রাজকন্যা অভয়ার অভয়নগরে কালের সাক্ষী এগারো শিব মন্দির
রাজকন্যা অভয়ার নামে নামকরণ করা হয়েছিল, অভয়ানগর। কালের বিবর্তনে সেই অভয়ানগরই বর্তমানে অভয়নগর। ভৈরব নদের তীরে যশোর শহর থেকে ৩০কিলোমিটার অদূরে উপজেলাটির অবস্থান। এই অভয়নগরেই আছে রাজকন্যা অভয়ার এগারো শিবমন্দির। যা এখন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই নিদর্শন দেখতে ও পূজা-অর্চনা করতে প্রতিদিন এখানে আসেন অসংখ্য দর্শনার্থী।
যশোর-খুলনা মহাসড়কের মাঝামাঝি স্থানে অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজার। বাজার থেকে ভ্যান বা ইজিবাইকে করে যেতে হবে রাজঘাট এলাকায়। সেখান থেকে ভৈরব নদ পার হয়ে তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বা ভ্যানে করে পৌঁছাতে হবে উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের অভয়নগর গ্রামে। আর এখানেই মিলবে বাংলাদেশের প্রাচীন মন্দির ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রাজকন্যা অভয়ার এগারো শিব মন্দির।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই মন্দির নির্মাণ করেন যশোর জেলার তৎকালীন রাজা নীলকণ্ঠ রায়। রাজ্যের রাজধানী যশোরের চাঁচড়াতে হলেও পরিবার নিয়ে অভয়নগরের ভৈরব নদের পাড়ে একটি গ্রামে বসবাস শুরু করেন তিনি। আর সেখানেই রাজার এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখা হয় রাজকন্যা অভয়া। অভয়ার বিয়ের বয়স হলে নড়াইল জমিদারের ছেলে নীলাম্বর রায়ের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের কয়েক বছর পর নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অভয়া ফিরে আসেন বাবার বাড়ি। সেই সময় হিন্দুসমাজে বিধবা বিবাহের প্রথার প্রচলন না থাকায় বাকি জীবন পূজা-অর্চনা করে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন অভয়া। শিবভক্ত অভয়া পূজা-অর্চনার জন্য বাবাকে একটি মন্দির নির্মাণ করে দিতে অনুরোধ করেন।
১৭৪৫ থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে মেয়ের জন্য ভৈরব নদের পাড়ে এগারোটি পৃথক শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন রাজা নীলকণ্ঠ রায়। পরবর্তীতে মেয়ের নামের সঙ্গে মিল রেখে ওই গ্রাম ও নগরীর নামকরণ করেন অভয়ানগর। কালের বিবর্তনে সেই অভয়ানগরই এখন অভয়নগর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরগুলো নির্মাণ করতে চুন, সুরকি ও পোড়ামাটির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। ১১টি মন্দিরের সর্ব উত্তরের মন্দিরটিকে মূল মন্দির হিসেবে ধরা হয়। মূল মন্দিরের দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি ও প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেওয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। মূল মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে মোট ৮টি মন্দির ও প্রবেশপথের দুই পাশে আরো দুইটি মন্দির রয়েছে। মন্দিরগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বড় একটি উঠান রয়েছে। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলানকৃতির দরজা। দেওয়ালগুলোতে রয়েছে পোড়ামাটির ফলকসহ সুনিপুণ কারুকাজের ছোঁয়া। প্রতিদিন মন্দিরটি একনজর দেখতে ও পূজা-অর্চনা করতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে এখানে ভিড় করেন অসংখ্য দর্শনার্থী।
খুলনা শিববাড়ী এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থী অমল রায় জানান, পরিবার নিয়ে তিনি মাঝে মধ্যে এগারো শিব মন্দির পরিদর্শনে আসেন ও পূজা করেন। তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন, নিরাপত্তা কর্মী, বিশ্রামাগার, টয়লেট ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। নারী দর্শনার্থীরা বেশি সমস্যায় পড়েন। দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এগারো শিব মন্দির কমিটির সাবেক সভাপতি মিলন কুমার পাল জানান, মন্দিরগুলো অযত্ন-অবহেলায় জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় ছিল। ২০১৪ সালে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংস্কার কাজ শুরু করে। যা ২০১৭ সালে শেষ হয়। তিনি শুনেছেন ১১টি মন্দিরের ভেতরে মূল্যবান ১১টি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ ছিল যা চুরি হয়ে গেছে। চুরি হওয়া কষ্টিপাথর উদ্ধারের দাবি জানান তিনি।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কেএম আবু নওশাদ জানান, এগারো শিব মন্দির দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ সেখানে ভিড় করে। বিশেষ করে সনাতন ধর্মের মানুষের কাছে এটি একটি তীর্থস্থান। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে পরিবেশ সুন্দর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে তিনি জানান।
অভয়নগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ্ ফরিদ জাহাঙ্গীর জানান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এগারো শিব মন্দির রক্ষার্থে উপজেলা পরিষদ সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে