২০৩০ সাল: এআই বিপ্লব না কী মানবজাতির অশনিসংকেত
মানবজীবন কি যন্ত্রের দাসত্বে চলে যাচ্ছে? এক সময় এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে কত দ্বিধা ছিল, খোদ বিজ্ঞানীরাও ছিলেন সন্দীহান; কিন্তু চোখের পলকে বদলটা ঘটে গেলে। ২০০০ সালের পৃথিবী আর এখনকার পৃথিবীর মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য অর্জিত না হলেও, আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। আর এই অসাধ্য সাথন করেছে স্মার্টফোন নামের ছোট্ট যন্ত্রটি। একটা সময় পৃথিবী রোবটদের দখলে যাচ্ছে বলে যারা হাহাকার করতেন, তারাও এখন অন্য শঙ্কায় ভুগছেন। মানুষের মতো দেখতে বিশাল যন্ত্র কিংবা যন্ত্র দানব নয়, এখনকার ভয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। এক দশক আগেও যেটা কল্পকাহিনি মনে হতো, সেই এআই প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। আগের কল্পবিজ্ঞানীরা যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারক হিসেবে দানব রোবটদের দেখিয়েছেন, এখন তারাও আঁৎকে উঠছেন অন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা বাহারি নামের সব এআইয়ের কথা শুনে; কিন্তু এ আইকে নিয়ে যতটা আশঙ্কা করছি আমরা, ততটাই কি বিপজ্জনক এটা? যদি তা-ই হবে, তাহলে বিশ্বব্যাপী টেকজায়ান্টগুলো এআইতে বিনিয়োগ করছেন কেন? সত্যিই কি তারা আত্মবিধ্বংসী কোনো খাতে পয়সা ঢালছেন?
২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর পুরোপুরি ডিজিটাল মার্কেটিংনির্ভর হয়ে পড়বে। এখনি পণ্য বা ব্যবসার প্রচার-প্রচারণায় ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্ট্যাগ্রামের মতো সোসাল মিডিয়াগুলো। শোরুম বা দোকানে রেখে পণ্য বিক্রি করতে হবে–এ ধারণা ভাঙতে শুরু করেছে এখনি। তাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপারশপ হয়ে উঠেছে আমাজান, আলিবাবার মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো–উবারের দখলে বিশ্বের বেশিরভাগ রেন্ট ট্র্যান্সপোর্ট সার্ভিস। আমাদের মতো উন্নয়শীল দেশেও দারাজ, রকমারি, পাঠাওয়ের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো রমরমা ব্যবসা করছে। এত মার্কেটিং প্রচারণার জন্য কোটি কোটি কন্টেন্ট আর গ্রাফিক্স ডিজাইন প্রয়োজন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। দিনকে দিন বাড়ছে চাহিদা। শুধু মানবনির্ভরশীল হয়ে এ চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। তাই সবচেয়ে ভালো হয় যন্ত্রকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া; যার আমরা গালভরা নাম দিয়েছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আশির দশকে গবেষকরা যেমনটা ভেবেছিলেন, কৃত্রিমত্তা এখন সে জায়গা নেই–যন্ত্র না হলেও চলে, স্রেফ একটা সফটওয়ারই যথেষ্ট, তার প্রমাণ চ্যাটজিপিটি কিংবা মিডজার্নির মতো কৃত্রিমবুদ্ধি। আমাদের পরবর্তী টার্গেট এখন আইওটি–অর্থাৎ ইন্টারনেট অব থিংস। এটা এমন এক সিস্টেম, আপনার আপনার বাসার কিছুতেই আর হাত দিতে হবে না। সময়মতো ফ্যান বা এসি ছাড়া; মানুষের অনুপস্থিতে ফ্যান লাইট বন্ধ করা, ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে বিদ্যুৎ-গ্যাস বা পানির বিল দেওয়া, বাচ্চা-পোশা প্রাণীর দেখাশোনা; ঘরের জানলা-দরজা প্রয়োজন বুঝে খোলা বা বন্ধ করা ইত্যাদি। ভবিষ্যতে এর সঙ্গে যুক্ত হবে অটোমেটিক রান্নাবান্না, বাজাই-সদাই বা বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেয়া করবে যে রোবট তাকে নিয়ন্ত্রণ করা। তখন আসলে মানুষের কাজ কী হবে সেটা এখনি নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।
এই আইওটি সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কোনো অ্যাপ। সেই অ্যাপটা বাস করবে কোথায়, নিশ্চয় আপনার পিসি বা স্মার্টফোনে? এতদিন তা-ই ভাবা হচ্ছিল; কিন্তু সময় বদলে গেছে, যে স্মার্টফোনের এত কদর, যেটা ছাড়া আমাদের জীবন এখন কল্পনাই করা যায় না, সেটাই ২০৩০ সাল নাগাদ থাকবে কিনা সন্দিহান খোদ প্রযুক্তি গবেষকরাও বরং আপনার মোবাইল ফোনের বদলে আপনার শরীরের ভেতরে লাগিয়ে দেওয়া হবে মাইক্রোচিপ; যে নিয়ন্ত্রণ করবে গোটা আইওটি সিস্টেমকে। আপনার নিত্যদিনের জীবন দেখভালের পাশাপাশি আপনার স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ্য রাখবে। শরীরে কোনো ক্ষতিকর জীবাণু প্রবেশ করল কি না, কিংবা অজান্তেই রক্ত বা সাধারণ কোষের ভেতর ক্যান্সার কোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কি না; ব্ল্যাডসুগার, কোলস্টেরল, হরমন ইত্যাদির লেভেল ঠিক আছে কি না, তাও মনিটর করবে সেই মাইক্রোচিপ। শরীরের ভেতর কোথাও বেচাল দেখলে আপনাকে জানিয়ে দেবে, প্রয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই দেবে সমাধান। অবস্থা যদি দ্রুত সিরিয়াস মোড় নেয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই অনলাইন ব্যবহার করে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেবে অবস্থা, তার পরামর্শ মোতাবেক অর্ডার করবে ওষুধ। আপনি কী করবেন না করবেন ভাবছেন, তার আগেই হয়তো দেখবেন রোবট বা ডেলিভারি বয় ওষুধ নিয়ে হাজির। শুনতে কল্পকাহিনির মতো লাগলেও আসলে এটাই ঘটতে যাচ্ছে, সেটা পরবর্তী দশকেই। তাই টেকজায়ান্টরা যে আগেভাগেই মাঠে নেমে পড়বেন, সেটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ফোর্বস জরিপে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। প্রভাবশালী এই ম্যাগাজিনটি জানিয়েছে, অ্যাপের পাশাপাশি মানুষের মতো দেখতে যন্ত্রমানবের দেখা মিলবে যত্রতত্র। যদিও এখনি বাজারে আছে হিউম্যানয়েড রোবট। কিন্তু কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার চূড়ায় ওঠার পর, ২০৩০ সালের দিকে মানবসমাজে এদের আনাগোনা বাড়বে উল্লেখযোগ্য হারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারের চালচিত্র তুলে ধরেছে পত্রিকাটি। চ্যাটচিজিপিটি ওপেনএআই), গুগল নয়, বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তসম্পন্ন চিপ তৈরির দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে এনডিভিয়া নামে এক মার্কিন প্রতিষ্ঠান, যাদের মূলধন ২ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ ২০২২ সালেও প্রতিষ্ঠানটির মূলধন ছিল মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ডলার। তাই বলে এও ভাবা ঠিক হবে না, অন্যরা এনডিভিয়ার হাতে বাজার ছেড়ে দেবে। বরং প্রবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আরেক বিখ্যাত টেকজায়ান্ট ইনটেল বেশ সাড়ম্বরেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে, খুব শিগগির হয়তো ইনডিভিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে ইনটেল। শুধু তা-ই নয়–অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, এএমডি, আলফাবেট, মেটা (ফেসবুক-ইনস্টিাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এই প্রতিযোগিতায় পাখির চোখ করেছে।
বর্তমানে এই এআইকে টাইপিং করে কিংবা ভয়েজ কমান্ডের সাহায্যে নির্দেশনা দিতে হয়, সেই মোতাবেক সে কাজ করে। ২০২৩ সালের মধ্যে মানুষে-মানুষে যেভাবে আমরা যোগাযোগ করি, এআই বা রোবটের সঙ্গেও আমাদের এভাবে যোগাযোগ হবে। সত্যিকার অর্থেই তকন হয়তো শিক্ষক, পরামর্শক, একান্ত সচিব, আইনজ্ঞা বা হিসাব রক্ষকের দরকার হবে না। এআই তখন সব কাজের কাজীতে পরিণত হবে।
এখনকার হিউম্যানয়েড রোবটগুলো দেখতে মানুষের মতো হলেও, মানুষের মতো এত বিচিত্র কাজ বা ভাবনাচিন্তা সে করতে পারে না। রেস্টুরেন্টে যেসব রোবটগুলো দেখা যায় উন্নত বিশ্বে, সেগুলো শুধু হোটেলের বেয়ারার কাজই করতে পারে। খাবার বা পানীয় সার্ভের চেয়ে বেশি কিছু এদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। রোবটিক গাড়িগুলো শুধু বুদ্ধিমান গাড়ির মতো কাজ করে, কিংবা কারখানায় যে বিশাল রোবটিক হ্যান্ড, সেগুলো আবেদন কারখানাতেই সীমাবদ্ধ, এদের দিয়ে অন্য কাজ করানো মুশকিল; কিন্তু ২০৩০-এর দশকে যে সব রোবট আসবে, সেগুলোর মগজ হিসেবে কাজ করবে এআই প্রযুক্তি। সারা দুনিয়ার অনলাইন ডাটা তার মগজে ভর্তি। এর ফল তো পাওয়া যাবেই, রোবটগুলো নিজে নিজেই ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এ জন্য সময়ক্ষেপণ প্রায় করবে না বললেই চলে। তাই মানুষ যে কাজ দিনের পর দিন সময় নিয়ে করে, সেই কাজ হিউম্যানয়েড রোবটের করতে সময় লাগবে হয়তো কয়েক সেকেন্ড। তখন মানব সভ্যতা হয়তো সুপারসনিক গতিতে পৌঁছে যাবে।
ইতিমধ্যে এলন মাস্কের টেসলা কোম্পানি অপটিমাস নামে এক ধরনের রোবট তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে, ২০৩০ সাল অনেক দেরি–তার আগেই অর্থাৎ ২০২৫ সাল নাগাদ অপটিমাস বাজারে আসবে।
অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ মানবসভ্যতা একটা বড় লাফ দিতে চলেছে; কিন্তু এই লাফের ফল আত্মঘাতী হবে কিনা সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। ফোর্বসের প্রতিবেদন বলছে, বেশিরভাগ মানুষ চাকরি হারাবে এআই বিপ্লবের কারণে। জীবনকে সহজ করতে গিয়ে যদি নিজেদের বেকার করে ফেলি আমরা, মানবসভ্যতার মূল ধরেই কি টানাটানি হবে না?
এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের হাতে নেই; কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানী, সাইকোলজিস্ট, বিজ্ঞানী, গবেষকেদর সঙ্গে বসে প্রযুক্তিবিদরা যদি আশু কোনো সমাধান বের না করতে পারেন, তাহলে এআই মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।
লেখক: বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে