‘একাত্তর’ জেনোসাইডের জ্বলন্ত সাক্ষী হলেও স্বীকৃতি নেই
খুলনার দিঘলিয়া থানার সেনহাটি গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালাম। ১৯৭১ সালে যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, যুদ্ধ করেছেন ৯ নম্বর সেক্টরে। যে অপরাধে রাজাকারদের সহযোগিতায় ৩০ এপ্রিল আবদুস সালামের বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল পাকিস্তানি সেনারা। প্রাণ বাঁচাতে চার মাসের শিশু রেহেনাকে কোলে নিয়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন আবদুস সালামের স্ত্রী; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে ফেলেন। এরপর কোল থেকে চার মাসের শিশুটিকে নিয়ে প্রবল আক্রোশে উঠানে আছড়ে ফেলে হিংস্র সৈনিকরা। শক্ত বুটের তলায় পিষে ফেলে শিশুটির কচি শরীর। বাবা যুদ্ধে গেছেন, এই অপরাধে নিষ্পাপ একটি শিশুকে এমনই বর্বরভাবে হত্যা করেছিল হায়েনারা, যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সাক্ষী। হত্যাকাণ্ডের সময় চার মাসের রেহেনার গায়ে যে জামাটি ছিল সেটি এখন সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিতে। সেনালী বর্ডারে হাতাকাটা এই জামাটির সামনে দাঁড়ালে শিউরে উঠতে হয়।
বিংশ শতাব্দীর বর্বর এক ‘জেনোসাইড’ এর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই বাংলার এক লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে কী নারকীয় তাণ্ডব, কী নৃশংস ‘জেনোসাইড’ চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ২৫ মার্চ কালরাতের পরে অনেকেই বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছিলেন। সে সময় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ওয়াশিংটনে ২৭ মার্চ ১৯৭১ একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন, যার শিরোনাম ছিল ‘Selective Genocide’. তাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার বুকে ২৫ মার্চ কাল থেকে ‘Selective Genocide’ চালাচ্ছে। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রেক্ষাপটে ‘জেনোসাইড’ শব্দটি আরও জোরালোভাবে ব্যবহার করেন সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি করাচিভিত্তিক ‘মনিং নিউজ’ এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই চাকরির সুবাদে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ তাকে পূর্ব পাকিস্তানে সরেজমিন পরিদর্শনে আনে। কর্তৃপক্ষের জন্য ফরমায়েশি প্রতিবেদন প্রকাশ করা মূল উদ্দেশ্য হলেও এর মাঝ থেকেই ‘Genocide’ শিরোনামে অসাধারণ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন মাসকারেনহাস, যা ‘সানডে টাইমস’ এ প্রকাশিত হয় ১৩ জুন, ১৯৭১। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন তথ্যচিত্র ‘Stop Genocide’. মাত্র ২০ মিনিটের এই তথ্যচিত্রে উঠে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার নির্মম চিত্র।
আসুন এই লেখায় একটু জেনে নিই বর্তমান বিশ্বে ‘জেনোসাইড’ বলতে আসলে কী বুঝায়? এর পরিধি আর ব্যাপকতা কতটুকু? আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেসব অপরাধ সংঘটিত করেছিল সেগুলো ‘জেনোসাইড’ এর অংশ কি না?
বর্তমান বিশ্ব সভ্যতায় ‘জেনোসাইড’ নিঃসন্দেহে ভয়ংকর এক অপরাধ। এই অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা এবং ‘জেনোসাইড’ প্রতিরোধ করতে বিশ্ব সম্প্রদায় নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়ে আসছে। মিয়ানমারের রাখাইন পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে ‘জেনোসাইড’ শব্দটি নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ, বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাখাইনে সংঘটিত অপরাধকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াং হি লি রাখাইনে সংঘটিত অপরাধকে জেনোসাইড হিসেবে অভিহিত করেছেন।
জেনোসাইড শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একজন ইহুদি-পোলিশ আইনজীবীর নাম। তিনি হলেন রাফায়েল লেমকিন। যিনি ‘Genocide’ শব্দটির উদ্ভাবক। লেমকিনের জীবন ছিল জেনোসাইড তথা যুদ্ধ, সহিংসতায় ক্ষত-বিক্ষত। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে রাফায়েল লেমকিনের পরিবার রাশিয়া ও জার্মান সেনাদের যুদ্ধের মধ্যে পড়ে সর্বস্ব হারায়। তাদের বাড়ি, খামার, সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও তিনি ফ্রান্সের ল্যুভ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পান। এরপর পোল্যান্ডে গিয়ে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। পেশাগত কাজের অংশ হিসেবে তিনি বর্বর হত্যাকাণ্ডের নানা দিক নিয়ে আলোচনা ও পড়াশোনা চালিয়ে যান। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসে। এদিকে এ বছরই লেমকিন মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত লীগ অব নেশনসের পঞ্চম সভাতে বর্বর হত্যাকাণ্ডবিষয়ক একটি গবেষণা পত্র পাঠান। যাতে তিনি যুদ্ধকালীন বর্বর অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে বিচারের এখতিয়ার (Jurisdiction for acts of persecution) নিয়ে সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। যদিও ১৯৩৩ সালে তা গৃহিত হয়নি। যদি ওই সময় সেই প্রস্তাব গৃহীত হতো তাহলে হয়তো নাৎসি জার্মান কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আগে থেকেই জানতে পারতো বিশ্ববাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাফায়েল লেমকিনের পরিবারে আবারও বিপর্যয় নেমে আসে। এই যুদ্ধে ইহুদি নিধনযজ্ঞে তিনি পরিবারের ৪৯ জন সদস্যকে হারান। যার মধ্যে ছিলেন তার বাবা-মা। তবে ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে তিনি নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে লেমকিন ১৪ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে রাশিয়া-জাপান হয়ে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।
পোলিশ আইনজীবী লেমকিন দীর্ঘদিন ধরে হত্যা, হত্যাকাণ্ড, নানা ধরনের অপরাধ নিয়ে কাজ করছিলেন। পোল্যান্ডে আইনচর্চা করার সময়ই তিনি কয়েকটি শব্দ নিয়ে বেশ নিরীক্ষা করেছিলেন। যুদ্ধ বা সংঘাতে সার্বিক প্রাণহানি বা হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতা বুঝাতে তিনি ‘Barbarity’ ও ‘Vandalism’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে রাফায়াল লেমকিন ১৯৪৪ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। বইটির নাম ছিল ‘Axis Rule in Occupied Europe (1944)’. এই বইটিতে লেমকিন ‘Genocide’ শব্দটির উৎপত্তির প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন। ‘Genocide’ শব্দটি মূলত দুটি শব্দের সমন্বয়। ইংরেজি ‘Genocide’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ও ল্যাটিন থেকে। গ্রিক শব্দ ‘Genos’ শব্দের অর্থ ‘Race or Tribe’ আর ল্যাটিন ‘Cide’ শব্দের অর্থ ‘Killing’. যার বিস্তারিত ব্যাখ্যাও তিনি তুলে ধরেছেন। পরে বিভিন্ন একাডেমিক বইয়ে লেমকিনের এই ব্যাখ্যাটি স্থান পায়। তার সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, জেনোসাইড বলতে কোনো একটি জাতীয় বা জাতিগোষ্ঠীর সার্বিক বিনাশ বা নিকেশকে বুঝানো হয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, জেনোসাইড বলতে একটি জাতি গোষ্ঠীকে হঠাৎ করে ধ্বংস করা ও গোষ্ঠীর সকল সদস্যকে হত্যা করাকেই শুধু বুঝায় না; বরং কিছু নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে বুঝায়। যা একটি জাতিগোষ্ঠীর মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যায়। যাতে করে জাতিগোষ্ঠীটি আপনা-আপনিই ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। যার যথাযথ উদাহরণ হতে পারে ১৯৭১ সালের বাঙালি নিধনযজ্ঞ।
এ ধরনের পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হলো, জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে সংস্কৃতি, ভাষা, জাতীয়তাবোধ, ধর্ম এবং অর্থনীতিসহ নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, স্বাধীনতা, স্বাস্থ্য ও আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এমনকি জীবন পর্যন্ত নাশ ঘটানো এ ধরনের পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য।
জেনোসাইড মূলত কোনো একটি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলো জাতির প্রতিটি একক ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির নিজস্ব অবস্থান বিবেচনা করা হয় না বরং ওই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে প্রতিটি ব্যক্তিকেই এসবের মুখোমুখি হতে হয়।
এবার পিছন ফিরে তাকানো যায় ১৯৭১ এর দিকে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও এর আগে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাঙালি জাতিকে পদানত করতে চেয়েছে পাকিস্তান। যার ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু করে বর্বর হত্যাযজ্ঞ। এ ছাড়া যুদ্ধে বাঙালি নারীদের ধর্ষণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে নতুন জাতি তৈরি করা। এ ছাড়া বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসনতো ছিলই। সবকিছু বিবেচনা করে দেখা যায় ১৯৭১ সাল ছিল জেনোসাইডের টেক্সটবুক উদাহরণ। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থা একাত্তরের হত্যাযজ্ঞকে এখনও জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাদের দৃষ্টিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড, সোভিয়েত রাশিয়ার নাগরিকদের বাধ্যতামূলক শ্রম শিবির গুলাগে পাঠানো জেনোসাইড, রুয়ান্ডাতে তুতসি জাতিগোষ্ঠীর হত্যাকাণ্ড জেনোসাইড, রোহিঙ্গাদের হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা জেনোসাইড, এমনকি ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ানদের বাস্তুচ্যূত ও হত্যা জেনোসাইড, শুধু জেনোসাইডের স্বীকৃতি নেই বাংলার বুকে সংঘটিত হওয়া বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের। যা সীমাহীন পরিতাপের এক মহাকাব্য।
পেছন ফিরে তাকানো যাক ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের জেনোসাইড সম্মেলনের দিকে। এই সম্মেলনে মোট ১৯টি অনুচ্ছেদ নিয়ে জেনোসাইডের সংজ্ঞায়ন করা হয়েছিল। আর সম্মেলনে যে কথাটি বারবার জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছিল তা ছিল ‘Never again’ বা ‘আর কখনই নয়’। জেনোসাইডের মতো ঘৃণ্য অপরাধের প্রেক্ষাপটে আমরা অবশ্যই বলতে চাই ‘Never again’ বা ‘আর কখনই নয়’, কিন্তু তার আগে ১৯৭১ সালের বর্বর জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই জরুরি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে