ঋণের ৬৬ শতাংশই খেলাপি, ধুঁকছে জনতা ব্যাংক
দেশের ব্যাংক খাতে গত দেড় দশক ধরে আলোচনা-সমালোচনার ‘শীর্ষস্থানটি’ ধরে রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক পিএলসি। ক্ষমতার বলয়ে থাকা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তোষণ, তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র জামানতে বিশাল অঙ্কের ঋণ দিয়ে সমালোচনা আরও সমৃদ্ধ করার অভিযোগ রয়েছে। এতে ব্যাংকটিতে জমেছে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৬৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিশাল অঙ্কের এই খেলাপি নিয়ে ধুঁকছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ৯১ হাজার ২২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, জনতা ব্যাংকের ঋণের বড় অংশ গেছে আওয়ামী লীগ সরকারের মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের পকেটে। এই ঋণ বিতরণে মানা হয়নি একক ঋণ গ্রহীতার সীমাও। এতে বিপদ আরও বেড়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো, চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ ও এননটেক্সের প্রতি বেশি ‘উদারতা’ দেখিয়েছে জনতা ব্যাংক। এই তিন কোম্পানিকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এই তিন কোম্পানি ছাড়াও আরও অন্তত ২০টি গ্রুপকে ৩৫ হাজার কোটি টাকাসহ মোট ৭০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। মূলত এই ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি।
জনতা ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের খেলাপি হওয়া ঋণের বড় অংশ মুষ্টিমেয় কিছু গ্রাহকের কাছে; যারা বিগত সরকারের সময় বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। ফলে ব্যাংক উদ্যোগ নিলেও ঋণের টাকা ফেরত আসেনি। তাদের কেউ এখন জেলে আছেন, কেউ রয়েছেন পলাতক। তাই ঋণগুলো অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে।’
তবে ভিন্ন কথা বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, ‘ঋণ বিতরণে জনতা ব্যাংক যতটা আগ্রহী ছিল, ঋণ আদায়ে তারা ততটাই অনাগ্রহী। কারণ ঋণ আদায়ে তাদের কার্যকর কোনো ভূমিকা চোখে পড়ছে না।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঋণ খেলাপিরা ঋণের বিপরীতে যে সম্পদ বন্ধক রেখেছেন, তা খুঁজে বিক্রি করা বা নিলামে তোলা দরকার। ঋণ বিতরণের সঙ্গে ব্যাংকের যেসব অসাধু কর্মকর্তা জড়িত তাদের অর্থ-সম্পদের খোঁজও বের করতে হবে। এতে খেলাপিদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ আছে কি না, তা বের হয়ে আসবে।’
তারা বলেন, ‘সদুপদেশ দিয়ে খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব নয়। তালিকা করে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব ঋণখেলাপি ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, তাদের দেশে ফেরত এনে অর্থ উদ্ধার করার দায়িত্ব সরকারেরই। কেননা ব্যাংক খাতের এই নাজুক অবস্থা যে দেশের পুরো অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
খেলাপি ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মজিবুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে ইতোমধ্যে আমরা একশ দিনের একটা কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এই কর্মসূচির মধ্যে দুটি পাঠ রেখেছি। একটি ‘ডিপোজিট সংগ্রহ’ অন্যটি ‘খেলাপি ঋণ আদায়’। ডিপোজিট সংগ্রহের জন্য আমরা কয়েকটি নতুন প্রডাক্ট এনেছি। সেগুলো নিয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি তার্গেট অনুযায়ী ডিপোজিট সংগ্রহ করতে পারলে সংকট নিরসন করা সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ‘বড় ঋণগুলো আদায়ের জন্য ইতোমধ্যে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় গিয়েছি। তাছাড়া যেসব গ্রাহক সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় পড়েছেন, মারা গেছেন তাদের ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করে প্রকৃত আমানত ফেরতের চেষ্টা করছি। কভিড বা অন্য কোনো কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা আছে সেগুলো রি-শিডিউল করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এভাবেই আমরা খেলাপিটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি।’
১০ হাজার কোটি টাকা ঋণের আবদার
এদিকে খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ উদ্ধার না করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৪ শতাংশ সুদে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণের আবদার করেছে জনতা ব্যাংক। তবে এই ঋণ দিতে রাজি হয়নি ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি গভর্নরের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে জনতা ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় চলমান সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছিল জনতা ব্যাংক; কিন্তু তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
সূত্রটি জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো টাকা দেয়া হবে না। গ্রাহকদের দেয়া টাকা উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। ঋণের বিপরীতে যে জামানত রাখা আছে প্রয়োজনে সেগুলো বিক্রি করে টাকা আদায় করুন। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে আমরা তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু তারা কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণ চাওয়ার বিষয়ে জনতা ব্যাংকের এমডি মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা ৪ শতাংশ সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ঋণ চেয়েছিলাম। ঋণটা পেলে আমাদের জন্য ভালো হতো; কিন্তু তারল্য সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণটি দেয়নি। তবে আমানত সংগ্রহে আমরা যে সাড়া পাচ্ছি তাতে সংকট মোকাবিলা করতে পারব। ঋণটি পেলে অবশ্য সুবিধা হতো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকোকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। বহুল আলোচিত বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা।
এরপর জনতা ব্যাংক থেকে দ্বিতীয় শীর্ষ ঋণ গ্রহীতা এস আলম। গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জনতা ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ৮৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ হাজার ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারির আরেক আলোচিত নাম এননটেক্স। এই গ্রুপও জনতা ব্যাংক থেকে ৭ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের প্রায় শতভাগই খেলাপি। এননটেক্সে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭০৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা।
এর মধ্যে আবার আলোচিত এননটেক্সকে দেয়া ঋণের টাকা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুদকও। এমনকি দুদকের পক্ষ থেকে রেকর্ড সংগ্রহের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছে। অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে দুদক বলেছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে এননটেক্স গ্রুপভুক্ত ২২টি প্রতিষ্ঠানকে প্রদত্ত ঋণের অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করা একান্ত প্রয়োজন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, জনতা ব্যাংক থেকে রিম্যাক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড এক হাজার ৭৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের পুরোটাই খেলাপি। আর ক্রিসেন্ট গ্রুপের ২ হাজার ৮৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণের মধ্যে এক হাজার ৮০৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকাই খেলাপি। রতনপুর গ্রুপে জনতার ঋণ ১ হাজার ২২৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাঙ্কা গ্রুপে ১ হাজার ৭১৯ কোটি ৯ লাখ টাকা, ওরিয়ন গ্রুপে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৪২ লাখ, থার্মেক্স গ্রুপে ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ৭৭ লাখ, সিকদার গ্রুপে ৮২৯ কোটি, জনকণ্ঠ গ্রুপে ৭৮৭ কোটি ৪৮ লাখ, মেঘনা সিমেন্টে ৬৭৪ কোটি ৭২ লাখ, লেক্সো লিমিটেডে ৬৫৫ কোটি ৪৭ লাখ, হাবিব হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে ৬৩৫ কোটি ৪৫ লাখ, আনন্দ শিপইয়ার্ডে ৬১৪ কোটি ৫৪ লাখ এবং বিআর স্পিনিং লিমিটেডে ৫৭৪ কোটি ২২ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এ ছাড়া চৌধুরী গ্রুপকে ব্যাংকটির দেয়া ৬৫৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঋণের মধ্যে ৬২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্টের (বিএডিসি) ঋণ ৪ হাজার ৩৭৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ঋণ ৩ হাজার ৬২৩ কোটি ৭৫৭ লাখ টাকা। পাশাপাশি বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ঋণ ২ হাজার ৯২১ কোটি ৩ লাখ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের ঋণ ১ হাজার ৬৯১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে