Views Bangladesh Logo

এক আদেশ বাস্তবায়নে সাত আদেশ, তবুও উপেক্ষিত

রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০২০ সালে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরপর এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে ২০২৪ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত সাতবার আদেশ দিয়েছেন আদালত। কিন্তু নির্দেশনাগুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশগুলো এভাবে বারবার অগ্রাহ্য করাকে চরম আদালত অবমাননা বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞরা।

২০২০ সালে বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেগুলো ছিল- ১. ঢাকার সড়কগুলোতে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ২. যেসব গাড়ি কালো ধোঁয়া নির্গমন করে সেগুলোকে জব্দ করতে হবে। ৩. ঢাকা শহরের মধ্যে বর্জ্য, বালি ও মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহন করতে হবে। ৪. যেসব ইটভাটা লাইসেন্সবিহীন চলছে সেগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। ৫. যেসব জায়গায় নির্মাণকাজ চলছে সেসব জায়গার কনট্রাকটররা তা ঢেকে রাখবেন। ৬. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ অনুযায়ী রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ির ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করতে হবে এবং যেসব গাড়ি পুরাতন হয়ে গেছে সেগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। ৭. সড়কের মেগা প্রজেক্টের নির্মাণকাজ এবং কার্পেটিংসহ যেসব কাজ চলছে, সেসব কাজ যেন আইন-কানুন এবং চুক্তির টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন মেনে করা হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ৮. পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া টায়ার পোড়ানো এবং ব্যাটারি রিসাইক্লিং বন্ধ করতে হবে। ৯. মার্কেট এবং দোকানের বর্জ্য প্যাকেট করে রাখতে হবে। এরপর মার্কেট ও দোকান বন্ধ হলে সিটি করপোরেশনকে ওই বর্জ্য অপসারণ করবে।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে নেয়া পদক্ষেপগুলো জানতে চান হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অবহেলার বিষয়ে রুল জারি করেন। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন।
২০২১ সালের ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট এক আদেশে ঢাকার রাস্তায় পানি ছিটানো ও শহরের মধ্যে বর্জ্য, বালি ও মাটি বহনকারী ট্রাকগুলোকে ঢেকে পরিবহন করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আদেশ দেয়া হয়।
২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট রুলসহ একটি আদেশ দেন। আদেশে ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে শহরের আশপাশের অবৈধ সব ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বন্ধ নিশ্চিত করতে ডিসিদের নির্দেশনা দিতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।


ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ এর পার্শ্ববর্তী ৫ জেলার সব অবৈধ ইটভাটা দুই সপ্তাহের মধ্যে উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।


কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না তখন ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘সন্তানরা বিদেশে থাকে, তাই ঢাকাসহ দেশের বায়ুদূষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই পরিবেশ অধিদপ্তর ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের।’


এরপরও কোনো কাজ না হওয়ায় ২০২৩ সালের ১৭ মে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে আদেশ যথাযথভাবে প্রতিপালন না করায় পরিবেশ অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা এবং গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে (ডিসি) তলব করেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ওই দিন তলব করা সবাইকে বায়ুদূষণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।


ঢাকা শহরের বাযুদূষণ রোধে ৯ দফা বাস্তবায়ন না হওয়ায় সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন করেন। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে বর্তমানে ঢাকার বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন আদালত। এছাড়াও শুনানি শেষে আদালত আগামী ৭ দিনের মধ্যে বিবাদীদের বায়ুদূষণ বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত করে আগামী ২৬ জানুয়ারি আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আদালতের এমন নির্দেশনা থাকার পরও কর্তৃপক্ষ অতিসামান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করায় এবং অধিকাংশ নির্দেশনা পালন না করায় সম্প্রতি ঢাকা শহর বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এতে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমে। তবে পরবর্তীতে নির্দেশনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় ঢাকা আবারও বায়ুদূষণের শীর্ষ শহরে পরিণত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বারবার উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করার মতো ধৃষ্টতা যারা দেখায় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আদালত অবমাননার মামলা করা দরকার।


সুপ্রিম কোর্টের আরেক সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ৯ দফা বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত হাইকোর্ট ৬ বার বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি একটি নির্দেশ দিয়েছেন ৯ দফা বাস্তবায়নে। যার সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যে সংশ্লিষ্টরা ৯ দফা বাস্তবায়ন না করলে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা হবে।’


অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক আদেশ বাস্তবায়নে সাতবার আদেশ দেয়া লেগেছে হাইকোর্টের। তারপরও সেই আদেশ বাস্তবায়ন না হলে অবশ্যই আদালত অবমাননার মামলা করা উচিত। বিগত সরকারের আমলে এটা হয়েছে। আমার আগে যিনি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন তার এ বিষয়টি তদারকি করা উচিত ছিল। তিনি তা করেননি। তবে এখনো বায়ুদূষণে হাইকোর্টের নির্দেশ মানা না হলে রাষ্ট্রপক্ষ অবশ্যই কার্যকর উদ্যোগ নেবে।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ