিং লোন-এনপিএল-সংক্রান্ত অর্থাৎ এমন একটি ঋণ যেখানে ঋণগ্রহীতা খেলাপি এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাসিক মূল এবং সুদ পরিশোধ করেনি) দ্রুত বাস্তবায়ন। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের লুটপাট ঠেকাতে অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার কোনো বিকল্প নাই।
করণীয় কী?
সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা ‘অর্থনীতির কালো মেঘ’ সরানো সম্ভব না। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও লুটপাটের লাগাম টেনে ধরতে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে কমিশন গঠন করে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে এনে লুটেরা ও ঋণ খেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। খেলাপিদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করতে হবে। এমন আইন করতে হবে, যে কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ খেলাপি হলে তার সন্তান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে না। সিআইপি ও ভিআইপি মর্যাদা বাতিল করতে হবে। রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সে ভ্রমণে তারা বিজনেস ক্লাসের মর্যাদাও পাবেন না। সরকারকে মনে রাখতে হবে–সব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিতের বিকল্প নেই। জনগণ, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন যতই সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক না কেন আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করতে হবে। সাধারণ মানুষ পেট ভরে ভাত খেতে না পারলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আশীর্বাদ নয়, অভিশাপে রূপ নেবে!
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে