এক দশকে হত্যা সাতজনকে, বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ে আতঙ্কিত কুমিল্লাবাসী
গত এক দশকে কুমিল্লা নগরীতে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাংগুলোর হাতে খুনের শিকার হয়েছেন অন্তত সাতজন, আহত আরও শতাধিক। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আহতও হতে হয়েছে তাদের অনেককে।
আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন আরও বেপরোয়া এসব কিশোর গ্যাং সদস্যরা। বিশাল দল নিয়ে হাতে দা, ছেনি, লাঠিসোঁটা, এমনকি দেশীয় অগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে মিছিল করে রীতিমতো মহড়াও দিচ্ছে তারা। দুই মাসে নগরীর বিভিন্ন সড়কে এ ধরনের অন্তত ছয়টি সশস্ত্র মহড়ায় জনমনে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক।
সর্বশেষ শুক্রবার (৪ জানুয়ারি) শতাধিক কিশোরের এমন মহড়া নগরীর টমছম ব্রিজ থেকে নজরুল অ্যাভিনিউ হয়ে রানীরবাজার দিয়ে ধর্মপুরের দিকে যায়। একই সময়ে রানীরদীঘি এলাকায় ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের সামনে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং ‘রতন গ্রুপ’। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর নগরীর বাড়িচাগাঁও, রেসকোর্স এলাকায় সশস্ত্র মহড়া দেয় আরও একটি কিশোরগ্যাং। আতঙ্কে সব এলাকায়ই সড়ক ছাড়তে বাধ্য হন মানুষজন। আটকে যায় যানবাহনও।
কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রথম দেখা মেলে ২০১৫ সালে। একদশকে গজিয়ে উঠেছে ২৫টিরও বেশি গ্রুপ, যেগুলোর এক একটির সদস্য ৪০ থেকে দুই শতাধিক বখাটে টিনএজ ও শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বড় গ্যাং দুই শতাধিক সদস্যের রয়েল গ্যাং স্টার বা আরজিএস। এতে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই বেশি। সদস্য সংখ্যার দিক দিয়ে এরপরের তিনটি ‘ঈগল’ ‘মডার্ন স্কুল ওয়ান’ ও ‘মডার্ন স্কুল টু’ ছাড়াও নগরজুড়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে ‘ডব্লিউআর’, ‘আরপিএস’, ‘র্যাক্স’, ‘এক্সসিএমএইচএস’, ‘রতন গ্রুপ’ ‘এলআরএন’ ইত্যাদি গ্যাংগুলোও।
নগরীর নজরুল অ্যাভিনিউ, স্টেডিয়াম, ঈদগাহ, নগর উদ্যান, নিউমার্কেট, এসবি প্লাজা, ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড, তালপুকুরপাড়, শিক্ষাবোর্ড এলাকা, ধর্মপুর, সদর হাসপাতাল রোড, রানীরদীঘির পাড়, ধর্মসাগর, মোগলটুলী, মদিনা মসজিদ রোড, রামমালা রোড, চর্থা, কোটবাড়ী, কালেক্টরিয়েট কলেজ ও স্কুল গলি, ধর্মপুরের ভিক্টোরিয়া কলেজ রোডসহ পাড়া-মহল্লাভিত্তিক ছাড়াও গড়ে উঠেছে স্কুল-কলেজকেন্দ্রিক বখাটেদের গ্যাংও। নগরীর প্রায় প্রতিটি স্কুল-কলেজে রয়েছে দুই বা ততোধিক গ্যাং।
নিজ নিজ বলয়ে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সংঘবদ্ধ আড্ডা দিতে দেখা যায় এ গ্যাং সদস্যদের। যোগাযোগের মূল মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ।
আতঙ্কিত নগরবাসীর অভিযোগ, প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আছে কিশোর গ্যাংগুলো। তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ঘটিয়ে ফেলছে খুনের মতো ঘটনা। হিংসা-প্রতিহিংসায় মারামারি, হামলা লেগেই রয়েছে। জড়িয়ে যাচ্ছে সামাজিক নানা অপরাধেও। মাদকাসক্তি, ছিনতাই ও ইভটিজিং অনেকেরই নিত্যদিনের অপকর্ম। হর্ন বাজিয়ে এবং সাইলেন্সারের বিকট শব্দ করে খুব গতিতে মোটরসাইকেল চালায় গ্রুপগুলোর সদস্যরা। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে চলে অহরহ।
নগরবাসী বলছেন, শক্তি ও বল প্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে তৈরি হয়েছে এ গ্যাং কালচার। প্রথমে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘিরে এসব গ্যাং গড়ে উঠলেও পরে আধিপত্য বিস্তারের দলে পরিণত হয়। তাই তারা তুচ্ছ বিষয়ে খুনসহ বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটাতেও দ্বিধাবোধ করে না। পেছনে রাজনৈতিক ছাড়াও ‘ভাইয়া’ নামে সিনিয়র কারও শেল্টার থাকায় হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীও। কাউকেই পরোয়া করে না। যার তার সঙ্গেই করে বাজে ব্যবহার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন অভিভাবক আরও জানান, কিশোরগ্যাংয়ের কাছে আছে ছুরি, চাপাতি, ড্যাগার, সুইচ গিয়ার, চাকু, এন্টিকাটার, রামদা, হকিস্টিক ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র। গ্যাংয়ের এসব কিশোররা বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, মাস্তানি, চাঁদাবাজি করছে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ানোও তাদের কাজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একাধিক কর্মকর্তাও বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেছে। পরনে টি-শার্ট, জিন্স প্যান্ট আর চোখে সানগ্লাস। চুলে জেল লাগানো নিত্যনতুন স্টাইল। অলি-গলি, পাড়া-মহল্লা, রাস্তার মোড় ও ফুটপাতে তারা জমিয়ে আড্ডা দেয়। উচ্চস্বরে গান করে। কোনো বয়স বিবেচনা ছাড়াই কিশোরী-তরুণীদের উত্ত্যক্ত করে। রাস্তায় দামি মোটরসাইকেল ও কার রেসিং তাদের নিত্যব্যাপার। বিকট শব্দে মোটরসাইকেল চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ায়।
কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহজাদা ইসলাম, অজিতগুহ কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার কবির অন্তু ও মডার্ন হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোন্তাহিন ইসলাম মিরণের নৃশংস হত্যার ঘটনায় এখনো আঁতকে ওঠেন নগরবাসী।
নগরীর নূরপুরে কিশোর অটোরিকশা চালক মো. আশরাফুল আমিনকে দশম শ্রেণির ছাত্ররা খুন করায় এতো অল্প বয়সে এমন ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়ানোর বিষয়ে হতবাক করেছে অনেককে। ২০২৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে দাউদকান্দি উপজেলার শাহপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমিনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ও নাক-মুখ স্কচটেপ পেঁচিয়ে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। ক্লু-লেস এ ঘটনার পর প্রযুক্তির ব্যবহারে ২৯ সেপ্টেম্বর কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারকে সহায়তা করতে অটোরিকশা চালাতো আমিন।
গত বছরের ১৯ আগস্ট বিকেলে নগর উদ্যানের পাশের ব্যস্ততম সড়কে ১৭ বছরের কিশোর শাহাদাৎ হোসেনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তারা ‘রতন গ্রুপ’-এর সদস্য বলে জানিয়েছে র্যাব। নিহত শাহাদাৎ পুরাতন চৌধুরীপাড়ার শাহ আলম ভূঁইয়ার ছেলে হোসেন।
গত বছরের ৪ মে গোমতী নদীর পালপাড়া ব্রিজ এলাকায় টিকটক গ্রুপের মধ্যে পূর্ববিরোধের জেরে কিশোর শুভকে বুকে ও পেটে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। নিহত শুভ আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওড়া গ্রামের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে।
২০২৩ সালের ২৮ মে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র নওশাদ কবির মজুমদার নাহিদকে মারধর এবং উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হাত ও পায়ের রগ কেটে গুরুতর আহত করে ‘আরজিএস’ কিশোর গ্যাং। তুচ্ছ ঘটনার জেরে সঙ্গীদের নিয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পাশে এ ঘটনা ঘটায় গ্যাং লিডার জাহিদ খান।
২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর নগরীর দক্ষিণ চর্থায় ১৯ বছরের যুবক ফয়সাল ইসলামকে কুপিয়ে ও রগ কেটে হত্যা করা হয়। ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল কুমিল্লা ইপিজেডের চীনা কোম্পানির কর্মকর্তা খায়রুল বাশারকে রাস্তায় পেয়ে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা।
গত বছরের ১২ আগস্ট নগরীর ধর্মসাগর গেট সংলগ্ন পিজা কালজুন রেস্টুরেন্টে রাব্বির নেতৃত্বে তিন-চারজন কিশোর খাবার খেয়ে চলে যাওয়ার সময় বিল চাওয়া হলে না দিয়ে উল্টো চাঁদা দাবি করে তারা। অপারগতা জানালে গালমন্দের পর দোকানের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। কাউন্টারে ঢুকে রেস্টুরেন্ট মালিক মো. শাহিদুজ্জামানকে আহত করে ক্যাশ থেকে টাকা নিয়ে যায়। এ সময় কাস্টমাররা এগিয়ে এলে রাব্বি ছুরি দেখিয়ে তাদের গালাগাল করে। পরে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে একজনকে আটক করে, বাকিরা পালিয়ে যায়।
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি দুই কিশোরগ্যাং ‘ঈগল গ্রুপ’ ও ‘রতন গ্রুপ’-এর ১৬ জন সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা ও কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশ । তাদের কাছ থেকে জব্দ হয় ১০টি ধারালো অস্ত্র ও ৯টি ককটেল।
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, ‘অপরাধী হয়ে কেউ জন্মায় না, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা অপরাধী করে তোলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব গ্যাংয়ের বেড়ে ওঠার পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগও রয়েছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধমুক্ত রাখতে পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে।’
অধিকার ফাউন্ডেশন, কুমিল্লার প্রধান নির্বাহী ও সনাকের সাবেক সভাপতি আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় হতে হবে। তারা চাইলে এসব কিশোর গ্যাং নির্মূল কোনো বিষয়ই না’।
কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মো. মহিনুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময় কিছু নেতার প্রশ্রয়ে কিশোরগ্যাং তৈরি হয়। এখন তারা নতুন আশ্রয় খুঁজছে বা আশ্রয়ে আছে। যারা অস্ত্রের মহড়া চালিয়েছে, তাদের ধরতে অভিযান চলছে। বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে