Views Bangladesh Logo

স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মত্যাগী আট শহীদ সাধুকে স্মরণের দিন সোমবার

স্বাধীনতার বেদিমূলে একাত্তরের ৯মাসে যে চরম আত্মত্যাগ করে বীর বাঙালি, তারই জ্বলন্ত নিদর্শন ফরিদপুরের আটজন ব্রহ্মচারী সাধুর আত্মাহুতির ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে একাত্তরের ২১ এপ্রিল শহরের গোয়ালচামট শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গনে ঘটেছিল জঘন্যতম সেই নারকীয় গণহত্যা। মানবমুক্তির অগ্রপথিক শ্রী শ্রী প্রভু জগদ্বন্ধু ব্রহ্মচারীর আশ্রমটিতে হামলা চালিয়ে সেদিন কীর্তনরত আট সাধুকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা।

প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরের আরাধনা করে গৃহত্যাগী এই সন্যাসীরা দিন-রাত জপেন ‘বলো জয় জগদ্বন্ধু বোল’। আর হানাদার পাকিস্তানি ঘাতকরা এটাকেই রূপান্তর করে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে। এ দেশীয় রাজাকার আর বিহারিরাও সেদিন হায়েনাদের এটাই বুঝিয়ে ছিল। এ কারণেই ব্রাশফায়ারে মানবমুক্তির মহাকল্যাণকামী ওই আট সাধুকে হত্যা করে দানবেরা।

সেদিনের সেই শহীদেরা হচ্ছেন- কীর্তনব্রত ব্রহ্মচারী, নিদানবন্ধু ব্রহ্মচারী, অন্ধকানাই ব্রহ্মচারী, বন্ধুদাস ব্রহ্মচারী, ক্ষিতিবন্ধু ব্রহ্মচারী, গৌঢ়বন্ধু ব্রহ্মচারী, চিরবন্ধু ব্রহ্মচারী ও রবিবন্ধু ব্রহ্মচারী। মুক্তিযুদ্ধের পর শ্রীঅঙ্গন মন্দিরের চালতেতলার নিচে তাদের স্মরণে আটটি স্মৃতিস্মম্ভ নির্মিত হয়েছে। সরকারি উদ্যোগেও কিছুদিন আগে আঙ্গিনা চত্বরে গড়া হয়েছে স্মৃতিসৌধ।

জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথম গণহত্যার মর্মন্তুদ সেই ঘটনার ৫৪তম বার্ষিকী সোমবার (২১ এপ্রিল)। আশ্রম পরিচালনাকারী মহানাম সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক শ্রীমৎ মৃগাঙ্ক শেখর ব্রহ্মচারী জানান, দিবসটিতে শ্রীধাম শ্রী অঙ্গনে প্রার্থনা ও ভোগরাগ ছাড়াও মা মাটি মাতৃভূমি আর স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গকারী ফরিদপুরের প্রথম শহীদ সাধুদের স্মৃতিস্মম্ভ ও স্মৃতিসৌধে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির পক্ষে পুস্পমাল্য অর্পণ করা হবে।

সেদিন আশ্রমে থেকেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান সেবায়েত হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী। ঘাতকদের চোখ এড়িয়ে ব্রাউনিয়া ফুল গাছ আর জঙ্গলের আড়ালে পালিয়ে ছিলেন এই সাধু। ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর পরলোকগমন করেন তিনি।  মৃত্যুর আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, ‘আমার চোখের সামনেই গুলি করে মারল আটজন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীকে। জঙ্গলে লুকিয়ে বেঁচে গেলাম। আমরা তো কারও ক্ষতি বা অকল্যাণ করি না। আমাদের হত্যা করল কেন ওরা?’

মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রীঅঙ্গণের সাধুরা জানান, আশ্রমটিতে অহোরাত্র নামকীর্তন চলে। প্রভুর নাম জপতে জপতেই মানবমুক্তি ও জগতের কল্যাণ হবে, এ গভীর বিশ্বাসে দিন-রাত অষ্টপ্রহরই কীর্তন করেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা। ব্রহ্মচারী উপাধিপ্রাপ্ত এসব সাধু আর তাদের তীর্থকেন্দ্র শ্রীধাম শ্রীঅঙ্গণও রক্ষা পায়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হিংস্র দানবীয় থাবা থেকে।

তারা জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একমাস পর গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ফরিদপুরে ঢোকে পাকিস্তানি সেনারা। আগেই এ খবর পেয়ে প্রভু জগদ্বন্ধুর ভাবশিষ্য মহানাম সম্প্রদায় প্রধান মহানাব্রত ব্রহ্মচারী ও অন্য সাধু-সন্ন্যাসীরা হামলার পূর্বনির্ধারিত দিন ২১ এপ্রিলের আগেই শ্রীঅঙ্গণ থেকে সরে গেলেও থেকে গিয়েছিলেন ৯ সাধু।

ওইদিন ভোরে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ফরিদপুরের প্রবেশদ্বার রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয় পাকিস্তানি সেনারা। সেখান থেকেই শহরের দিকে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে থাকে একের পর এক। দুপুরের দিকে তাদের স্বাগত জানিয়ে শহরে এনে সেনা ক্যাম্প আর রাজাকার ক্যাম্প গড়ে দেন স্থানীয় রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য ও বিহারিরা। এসব রাষ্ট্রদ্রোহিকে নিয়ে সন্ধ্যার পরে শহরে ঢুকে প্রথমেই গোয়ালচামট শ্রীঅঙ্গনে হামলে পড়ে ভিনদেশি বর্বররা।

আশ্রমের প্রধান মহানাম সম্প্রদায়ের সভাপতি শ্রীমৎ কান্তি বন্ধু ব্রহ্মচারী জানান, সেদিন পাকিস্তানি সেনারা কীর্তনরত সাধুদের হুকুম দিয়ে বলে, ‘বাহার মে আও’। কিন্তু সাধুরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কীর্তন চালিয়ে যান। মানুষরুপী হায়েনার দল এরপর মন্দিরে ঢুকে কীর্তনরত নয়জন সাধুকে বের করে মন্দিরের পাশে চালতেতলায় নিয়ে আসে। সাধুরা তখনও একমনে ‘জয় জগদ্বন্ধু’ জপছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা মনে করেছিল, তারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলছেন। এ সময় পেছন দিক থেকে সাধু হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী প্রথমে সিঁড়িকোঠায় ও পরে আশ্রমের জঙ্গলের মধ্যে ব্রাউনিয়া ফুলগাছের পেছনে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এরপর মাঠে নিয়ে বাকি আটজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

তিনি আরও জানান, পরদিন ২২ এপ্রিল ভোরে ফরিদপুর মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক এসে মরদেহগুলো নিয়ে যায়। এদিন পাকিস্তানি সেনারা দাঁড়িয়ে থেকে বিহারি ও রাজাকারদের দিয়ে লুট চালায়।  ২৬ এপ্রিল ডিনামাইট দিয়ে শ্রীঅঙ্গণের মূল ভবনের একাংশ ও মন্দিরের চূড়া ধ্বংস করে দেয়।

অলৌকিকভাবে গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, ‘সেদিন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে নিত্যদিনের মতো নামকীর্তন করছিলাম আমরা নয়জন সাধু। হঠাৎ হামলা, কামান আর গোলাগুলির শব্দ। আমরা তারপরও কীর্তন বন্ধ করিনি, এ যে এক মুহূর্তের জন্যও থামানোর নয়। তারপর মেলেটারিরা ঢুকলো আমাদের কীর্তনের আশ্রম ঘরে। তাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি, কয়েকজন বিহারি। আমি ঘরের থামের (সিঁড়িকোঠা) আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। সেখান থেকে পেছনমুখো হয়ে পা টিপে টিপে কয়েক গজ পিছিয়ে লুকিয়ে পড়লাম ফুল (ব্রাউনিয়া) জঙ্গলের আড়ালে’।

‘চোখের সামনে দেখলাম, লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে মেলেটারিরা খুন করলো আটজন প্রভুর ভক্তকে। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম রে বাবা। প্রাণের ভয়ে তারপরও চেঁচামেচি করিনি, যদি শব্দ শুনে মেরে ফেলে। তারপর ওরা মৃতদেহগুলো টেনে নিয়ে ফেললো চালতা তলায় (এখন যেখানে সাধুদের সমাধি)। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ। রক্তের আঁচড় ছড়িয়ে রইল। এরপর ওরা আশ্রমে লুট করে চলে গেলো’।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ