আসছে ছাত্রদের ‘মধ্যপন্থি’ রাজনৈতিক দল, অসম নির্বাচনের শঙ্কা অন্যদের
ভোগান্তিহীন নাগরিক সেবা নিশ্চয়তার ব্রত নিয়ে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহেই নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে পারে জুলাই গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে দলের নাম ও প্রতীক এখনো চূড়ান্ত হয়নি। উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়া সমন্বয়কদের (মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ) একজন বা তিনজনই নেতৃত্বে আসবেন কি না, সেটিও আছে আলোচনায়। তবে অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের একজন তরুণ উপদেষ্টা পদত্যাগ করে নতুন এ দলের দায়িত্ব নিতে পারেন।
ছাত্র-তরুণদের নেতৃত্বে নতুন দল গঠনকে স্বাগত জানালেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এর প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। শুরুতে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী দলটি ‘ইসলামপন্থি’ হবে বলে জানালেও এখন বলছেন, জনগণের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তার নিরিখে ‘মধ্যপন্থি’ দল গড়তে যাচ্ছেন তারা। ফেব্রুয়ারির শেষদিকেই দলের আত্মপ্রকাশও নিশ্চিত করেছেন তিনি।
নাসীরউদ্দীন জানান, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরও জাতীয় নাগরিক কমিটি ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবে। চলবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রমও।
কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনও বলেন, ‘গত কয়েক মাসে দেশজুড়ে কমিটি গঠন ও জনসংযোগ থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, জনচাহিদার বাস্তবতার আলোকেই ডান বা বাম নয়, বরং মধ্যপন্থি দল হিসেবে রাজনীতি করব। ফেব্রুয়ারির শেষদিকে নতুন দলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবো। আমাদের রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের কল্যাণে কাজ করবে এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
চলমান ‘জনমত গঠন’ কর্মসূচিতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে এক লাখেরও বেশি মানুষের সমর্থন সংগ্রহের পাশাপাশি সবাইকে দলের নাম ও প্রতীক প্রস্তাবের আহ্বান জানাচ্ছেন সংগঠকরা। রাজধানীর বাংলামটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বুধবারের (৫ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলনে নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, দলে যোগ দিতে হলে উপদেষ্টাদেরও অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে।
তিন উপদেষ্টার একজন শুরুতেই নেতৃত্বে!
জাতীয় নাগরিক কমিটির একাধিক সূত্র বলছে, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি তিনজন উপদেষ্টার একজন পদত্যাগ করে শুরু থেকেই দলের নেতৃত্ব নেবেন। এক্ষেত্রে নাহিদ ইসলামের নামই বেশি আলোচনায়। অন্য দুজনের একজন আগামী জুন মাসে এবং একজন আরও পরে সুবিধাজনক সময়ে উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দলে যোগ দিতে পারেন।
নতুন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আসতে পারেন একজন উপদেষ্টার ভাইও। যারা গণআন্দোলনের পক্ষে ছিলেন; কিন্তু কোনো দলের রাজনীতিতে যুক্ত নন, এমন ব্যক্তিদের নতুন দলে নিয়ে আসতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
তবে তিন ছাত্র উপদেষ্টা থেকে কেউ হাল ধরবেন নাকি সম্পূর্ণ নতুন কেউ নেতৃত্ব আসবে এই ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, এই রাজনৈতিক দলে আমরা বহু নেতৃত্বের কথা ভাবছি। একক কোনো ব্যক্তিকে দীর্ঘসময় দলের শীর্ষ পদে থাকতে দেয়া হবে না। আবার পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি থেকেও আমরা বের হয়ে আসতে চাই। সেভাবেই নতুন দলের কাজ চলছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নাসীরউদ্দীন পাটওয়ারী এবং আখতার হোসেনের যে কোনো একজনই গুরুত্বপূর্ণ পদে আসছেন।
গত বছরের ৮ নভেম্বর কেন্দ্রের বাইরে প্রথম প্রতিনিধি কমিটি করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। এরপর থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩০০টি জেলা, থানা ও উপজেলায় কমিটি গড়তে পেরেছে। সব মিলিয়ে প্রতিনিধির সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলেও জানান তারা। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রথম কমিটি করে গত বছরের ২ নভেম্বর। এরপর থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৩০টি জেলা, পাঁচটি মহানগর, আটটি থানা, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়, তিনটি কলেজ ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটিতে তাদের সদস্য হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৮ হাজার শিক্ষার্থী।
সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রাজনৈতিক দলগুলোতে
নতুন রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানালেও কোনো মন্তব্য করেনি জামায়াত। তবে ছাত্র-তরুণদের দল গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন আগামী নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নতুন যেকোনো রাজনৈতিক দল গঠনকে অবশ্যই স্বাগত জানাই। কিন্তু ক্ষমতার ছত্রছায়া কিংবা প্রভাব বলয়ে থেকে এ চেষ্টা হলে জনগণ তা ভালো ভাবে নেবে না। কেউ সেটা করতে চাইলে ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের মধ্য থেকেই করা উচিত’। ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন এবং ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না জাতীয় পার্টিও।
পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অভিজ্ঞতা থেকেই দেশের জনগণ আর ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ মানতে রাজি নয়। নির্বাচনকালে তাই নিরপেক্ষ ব্যবস্থা, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার দরকার’। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ১ ফেব্রুয়ারির দলীয় কর্মসূচিতে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এটি পরিস্কার যে, ছাত্র সমন্বয়কদের মনোনয়নে এ সরকার গঠিত হয়েছে। ছাত্রদের দল গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থন আছে, একথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকেই’।
এই বক্তব্যের রেশ টেনে চুন্নু বলেন, ‘যারা নির্বাচনে অংশ নেবেন বা দল গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখবেন, শুধুমাত্র সেসব ব্যক্তিরা সরকার ত্যাগ করলেই সে দল সরকারি আনুকূল্য পাবে না, এটি কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য? ফলে, অন্তর্বর্তী সরকার আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে, নির্বাচনের সময় লেভেল প্লেয়িং ফ্লিড থাকবে, বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, সেসব নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে’।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘দল করার অধিকার সবারই আছে। তারাও করতে পারেন, করুন। কিন্তু তাদের সাম্প্রতিক আচরণে মনে হচ্ছে, তারা ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। আন্দোলনের নেতৃত্বে তো আসলে তারাই ছিলেন। তাই তারা তো জনগণের ভালোবাসা দিয়েই দল করতে পারেন। জনগণ যদি পছন্দ করে, তো হবে। কোনো রাজনৈতিক দল তো আর জনগণের ভালোবাসা ছাড়া হবে না। গায়ের জোরে, দাপট ও অহঙ্কার দেখিয়ে তো আর দল করতে পারবেন না কেউ। বরং, ক্ষমতার প্রভাব খাটাতে গিয়ে তারা নিজেরাই বিতর্কিত হবেন, জনগণ থেকে দূরে সরে যাবেন’।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের ইতিহাস দেশে নতুন নয়। আগে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেছেন, আবার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এসে জাতীয় পার্টি গঠন করেছেন। সফলতা কতোটুকু, সেটি ভিন্ন বিষয়, তবে দল গঠন তো হয়েছে এবং পরে সমালোচনাও হয়েছে। তাদেরকেও এই সমালোচনা সহ্য করতেই হবে। তবে আসল পরীক্ষা হবে নির্বাচনে। যদি ক্ষমতা খাটিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে যান, তাহলে তারাই জনগণের সমর্থন চূড়ান্তভাবে হারাবেন।
তিনি বলেন, ‘এই দল গঠন এবং বছর শেষে নির্বাচন হলে তাতে তাদের অংশগ্রহণে যদি এমন কোনো সংস্কার করা হয়, যা বিশেষভাবে তাদেরকে সুবিধা দেয়, তা বরং গণআন্দোলনের ফসল, যার হাত ধরে আসবে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, সেই সংস্কারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যেমন সরকারি চাকরজীবীরা অবসর বা চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, কোনো উপদেষ্টাও পারবেন না। যদি পদত্যাগ করে এসেও নির্বাচন করেন, যে সরকারের কিছুদিন আগেও উপদেষ্টার ছিলেন, সেখানে তারা কি নির্বাচনে সুবিধা পাবেন না? তাই এমন কোনো অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া উচিত নয়, যা জনমনে প্রশ্ন তুলবে’।
আলাল বলেন, ‘এদেশে সবার আগে দরকার, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তা নিশ্চিতে দরকার, বিশেষ কোনো দল যেন সরকারি অর্থ ও সরকারের ক্ষমতার প্রভাব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে না পারেন, তার নিশ্চয়তা। সবাই যেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পান, সে নিশ্চয়তাও লাগবে’।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে