Views Bangladesh Logo

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি

যুগ পেরুলেও হয়নি শেষ হত্যা মামলার বিচার

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি সাভারের রানা প্লাজা ধস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঘটে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা, যাতে প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন। যেই ঘটনায় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নাড়া দিয়েছিল বিশ্বকেও। অথচ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও ভয়াবহ ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি বিচারিক আদালতেই। অথচ বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্ট ও পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও নিষ্পত্তির জন্য যাবে এই মামলা। আর বিচারের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় কেবলই বাড়ছে ভুক্তভোগীদের দীর্ঘশ্বাস।

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলায় সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। খবর পেয়ে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা রানা প্লাজা ভবনে আসেন। গার্মেন্টস মালিকদের পরামর্শ দেন, বুয়েটের ভবন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে; কিন্তু পাঁচ গার্মেন্টস মালিক এবং তাদের লোকজন ভয়ভীতি দেখিয়ে পরদিন ২৪ এপ্রিল শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এর সঙ্গে যোগ দিয়ে সোহেল রানা বলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’ বাণিজ্যিক ওই ভবনে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। এসব কারখানায় বসানো হয় বৈদ্যুতিক ভারী জেনারেটর, ভারী সুইং মেশিন। রানা প্লাজা ধসের আগের দিন ভবনের তৃতীয় তলায় ফাটল দেখা দেয়; কিন্তু মালিকপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা না করে পরদিন পাঁচটি পোশাক কারখানা চালু করে। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় রানা প্লাজায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন একসঙ্গে পোশাক কারখানাগুলো তিনটি জেনারেটর চালু করে। ঠিক তখনই রানা প্লাজা ভবনটি বিকট শব্দে ধসে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৬ জন। নিখোঁজ দুই শাতাধিক। আর আহত হয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। যাদের অনেকেই চিরদিনের জন্য বরণ করে নিয়েছেন পঙ্গুত্ব।


এদিকে গত বছরের ১৫ জানুয়ারি সাভারে রানা প্লাজা ধসে হতাহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের করা হত্যা মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ভবন মালিক সোহেল রানাকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত করে দেওয়া আদেশ বহাল রাখেন। এরপর থেকে সোহেল রানা কারাগারে থাকলেও মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। এখনো রয়েছে সাখ্যগ্রহণ পর্যায়ে।


আসামি পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালে এ ঘটনায় হওয়া মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এরপর বিচারে কিছুটা গতি পেলেও মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা গত বছর হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। যদিও আপিল বিভাগে সেই জামিন স্থগিত থাকায় এখনো তিনি মুক্তি পাননি। বিচার শেষ না হওয়ায় আসামিরাও বছরের পর বছর কারাগারে আছেন।’ তিনি জানান, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ভবন মালিক সোহেল রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে মোট চারটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে দুদকের দুই মামলায় রায় হলেও হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলমান। অপরদিকে স্থগিতাদেশের কারণে আট বছর ধরে সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে আছে রাজউকের করা ইমারত আইন লঙ্ঘনের মামলায়।


আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ভবন ধসের ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। বাকিরা জামিনে রয়েছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকার আপিল বিভাগের নির্দেশে অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এ মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত তিন বছরেরও বেশি সময়ে মামলাটিতে ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৬৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ওমর ফারুক ফারুকী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ছয় বছর হাইকোর্টের নির্দেশে এ মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছিল। ওই স্থগিতাদেশ ২০২২ বাতিল হওয়ার পর এখন চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। তবে সমস্যা হচ্ছে অনেক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার সময় তাদের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হলেও তারা এখন সেই ঠিকানায় থাকছেন না। অনেকে অসুস্থ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে আদালতে আসতে পারছেন না। তবুও প্রতি তারিখে অন্তত সাত-আটজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সাক্ষী এলে কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে যতটা পারা যায় সাক্ষ্য নিয়ে মামলাটি দ্রুত শেষ করতে চাই।’

এদিকে ওই ঘটনায় হওয়া ইমারত আইনের মামলা স্থগিত আছে ৯ বছর ধরে। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ভিউজ বাংলাদেশকে এ বিষয়ে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় এই মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়। অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহর পক্ষে উচ্চ আদালত মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেন। সবশেষ গত বছর ১৯ নভেম্বর হত্যা মামলার সঙ্গে একসঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত নথি তলব করেন। বর্তমানে ইমারত আইনের এ মামলায় সব আসামির পক্ষে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।’

এদিকে, সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এদিকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত। তবে মূল মামলা অর্থাৎ হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত বিচার শেষ হতে কতদিন সময় লাগবে তা অজানা আসামি ও রাষ্ট্র উভয় পক্ষেরই।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ