Views Bangladesh Logo

৫১ বছর নির্বাসনের পর বিদায় কবি দাউদ হায়দার

Nasir  Ahmed

নাসির আহমেদ

ন্মের উল্টো পিঠেই অলঙ্ঘনীয় মৃত্যু। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষ সবাইকেই সেই অমোঘ সত্যের কাছে একদিন না একদিন নতি স্বীকার করতেই হয়। সেই অনিবার্য মৃত্যুর হাত ধরে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন কবি দাউদ হায়দার (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-২৬ এপ্রিল ২০২৫)।

আর একটিও নতুন কবিতা লেখা হবে না তার। সুদূর বার্লিন থেকে কথাও হবে না বাংলাদেশে আর কারও সঙ্গে। পৃথিবী নামের এই গ্রহ থেকে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন দাউদ হায়দার। এই অনন্ত বিলয়ের জগতে সবাই যায়; কিন্তু সবটুকু বিলয় সবার ক্ষেত্রে ঘটে না। কেউ কেউ চির প্রস্থানের পরও অংশত, খণ্ডিতভাবে থেকে যান তাদের সৃষ্টিশীলতায় স্মৃতি নিয়ে, স্মরণের প্রদীপ তারা জ্বেলে রাখেন অন্যভাবে। খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী তথা সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী সান্ত্বনা স্বজন-বন্ধুদের জন্য এটুকুই।

বহুল আলোচিত-সমালোচিত কবি দাউদ হায়দারও অনেকদিন তার সৃষ্টিশীলতার মধ্যেই হয়তো নিজেকে জ্বালিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন। একটি মাত্র কবিতার জন্য এক জনমের নির্বাসন! বিস্ময়কর বটে; কিন্তু দাউদ হায়দারের ক্ষেত্রে এটাই সত্য হয়েছে। একটি কবিতায় ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত পেয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের আন্দোলনের মুখে ১৯৭৪ সাল থেকে পরবর্তী সারাটা জীবনের জন্য জন্মভূমিহীন নির্বাসিত একজন মানুষ হয়ে গেলেন কবি দাউদ হায়দার!

হযরত মুহাম্মদ (সা.), যিশু খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মের প্রবর্তক ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য সংবলিত একটি কবিতা প্রকাশের পর ১৯৭৪ সালে যে তুমুল প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিলেন দাউদ হায়দার, মূলত তা-ই তাকে দেশছাড়া করেছে। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল সংবাদের সাহিত্য পাতায় ১৯৭৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল এর তিন মাসের মধ্যে, ২১ মে ১৯৭৪।

সাংবাদে এই বিতর্কিত কবিতাটি ছাপা হওয়ার আগেই দাউদ হায়দার সুপরিচিত। বয়সে তরুণ হলেও কবি হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ “জন্মই আমার আজন্ম পাপ”-এর জন্য। তাছাড়া ১৯৭২ সালে তিনি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছেন কবিতার জন্য।
অনেকেই মনে করেন জন্মই আমার আজন্ম পাপ শিরোনামের কবিতাটির জন্যই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছিল। আসলে তা নয়। যে কবিতায় ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের নবী ও অবতারদের নামের আগে নেতিবাচক বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন দাউদ, ওই কবিতাটির শিরোনাম ছিল “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়”।

কবিতাটি সংবাদে যখন সাহিত্য পাতায় প্রকাশ করা হয় তখন সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন দাউদ হায়দার নিজেই। এ নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিবাদ হয়নি, গণ্ডগোল শুরু হয় ঢাকা কলেজের একজন শিক্ষক এই কবিতায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদ জানিয়ে কবি দাউদ হায়দারের নামে মামলা দায়েরের পর। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালের ১১ মার্চ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় আন্দোলন শুরু হয় মূলত তাকে গ্রেপ্তারের পর। তথ্যসূত্রে দেখা যায়: “১২ মার্চ বায়তুল মোকাররমে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংবাদ পত্রিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় এবং ২৪ ফেব্রুয়ারির পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এর পর পত্রিকার কয়েকটি কপিতে অগ্নিসংযোগ করে, একটি মিছিল সংবাদ অফিসের সম্মুখে বিক্ষোভ করে ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বাংলাদেশ সিরাত মজলিস, বাংলাদেশ সাবান শ্রমিক ইউনিয়ন তীব্র নিন্দা জানায়।”

তখন কবির বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ শুরু হয়। এমনকি তার জন্মস্থান পাবনায়ও প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। ১১ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও ২০ মে তিনি মুক্তি পান; কিন্তু তৎকালীন সরকার তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। মুক্তির পরদিনই অর্থাৎ ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে একমাত্র যাত্রী দাউদ হায়দারকে নিয়ে ফ্লাইটটি কলকাতায় অবতরণ করে।

তাকে রীতিমতো খালি হাতেই কলকাতায় পাঠানো হয়। কবি লিখেছিলেন, ‘সে সময় তার কাছে ছিল মাত্র ৬০ পয়সা, কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দুজোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ। তার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা তাকে মেরেই ফেলত।’

দেশ থেকে বহিষ্কারের পর দাউদ হায়দার ১৩ বছর কলকাতায় ছিলেন। পরে জার্মানির নোবেল বিজয়ী কথাসাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের সহযোগিতায় ১৯৮৬ সালের ২২ জুলাই জার্মানি চলে যান। পাসপোর্টহীন কবি গিয়েছিলেন জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্টে। তখন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জার্মানির বার্লিন শহরে বসবাস করে আসছিলেন। মাঝে মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতেন এবং তার যৌবনের স্মৃতির শহর কলকাতায়ও যেতেন।

এ প্রসঙ্গেই উল্লেখ করতে হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দাউদ হায়দারই প্রথম কোনো সাহিত্যিক, লেখার জন্য যাকে নির্বাসনে যেতে হয়। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কবি দাউদ হায়দার নির্বাসনে ছিলেন। স্বদেশের জন্য তার হাহাকার এবং কান্না গোপন থাকেনি। স্মৃতি কোথায় যেমন কবিতা ও তেমনি এর পরিচয় স্পষ্ট। এই দীর্ঘ ৫১টি বছর তার আর মাতৃভূমির বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়া হয়নি। দেশের কোনো সরকারও তাকে বাংলাদেশে ফেরানোর কোনো উদ্যোগই নেয়নি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দাউদ হায়দারের পক্ষে ভারতে অবস্থানও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ১৯৭৬ সালে। কথিত আছে যে, তিনি নবায়নের জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন উপদূতাবাসে। তা আর নবায়ন করে দেয়া হয়নি। আবার এমন ভাষ্যও আছে যে, ১৯৭৬ সালে কলকাতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় বসবাসকালেই সরকারি নির্দেশে দাউদ হায়দারের পাসপোর্ট সিজ করে কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপদূতাবাসের কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সরকারের আমলে পাসপোর্ট চেয়ে আবেদন করেও বাংলাদেশের পাসপোর্ট আর পাননি কবি দাউদ হায়দার। এমনকি প্রেসিডেন্ট হোসেন মুহাম্মদ এরশাদের কাছে কবি হিসেবেই আরেকজন কবি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেদন করেছিলেন দাউদ হায়দার; কিন্তু যে সরকার প্রধান রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন তার পক্ষে কি দাউদ হায়দারের মতো কবিকে ফিরিয়ে আনার মানসিক শক্তি থাকে? দাউদ হায়দারের একটি কবিতাও কোনো দিন পড়েননি এমন মানুষ যেমন তার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, দু চারটি কবিতা যারা পড়েছেন তারাও অনেকেই জানেন না কেন কীভাবে তিনি দেশ ছাড়া হলেন!

১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে দাউদ হায়দারকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে দাউদ তার আত্মজীবনীতে যেমন বিস্তারিত লিখেছেন তেমনি বিভিন্ন রিপোর্ট থেকেও তৎকালীন পরিস্থিতির বিবরণ আমরা জানতে পারি।

কলকাতায় গিয়ে তিনি প্রথমে উঠেছিলেন ভারতের আনন্দবাজার গ্রুপের প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং বিখ্যাত লেখক গৌর কিশোর ঘোষের বাসায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তাকে স্থায়ী আশ্রয় দেন বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল ইন্ডিয়ান সির্ভিস সার্ভিসের ঝানু কর্মকর্তা (অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস) অন্নদাশঙ্কর রায়। তার বাসায় থেকেই প্রায় এক যুগ কাটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। এই দীর্ঘ সময়ে সেখানকার গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার সঙ্গে যেমন যুক্ত ছিলেন তেমনি কবিতা-গদ্যসহ বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি-অনুবাদও করেছেন।

তিনি যে ভারত থেকে অন্য কোথাও যাবেন, পাসপোর্টহীন কবির পক্ষে সে উপায় ছিল না। জার্মানিতে তার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন নোবেল বিজয়ী জার্মান কথা সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস।

অনেকেরই মনে পড়ার কথা ১৯৮৬ সালে সস্ত্রীক গুন্টার গ্রাস প্রায় দু-তিন মাসব্যাপী বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছিলেন। ঢাকা সফরকালে তার গাইডের ভূমিকা পালন করেছিলেন স্বনামখ্যাত কবি বেলাল চৌধুরী। তিনি দাউদ হায়দারের সংকট নিয়ে গুন্টার গ্রাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন জার্মানিতে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে ভূমিক রাখার জন্য। গুন্টার গ্রাস কথা দিয়েছিলেন এবং সে কথা তিনি রেখেছেন। জার্মান সরকারের উচ্চমহলে কথা বলে পাসপোর্টহীন কবি দাউদ হায়দারকে জাতিসংঘের ইস্যু করা বিশেষ ট্রাভেল ডকুমেন্টে ১৯৮৭ সালের ২১ জুলাই জার্মানিতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ওই ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়ে দাউদ বিশ্বের বহু দেশ সফর করেছেন।

কবির নির্বাসিত জীবনের প্রায় চার দশক কেটেছে বার্লিনে। অমৃতা অকৃতদার অসাধারণ মেধাবী দাউদ হায়দার তার কবিতায় এই নিঃসঙ্গতা আর জন্মভূমির জন্য তৃষ্ণার দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে রেখে গেছেন। প্রায় ৩০টির মতো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। এছাড়া গল্প-উপন্যাস, স্মৃতিকথা, অনুবাদসহ নানামাত্রিক রচনায় নিজের সৃজনশীলতার স্বাক্ষর উত্তীর্ণ করে রেখে গেছেন।

এবার কবি দাউদ হায়দারের কবিতার দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক: দাউদ হায়দার অতি তরুণ বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন, যে কারণে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে কবি হিসেবে তার পরিচিতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। বিশেষ করে ১৯৭০ এবং ৭১ সালের ডেট লাইনের যেসব কবিতা, তা পড়লে কবির পরিপক্বতা এবং দূরদৃষ্টি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
১৯৭৩ সালের নভেম্বরে বেরিয়েছিল তার বহুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। উৎসর্গ করা হয়েছিল তার বিখ্যাত তিন সাহিত্যিক অগ্রজ জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার ও মাকিদ হায়দারকে।
ওই গ্রন্থের একটি কবিতার ডেট লাইন ২৮/৯/৭১।

দাউদ লিখেছেন, ‘এদেশ এখন সৈন্যকবলিত
এ মাটি এখন রক্ত কিংশুক
এই আমার দেশ।
স্বদেশে নেমেছে সান্ত্রী।
সান্ত্রীর বুটের আওয়াজ তীক্ষ্ণযাত্রী।
এই আমার স্বদেশ
মিছিলে মৃত্যুতে উজ্জ্বল।
এই আমার আকাশ
আকাশ বজ্রগর্ভে আলোকিত।
বাতাস বারুদগন্ধে ভরপুর।
এই আমার দেশ। আমার স্বদেশ
মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল।”

বোঝাই যায় ১৯৭১ সালের পাকি-হানাদার কবলিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ছবি এটি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা মুক্তিযুদ্ধের আগের অর্থাৎ ১৯৭০-৭১ সালে লেখা কোনো কোনো কবিতা গণ-আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি নির্যাতনের জ্বলন্ত ছবি।

‘জর্নাল স্মৃতিচিত্র’ শিরোনামের একটি কবিতায় অসামান্য চিত্রকল্পময় বৃষ্টির বর্ণনা দেখে সচেতন পাঠক অনুভব করতে পারবেন কবি জীবনের সূচনাতে তার কবিত্ব শক্তির দ্যূতি। মেঘ, বৃষ্টি, আকাশ, নদী, জ্যোৎস্না কুয়াশা এসব রূপকের মধ্য দিয়ে বিন্যাস করা হয়েছে কবিতাটির।

প্রচলিত কাঠামোগত ছন্দের মধ্যে না থেকেও ছন্দের সুরের প্রবাহটি দাউদ হায়দার আপন দক্ষতায় রক্ষা করেছেন অনেক কবিতায়। কোনো কোনো কবিতার অন্ত্যমিলও দেখতে পাই। মহাশ্বেতা শিরোনামের কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যাক:
‘বলো মহাশ্বেতা
এই দেশ নিয়ে কেন আদিখ্যেতা?
কী পেয়েছে দেশের মানুষ, সাধারণ?
দিনরাত্রি কেবল ভাষণ,
কান ঝালাপালা। নিশ্চয় নির্বোধ
আমরা। কখনো প্রতিরোধ
করিনি সদলে
শুনেছি শহরে, মফস্বলে
ঠিক দুপ্পুর বেলায় ভূতে মারে ঢেলা-
তাই যদি হয়, সারাবেলা
ভূত আনাচেকানাচে
দূরে কাছে
জানো মহাশ্বেতা
এই জাতি
আত্মঘাতী
সমাজের প্রতি-গৃহে
বহুব্রীহে”

তার কবিতার বিচিত্র বিষয়ের মধ্যে দেশ মাটি, প্রবাসী থেকেও যেমন হারায়নি বাঙালিত্বকে আঁকড়ে থেকেছেন আমৃত্যু। আন্তর্জাতিক সাহিত্যভুবনের সঙ্গে ছিল গভীর যোগ। সেই ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কবিতায়। তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে বলতেও অনেক সময় বিশ্ব সাহিত্যের হালচাল টের পেয়েছি, জানার সুযোগ হয়েছে সমকালীন জার্মান নাটক এবং কবিতা বিষয়ে। ব্যাপক পড়াশোনা আর বিশ্বসাহিত্যের দিকপালদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে দাউদ হায়দার ছিলেন অগ্রসর এক কবিব্যক্তিত্ব।

দাউদ হায়দারের একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আলোচনা শেষ করব। কবিতাটির শিরোনাম “আমার পরিচয়”। কবিতাটি পড়লে একাত্তরের উদ্বাস্তু শরণার্থীদের যেমন পাই তেমনি পাই ব্যক্তি কবি দাউদ হায়দারকেও:
‘ভুলে যাও ভিটেমাটি দেশ
তুমি উদ্বাস্তু, আশ্রিত।
তোমার স্বদেশ বলে কিছু নেই
তুমি পরগাছা, তুমি মৃত
তোমার সামাজিকতা, তোমার পারিপার্শ্বিক
তোমার চেহারা তোমার চালচলন
উদ্বাস্তুর; আমাদের ঘৃণা-করুণায়
তোমার জীবন
এদেশ তোমার নয়
এই ভিটেমাটিজমিন তোমার নয়
তুমি আশ্রিত, উদ্বাস্তু;
এই তোমার মানব পরিচয়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র থাকা অবস্থায় এক তরুণের একটি মাত্র কবিতায় ধর্মীয় চেতনায় আঘাত করে এক অসাধারণ প্রতিভার জীবন চিরদিনের জন্য উদ্ভাস্ত হয়ে গেল- পত্রিকা কর্তৃপক্ষ এবং কবি পত্রিকার মাধ্যমে ধর্মানুরাগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েও ক্ষমা পেলেন না, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে!

নাসির আহমেদ: কবি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ