মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার
ট্রাইব্যুনালে ৮৫ অভিযোগ জমা, তদন্ত চলছে ৪৬টির
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। যেখানে এখন চলছে জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে হত্যাসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের বিচার। গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের সময় হত্যা, গণহত্যা (ম্যাস কিলিং), গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৮৫টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগের অধিকাংশ মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের। এ ছাড়াও রয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা, আমলা, বিচারপতিসহ অনেকেই। এর মধ্যে ৪৬টি অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
গত জুলাই আগস্টে হত্যা-গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন গুম ও ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে পরিচালিত গণহত্যার ঘটনার এসব অভিযোগের শুনানি পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এরই মধ্যে ৪৬টি অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ গত ১৯ নভেম্বর গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আগামী ১৭ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
একই ধরনের অভিযোগে ওবায়দুল কাদেরসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ৪৫ জনের ক্ষেত্রে পৃথক তদন্ত প্রতিবেদন একই দিনে জমা দিতে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকে নির্দেশ দেয়া হয়। সেই মোতাবেক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হক ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ট্রাইব্যুনালের দেয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৪৬টি অভিযোগের তদন্ত শেষ করার চেষ্টা করছি। পুরো তদন্ত সংস্থা একযোগে কাজ শুরু করেছে। একটি সঠিক, নির্ভুল ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সারা দেশে গুম ও হত্যাসহ জুলাই গণআন্দোলনে গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরই মধ্যে ৮৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে বিগত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি ও কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দলীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিচারের আওতায় আনার আবেদন জানানো হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল এর মধ্যে ৪৬টি অভিযোগের তদন্ত শেষ করতে তদন্ত সংস্থাকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার-সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনও সেদিন জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। যদিও প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা জানুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছিলাম।’
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে এরই মধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নিতে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ অন্তত ৬৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। এর মধ্যে অন্যান্য মামলায় কারাবন্দি থাকা সাবেক ১০ মন্ত্রী, দুই উপদেষ্টা, অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি ও সাবেক এক সচিবসহ মোট ১৪ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ১৭ পুলিশ কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার দেখিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এরা প্রত্যেকেই বর্তমানে কারাগারে আছেন।
এর আগে গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীকে উক্ত ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো।’ এরপর গত ১৯ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিনেটর অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হক এবং কো-অর্ডিনেটর অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মুহম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরী।
তদন্ত সংস্থার অন্যরা হলেন এন্টি-টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. মনিরুল ইসলাম, স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জানে আলম খান, ঢাকা ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের সহকারী পুলিশ সুপার সৈয়দ আব্দুর রউফ, সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ইউনুছ, রাজশাহীর চারঘাট মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মাসুদ পারভেজ, রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সের (আরআরএফ) পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মুহাম্মদ আলমগীর সরকার, সিআইডি ঢাকা মেট্রো (উত্তর) শাখার পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মশিউর রহমান।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে