চট্টগ্রামের বেসরকারি কারা পরিদর্শকের নয়টিতেই বিএনপির নেতাকর্মীরা
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বেসরকারি কারা পরিদর্শক পদে নিয়োগ পাওয়া ১২ জন কারা পরিদর্শকের মধ্যে ৯ জনই বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী।
বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) ১২ জন কারাপরিদর্শকের এ নিয়োগ দেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দীন।
নিয়োগ পাওয়া, ১২ জন হলেন যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য আমিনুল ইসলাম, দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মোজাম্মেল হক, যুবদলের বিলুপ্ত নগর কমিটির সহবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন, সহসভাপতি আবদুর রাজ্জাক, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য আতাউল্লাহ সম্রাট, নগর বিএনপির সদস্য জাফর আহম্মদ, নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক কামরুন নাহার, সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সুলতানা বেগম, বিএনপি সমর্থিত হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্ট দক্ষিণ জেলার সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল বরণ বিশ্বাস।এছাড়া রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম জেলার সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকারী জোবাইরুল আলম, শামসুল হক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন ও কোতোয়ালি বদরপাতি এলাকার সৈয়দ আবুল বশর।
জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আগের পরিদর্শকরা গা-ঢাকা দেন। এরপরই এসব শূন্য পদে নিয়োগের তোড়জোড় শুরু হয়। 'অলাভজনক’ এই পদে বসতে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং অনান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী, ব্যবসায়ী, সমন্বয়ক ও মানবাধিকারকর্মী পরিচয়ে শতাধিক ব্যক্তি আবেদন করেছিলেন।
কারাগার সূত্র বলছে, কারাগারে বন্দীদের দেখভালের জন্য দুই বছর পর পর ১২ জনকে এ দায়িত্ব দেন বিভাগীয় কমিশনার। তার কাছে নাম প্রস্তাব সুপারিশ করেন জেলা প্রশাসক। সমাজের ভদ্র, গণ্যমান্য, শিক্ষিত ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরাই কারা পরিদর্শক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কারাভ্যন্তরে বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে কারাগারের পরিবেশ, খাবারের মান পরীক্ষা, মাদক সমস্যা, অসুস্থতায় বন্দীদের সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কি না, শাস্তির অপপ্রয়োগ হচ্ছে কি না, কোনো বন্দী মিথ্যা মামলায় আটক আছে কি না, বিনামূল্যে সরকারি খরচে অসহায় বন্দীদের মামলা চালানোর পদ্ধতি সম্পর্কে জানানো, কারাগারের ব্যবস্থাপনার খোঁজ নেয়াসহ বন্দীদের কল্যাণে কাজের দায়িত্ব থাকে বেসরকারি কারা পরিদর্শকদের।
এদিকে কারা পরিদর্শক হিসেবে নতুন নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তবে এদের মধ্যে অনেকেই জানেন না কারা পরিদর্শকের কাজ বা দায়িত্ব কী। তাই প্রশ্ন উঠেছে, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ নিয়োগপ্রাপ্তরা বন্দীদের অধিকার রক্ষায় কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন।
পরিদর্শক পদে নিয়োগ পাওয়া নগর যুবদলের বিলুপ্ত হওয়া নগর কমিটির সহ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আসলে এ বিষয়ে আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা নেই। নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরে আমার উদ্দেশ্য আছে— স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সততার মাধ্যমে আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্বন্ধে আমি আগে ভালো করে জেনে নেই।’
যদিও খাদ্য সরবরাহের ঠিকাদারির বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে ২০ বছর আগে আমি দরপত্রে নিয়ম অনুযায়ী অংশ নিয়ে কারাগারের ভেতরে খাদ্য সরবরাহের ঠিকাদারির দায়িত্বে ছিলাম।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের বেসরকারি কারা পরিদর্শক পদে নিয়োগ পাওয়া নগর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক কামরুন নাহার লিজা বলেন, ‘আমার সঙ্গে আরও ১১ জন নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা সবাই বসবো, এরপর কি করতে হবে না করতে হবে আলোচনা করবো। আমি আগে এই পদে তো কখনো ছিলাম না ভাই, তাই অভিজ্ঞতা নেই। তবে সামাজিক কাজকর্ম করেছি। নিশ্চয়ই ভালো কিছু করবো।’
তবে চট্টগ্রাম জেলা সমন্বয়ক জোবাইরুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘আমি এটিকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিব। সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে কারাগারে যারা আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই নিরীহ আছেন। তাদের জন্য কাজ করবো। এছাড়া কারাগারের শৃঙ্খলা ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করবো। এছাড়া গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে বিগত সময়ে যে যে অভিযোগ ছিল তা জেনে সেসকল অভিযোগ নিরসনে কাজ করবো।’
অতীতে কারা পরিদর্শক হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধের বদলে দুনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'কারা পরিদর্শক পদে দলীয় নিয়োগ আমরা আগেও দেখেছি। এক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি, শুধু চেহারা ছাড়া। নিয়মতান্ত্রিক যে পরিবর্তন দরকার তা হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান আমরা।’
সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তদের দল আর নিজেদের সুনামের জন্য ভালো কিছু করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘কারাগার কিন্তু শুধু বন্দীখানা নয়, এটি বন্দীদের সংশোধনাগার। আমরা আগেও দেখেছি দলীয় পরিচয়ে কারা পরিদর্শক পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা কারা কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধের বদলে নিজেরাই দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়েছে। আমরা আশাবাদী এবার যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা নিজের এবং দলের সুনামের জন্য ভালো কিছু করবেন।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশনের মহাসচিব এডভোকেট এ এম জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘কারা পরিদর্শক এখন পলিটিক্যাল পদ হয়ে গেছে। কারাগার, মানবাধিকার এবং কারাবন্দীদের নিয়ে যারা কাজ করে যাদের পরিকল্পনা আছে তাদের কাউকে রাখা হয়নি। আমি মনে করেছিলাম বৈষম্যবিরোধী সরকার একজন মানবাধিকারকর্মী অথবা একজন সাংবাদিককে ওখানে রাখবেন। যেন আমরা তথ্য এবং সমস্যা জানতে পারি। সমাধানের পথ খুঁজতে পারি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয়। নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব দেয়া উচিত।’
এদিকে পরিদর্শক নিয়োগের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘বেসরকারি কারা পরিদর্শক পদে কারা থাকবেন— এটি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক করে দেন। আমি শুধু অনুমোদন দিয়েছি। কারা কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তা উনিই ভালো বলতে পারবেন।’ তবে এই বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে চট্টগ্রামের বেসরকারি কারাপরিদর্শক পদেও ছিলেন ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও তাদের সমমনা লোকজন। তারা বন্দী-বাণিজ্য, কারাগারে দলীয় নেতাকর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেয়া এবং কারাভ্যন্তরে মাদক সরবরাহসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে