২২তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব: সবচেয়ে সফল উৎসবগুলোর একটি
আমার তারুণ্যে যে একটা চলচ্চিত্র উৎসব সম্পর্কে জানতাম, তা হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কথা। এখনো স্মৃতিতে ঝলঝল করে ছবি দেখার জন্য পাবলিক লাইব্রেরির খোলা চত্বরে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। নতুন বিল্ডিং তুলবে বলে পাবলিক লাইব্রেরির পুরোনো বিল্ডিংটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। উৎসবের মূল ভেন্যু এখন জাতীয় জাদুঘর। নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে ঢুকতে হয় বলে সেখানে আর তেমন ভিড় হয় না। চলচ্চিত্র প্রেমিকরা স্বতন্ত্র প্রজাতির মানুষ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা ছবি দেখবে, মাঝে মঝে গালগল্প করবে এই তাদের স্বভাব।
গত ৩২ বছরের প্রচেষ্টার ফলে এবারের ২২তম ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসব ভিন্নমাত্রা ছুঁয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে উৎসবের পরিচালক আহমেদ জামালের কল্যাণে। তার সঙ্গে ছিলেন রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের অন্যান্য নিবেদিত-প্রাণ কর্মীরা। তাদের প্রতি আমার সীমাহীন কৃতজ্ঞতা। কেন এবারের উৎসবটি সবচেয়ে সফল উৎসব হিসেবে বিবেচিত হবে? আমি এর উত্তর দিতে চাই আয়োজকদের দিয়ে। অভিজ্ঞ কর্মীদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের মেলবন্ধন এবার হয়ে উঠেছিল অতুলনীয়। তাই ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে দক্ষ নাবিকদের নিয়ে ক্যাপ্টেন তার জাহাজটি ভাসিয়ে নিতে পেরেছেন।
চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট দেশি-বিদেশি শতাধিক গুণীজনের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল এবারের উৎসব-প্রাঙ্গণ। এদের মধ্যে ছিলেন মাজিদ মাজিদি, শর্মিলা ঠাকুর, অঞ্জন দত্ত, মমতা শংকর, মোর্তেজা আতাশজমজম, স্বস্তিকা মুখার্জির মতো শিল্পী-পরিচালকরা। ৯দিন ধরে ৭৪টি দেশের ২৫২টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে এবার। অনেক চলচ্চিত্র যে শুধু উপভোগ্য ছিল, তা নয়। ছিল চিন্তার খোরাকও। মানুষজন এগুলোর প্রশংসা করেছে। এসব চলচ্চিত্র বাছাই করাও একটা বড় ব্যাপার।
এতো সব গুণী অতিথি ও প্রতিনিধি এত বড় একটা ইভেন্টে যোগ দেয়ার কারণে মূল চ্যালেঞ্জটি শুরু হয় উৎসবের আগের দিনই। কাজ তো আর একটা নয়, শতটা। এর মধ্যে আছে যথাসময়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা, প্রশ্ন-উত্তর পর্ব, সংবাদ সম্মেলন, আরও কত কী! সম্মানীত অতিথিদের নিয়ে এসব ঠিকঠাক সামলানো চ্যালেজিং বটেই। অতিথিদের থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের সুনিপুণ ব্যবস্থাও আয়োজকদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ; কিন্তু তারা এটা ভালোভাবেই সামলেছেন। পুরো আয়োজন সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছেন। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। এই কষ্ট সবাই আনন্দচিত্তে মেনে নিয়েছেন। চলচ্চিত্রের এটাই শক্তি। উৎসবেরও এটাই প্রেরণা। ২২তম উৎসবের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আসলে শর্মিলা ঠাকুর, মাজিদ মাজিদি এবং অঞ্জন দত্তের মতো ব্যক্তিত্বদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান। আয়োজকরা এটাও সফলভাবেই করেছেন। আমার জন্য বড় কাজটি ছিল পরপর তিনটি মাস্টার ক্লাস পরিচালনা করা।
আরও বড় আনন্দ ও চাপের ব্যাপার ছিল চীনা প্রযোজক ড. শি চুয়ান, বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক মাজিদ মাজিদি এবং অভিনেতা-গায়ক ও পরিচালক অঞ্জন দত্তের পাশে বসে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করা। চাপটা ছিল কাজটা ঠিক মতো করতে পারব কি না, তা নিয়ে! কিন্তু, ইভেন্টের শেষে যখন অংশগ্রহণকারীদের প্রশংসায় ভেসে যেতে লাগলাম তখন চাপটা একটু কমলো।
মাস্টার ক্লাসের আগের দিন দুপুরবেলা অঞ্জন দত্ত যখন ঢাকা ক্লাবে এলেন উৎসব-পরিচালক আমাকে ডেকে পাঠালেন। নিজের পরিচয় দিতেই অঞ্জন দত্ত আমার লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি তার ‘চালচ্চিত্র এখন’ চলচ্চিত্রটি নিয়ে লিখেছি। তিনি এটা তার ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। এখন আমাকে সামনে পেয়ে তিনি ছবিটি সম্পর্কে আরও কথা জানতে চাইলেন।
দুপুরের খাবার টেবিলে আমি মন দিয়ে তার কথা শুনলাম এবং পরিকল্পনা করলাম কীভাবে পরদিন এগুলো মাস্টার ক্লাসে তুলে ধরব। খাওয়া শেষ করেই অঞ্জন দত্ত ছবির স্ক্রিনিংয়ে চলে গেলেন। আমি শর্মিলা ঠাকুরের প্রেস মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বিশিষ্ট অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ আসাদুজ্জামান নূর এটা পরিচালনা করেছিলেন। অসীম ধৈর্য নিয়ে শর্মিলা ঠাকুর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
সে-রাতে খাবার টেবিলে বসে, আমি দেখলাম মাজিদ মাজিদি আমার টেবিলের দিকে হেঁটে আসছেন। তিনি এসে আমার পাশেই বসলেন। আরেকজন ইরানি পরিচালক, মোর্তেজা আতাশজমজম (দিন দ্য ডে, ফেরেশতেহ) আমাদের সঙ্গে বসলেন। ফার্সি ভাষা বলতেই মাজিদ মাজিদি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাই মোর্তেজা আমার ইংরেজি ভাষান্তর করে তাকে বোঝাচ্ছিলেন। খেতে খেতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন মাস্টার ক্লাসে কী নিয়ে আলাপ করব।
পরদিন মাস্টার ক্লাস শুরু হলো ড. সি চুয়ানের সঙ্গে। তার বক্তব্য শ্রোতাদের চীনা চলচ্চিত্র শিল্প সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা দিল। যেমন, প্রতি বছর চীনে শত শত বিদেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, সাবটাইটেল ও ডাবিংসহ। এর মধ্যে ভারতীয় ছবিরও একটা বড় বাজার আছে। তিনি এও বললেন বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ-প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের গল্পের দিকেই মনোযোগ দিতে হবে।
শি চুয়ানের মাস্টার ক্লাসের পর, কিছুক্ষণ বিরতি চলল। বিরতির ফাঁকে আমি ঢাকা ক্লাবে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। উৎসব পরিচালক কল দিয়ে বললেন এর পর মাজিদ মাজিদির সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য। কিছু কথার পর মাজিদি বললেন, তিনি একটু ধূমপান করবেন। তিনি বাইরে বেরিয়ে গেলেন। গ্লাসের ভেতর দিয়ে আমি দেখলাম তিনি কায়দা করে সিগারেট টানতে টানতে ঢাকার আকাশ দেখছেন। আমি তার কাছে গিয়ে বললাম যেভাবে আছেন সেভাবেই থাকুন, এভাবেই আপনার কিছু ছবি তুলব।
তিনি রাজি হলেন, এবং আগের মুডে ফিরে গেলেন। আমার ক্যামেরায় সেই মুহূর্তগুলো ধারণ করলাম। তারপর তাকে নিয়ে গেলাম জাতীয় জাদুঘরে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর দেখলাম শর্মিলা ঠাকুর বসে আছেন দর্শকসারিতে। মাজিদি যখন বললেন সত্যজিৎ রায় আর ভিক্টোরিও ডি-সিকা তার অনুপ্রেরণা, আমি বললাম সত্যজিৎ রায়ের শিল্পী শর্মিলা ঠাকুর বসে আছেন আমাদের সামনে। দুজন তখন শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সেখানে থাকতে পেরে মুহূর্তটা আমিও উপভোগ করলাম। মাজিদির পর অঞ্জন দত্ত যখন স্টেজে এসে উঠলেন প্রেক্ষাগৃহ তখন পরিপূর্ণ। অঞ্জন দত্ত কথা বলেন সুরের জাদুতে। মানুষজন নিবিষ্ট হয়ে তার কথা শুনলেন। আমি শুধু কথা ধরিয়ে দিলাম। প্রশ্ন-উত্তর পর্বটিও অঞ্জন দত্ত মাতিয়ে দিলেন।
পরিশেষে আরও কিছু মিষ্টান্ন বাকি আছে। আর তা হলো অঞ্জনের গান! গিটার বাজিয়ে তিনি একঘণ্টা ধরে গাইলেন তার কিছু জনপ্রিয় গান। নতুন একটা গানও গাইলেন। গানটা আত্মহত্যা নিয়ে। জানালা দিয়ে শরতের রোদ দেখে সোমনাথ নামের একজন আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিয়েছে। দুঃখ ভারাতুর গানটা আমাকে প্যাচ আডামসের কথা মনে করিয়ে দিল। রবিন উইলিয়াম অভিনয় করেছিলেন মূলচরিত্রে। আত্মহত্যার পরিবর্তে জীবনের জন্য ছিল সেখানে রঙিন প্রজাতির রূপক।
রাতে যখন অঞ্জন দত্তের সঙ্গে আবার কথা বললাম, তিনি বললেন তিনি এটা দারুণ পছন্দ করেছেন। ঠান্ডায় তার গলা বসে গেছে। তাও ভালোবাসার জোরে তিনি দশটা গান গাইলেন। উৎসব-পরিচালক আমাদের টেবিলে বসে ছিলেন। অঞ্জন দত্ত তাকে বললেন, আহমেদ ভাই, আপনি দর্শকদের মধ্যে ছিলেন বলেই আমি গাইতে পারলাম। সে রাতে বেজে উঠল বিদায়ের সুর। তাই মানুষজন যত পারে ছবি তুলছিলেন। আমি ছিলাম বাংলাদেশ প্যানেরামা বিভাগের এফআইপিআরইএসসিআই জুরি। দলের একজন বিচারক, ফিলিপাইনের জেসন ট্যান লিওয়াগ এর মধ্যে ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। জেসনের মতো মমতা শংকর এবং তার ছবি ‘বিজয়ের পরে’-এর পরিচালক ও প্রযোজকও সমাপনী দিনের আগেই দেশে ফিরে গেছেন।
উৎসবের মাঝামাঝিও অনেকে যোগ দিয়েছেন। যেমন, ‘দ্য ফ্লাওয়ার’ ছবির পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেত্রী দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছেন। তারাও মাস্টার ক্লাসে অংশ নিয়েছেন। ছবির অভিনেত্রী শান্তি রাও বললেন আমার অবশ্যই তাদের ছবি দেখা উচিত। এখনো অনেক ছবি দেখা বাকি। তাদের ছবি ছিল স্পিরিচুয়াল বিভাগে। উৎসবে বাংলাদেশ প্যানোরামায় আমি মোট ৩২টি ছবি দেখেছি।
দক্ষিণ কোরিয়ার ফিপ্রেসি জুরি চ্যাং সিওক-ইয়ং আর বাংলাদেশের মফিদুল হক সমাপনীর শেষ পর্যন্ত ছিলেন; কিন্তু, সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে শর্মিলা ঠাকুর ঢাকায় ছিলেন দশ দিন। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত। ঢাকার আতিথেতায় তিনি মুগ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি অপরিসীম আনন্দ প্রকাশ করলেন। উৎসবে শর্মিলা ঠাকুর যেভাবে আলো ছড়ালেন, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। উৎসবের যবনিকাপাত হলো জানুয়ারির ২৮ তারিখ; কিন্তু তা সাময়িক। আগামী বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ফিরে আসবে আরও আলো নিয়ে। আরও আনন্দ ও মানুষের ভালোবাসা নিয়ে।
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক; বিচারক, ফিপ্রেসি, কান চলচ্চিত্র ৭৫তম উৎসব
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে