খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের শতাধিক মামলা এখনো চলমান
গণআন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে পরিবর্তীত এই পরিস্থিতিতেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার অবস্থা। এখনো বিগত তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া ১০৯ মামলা রয়েছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। এসব মামলার মধ্যে ৩২টি খালেদা জিয়ার ও ৭৭টি রয়েছে তারেক রহমানের। এ ছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিএনপির প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে প্রায় ৪ লাখ মামলা এখনো চলমান দেশের বিভিন্ন আদালতে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর কয়েকটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। এর মধ্যে দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছর পর গত ৬ আগস্ট কারামুক্ত হন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহসহ পাঁচ মামলায় গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালত খালাস দেন খালেদা জিয়াকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা মামলার কার্যক্রম গত ১৩ নভেম্বর বাতিল করেন হাইকোর্ট। নোয়াখালীতে হওয়া রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা থেকে গত ১ অক্টোবর খালাস পেয়েছেন তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যশোরে করা মামলা গত ১৬ অক্টোবর প্রত্যাহার করে নেন বাদী মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম খয়রাত হোসেন। এসব মামলা থেকে অব্যাহতির পরও ১০৯টি মামলা এখনো রয়েছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের ও তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। হাইকোর্ট পরে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। ২০২০ সালে শর্তসাপেক্ষে এই মামলায় খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করে দেয়া হলেও তারেক রহমানের সাজার আপিল বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ মামলায় তারেক রহমানকে ২০০৮ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়।
২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডন চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন আদালত তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করে। তাকে পলাতক দেখিয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর মধ্যে ৫টির বিচার শেষে সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। আর কিছু মামলা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৭ সালে তারেক রহমান, তার স্ত্রী জোবাইদা রহমান ও জোবাইদা রহমানের মা সৈয়দা ইকবাল বানুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মামলা করেছিল দুদক। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছরের ও জোবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইজীবী জয়নুল আবেদীন এ ব্যাপারে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কিছু মামলা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে প্রত্যাহার হলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে ১০৯টি মিথ্যা মামলা রয়েছে। এসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করার দাবি জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সমাবেশ চলার সময় গ্রেনেড হামলায় হতাহতের ঘটনায় হওয়া মামলা প্রক্রিয়ার শেষ দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নতুন করে জড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়। লন্ডনে অবস্থান করায় আদালত তাকে পলাতক হিসেবে ওই রায় দেন। এ মামলার আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নিচ্ছি।’
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের এই পরিবর্তন হলেও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে এখনো শতাধিক মামলা চলমান। এ ছাড়া বিএনপির প্রায় ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে এখনো প্রায় ৪ লাখ মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে চলমান। এটা মোটেই কাম্য নয়।’
এ ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আমার জানা মতে সারা দেশে এখনো শতাধিক মামলা রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করেছে। তাই এখন তিনি মুক্ত এবং চাইলেই দেশের বাইরে যে কেনো প্রয়োজনে যেতে পারবেন। তবে এসব মামলার আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন ব্যতীত তারেক রহমান দেশে ফিরবেন না।’
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ভিউজ বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য এরই মধ্যে দুটি কমিটি গঠন করেছে বর্তমান সরকার। এই কমিটির কাজ চলমান। যাচাই-বাছাই করে সব ধরনের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার হবে।’ এদিকে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুটি কমিটি গঠন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যাতে বলা হয়,‘হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে করা কমিটি দুটির মধ্যে একটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের এবং অন্যটি হবে জেলা পর্যায়ের।
আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করবেন। জেলা কমিটি সুপারিশের পর সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করা হবে। এরপর তালিকা তৈরি করে মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি। জেলা পর্যায়ের কমিটিকে মামলা প্রত্যাহারের আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যায়িত কপি দাখিল করতে হবে। আবেদনের পর সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন।
এরপর ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) তার মতামত পুনরায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করে করবেন। জেলা কমিটির সুপারিশ পেলে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি মামলার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এরপর প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করে মামলা প্রত্যাহারের চূড়ান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে এসব মামলা প্রত্যাহার হবে।’ এদিকে জানা গেছে, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জেলা পর্যায়ের কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। যেখানে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া সব মামলাই যাচাই-বাছাই হচ্ছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে