রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির একযুগ: শ্রমিকদের জীবন-মানে আসেনি পরিবর্তন
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় দেশে এবং দেশের বাইরের চাপে বদলে যেতে শুরু করেছিল এই সেক্টরের সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি। ইতিহাসের ভয়াবহতম ট্র্যাজেডিটির একযুগ পরে এসে শ্রমিক নেতারা বলছেন, কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, যথাযথ না হলেও বেড়েছে ন্যূনতম মজুরিও; কিন্তু শ্রমিকদের জীবন-মানে আসেনি তেমন কোনো পরিবর্তন। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক নিহত এবং আরও অন্তত ১ হাজার ৭৬৯ জন আহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী ও তরুণ। কর্মরত পাঁচটি পোশাক কারখানার ৪ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে জীবিত ও অক্ষত ২ হাজার ৪৩৮ জন উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ ১৮২ জন, যাদের ১৪৬ জনেরই ডিএনএ ও কবর খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ বাকি ৩৬ জনের ডিএনএ শনাক্ত হলেও তাদের যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বরে গরমিল থাকায় পরিচয় জানা যায়নি।
রানা প্লাজা ধসের জেরে পোশাক কারখানাগুলোকে নিরাপদ পরিবেশ ও শ্রমিকদের জীবন-মানের উন্নয়ন নিশ্চিতের শর্ত দিয়ে ইউরোপীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে অ্যাকর্ড এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো গঠন করে অ্যালায়েন্স। গত বছর পর্যন্ত এসব শর্ত পূরণ করা পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩২টিতে। ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এ স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে শ্রমিকনেতারা বলছেন, দুঃসহ স্মৃতি আর আর্তনাদের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় শ্রম পরিবেশের যে দুর্বলতা সামনে এসেছে, সেটি প্রযোজ্য প্রায় সব সেক্টরেই; কিন্তু এই অভিজ্ঞতা সঞ্চালন করা যায়নি আর কোনো সেক্টরেই। বিশেষত অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকরা এখনো স্বীকৃতির বাইরেই রয়ে গেছেন। দ্রুত শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতেরও আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে হতাহতদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছিল সরকার। স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকদের ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা, একটি অঙ্গ হারানো শ্রমিকদের সাড়ে সাত লাখ টাকা, দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা প্রয়োজন, এমন শ্রমিকদের সাড়ে ৪ লাখ টাকা এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দেড় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছিল কমিটি৷ তবে তা মানা হয়নি। দেশের আইন অনুসারে শ্রম আইনে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে নির্ধারিত ২ লাখ এবং আহতদের আরও আড়াই লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ দেবার কথা বলা হয়েছিল। তবে আহতরা সবাই এই টাকা পেয়েছে কি না- তা নিয়ে বিতর্ক আছে।এই ব্যবস্থাকে বর্তমান বাস্তবতায় অপ্রতুল ও অযৌক্তিক মন্তব্য করে ভবিষ্যৎ আয়, চিকিৎসা, মানসিক চাপ, পরিবারের পোষ্যদের খরচ এবং আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় ক্ষতিপূরণের হার পুনর্নির্ধারণ এবং এ সংক্রান্ত সব মামলার নিষ্পত্তিসহ নিহতদের স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপনের দাবি জানিয়েছে বেসরকারি আইন সহায়তা সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, রানা প্লাজার ঘটনায় হওয়া ১১টি শ্রম (ফৌজদারি) মামলা এখনো ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন। এর চারটি মামলা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর্যায়ে রয়েছে, চারটি মামলার নোটিশ পত্রিকায় প্রকাশের অপেক্ষায় এবং বাকি তিনটি মামলার কজলিস্টে তারিখ বা নম্বর হালনাগাদ হয়নি। এ ছাড়া দায়রা আদালতে তিনটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২-এর মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে। দণ্ডবিধির আওতায় হত্যা এবং ভবন নির্মাণ-সংক্রান্ত দুর্নীতির বাকি দুটি মামলা ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একত্রে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে ৯৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে ১৯ মে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, রানা প্লাজার অভিজ্ঞতা অন্য শিল্প খাতে কাজে লাগানো হয়নি। এ কারণেই চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো, নারায়ণগঞ্জে হাশেম ফুডের কারখানা, নিমতলী ও চুড়িহাট্টায় আগুনের মতো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনাতেও শ্রমিকরা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত পাননি। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ওয়ার্কার্স সলিডারিটির সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, ‘রানা প্লাজার তহবিলে জমা হওয়া কয়েকশ কোটি টাকার তহবিল সম্পর্কে কোনো আপডেটই জানানো হয়নি। অথচ ট্রেড ইউনিয়নগুলো ক্রেতাদের চাপ দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিল। অথচ এখন আমরা রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার জামিনের কথা আদালত থেকেই জানছি।’
শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব সেকেন্দার আলী মিনা বলেন, ‘১২ বছর পার হলেও বিচার শেষ হয়নি, মামলাগুলো এগোচ্ছেও ধীরগতিতে। আমরা সম্প্রতি রানার জামিনে বিস্মিত হয়েছি, যা পরে সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত হয়। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে এবং আপিল বিভাগের ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির যে নির্দেশ, তা পালনে সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি।’ বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি চন্দন কুমার দের দাবি, শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে কারখানায় নিরাপত্তা কমিটি চালুর প্রস্তাবও বাস্তবায়িত হয়নি। শ্রম আইন সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, দৃঢ় আইন না থাকলে কিছুই বাস্তবায়ন করা যায় না।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, সোমবার (২১ এপ্রিল) কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়া হয়েছে, যেখানে রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের সুপারিশ এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাওয়া হয়েছে।
সামগ্রিক দিক বিবেচনায় বিশেষত রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও পরবর্তী ঘটনাগুলোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং নিয়োগপত্র প্রদান ও অধিকার ভঙ্গে আইনগত সুবিধা যেন শ্রমিকরা সহজেই পেতে পারেন, তা নিশ্চিতে ২৫টি মূল সুপারিশে গুরুত্বারোপ করেছে কমিশন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় ও খাতভিত্তিক মজুরি নিশ্চিতে জাতীয় নিম্নতম মজুরি ও কমিশন ঘোষণা, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার শর্ত শিথিল, পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত, সরকারি শ্রম তথ্যভাণ্ডার তৈরি, মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা, শ্রমিকের দক্ষতার আধুনিকায়ন ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান, আপদকালীন তহবিল গঠন, শ্রমিক ইতিহাস-ঐতিহাসিক স্থান সুরক্ষা ও স্মৃতিসৌধ গঠন, শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়িয়ে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ, শিশু-কিশোর ও জবরদস্তিমূলক শ্রম বন্ধ ও নিরাপত্তা। ২০২৬ এর আইএলও-তে প্রতিবেদন পেশকে লক্ষ্য রেখে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬’ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং শ্রমখাতের গুরুত্ব বিবেচনায় স্থায়ী শ্রম কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করেছে কমিশন।
কমিশন আরও চাইছে, শ্রম মন্ত্রণালয়ের চারটি অধিদপ্তর, সংবিধান ও শ্রম অধিকার, শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি, জাতীয় ও খাতভিত্তিক মজুরি নিশ্চিতকরণ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা, সংগঠনের অধিকার, অংশগ্রহণ ও দরকষাকষির অধিকার, জাতীয় শ্রম তথ্যভাণ্ডার গঠন, অভিবাসী শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন। কমিশনের সদস্য ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই এসেছে। আগে যেমন ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে এতো চিন্তা করা হতো না, এখন সচেতনতা বেড়েছে; কিন্তু শ্রমিকদের জীবনমানে এতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি’। তিনি বলেন, ‘কমিশন বিশ্বাস করে, সুপারিশগুলো শুধু কাগজে বন্দি না রেখে সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শ্রমিক-কৃষকের জীবনযাত্রার উন্নয়নে বাস্তবায়িত হবে। ফলে তাদের জীবনমানেরও দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে