এত বড় গণঅভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটে গেছে
জুলাই গণপরিসর আয়োজিত ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংবিধান বিতর্ক: উৎস ও গন্তব্য অনুসন্ধান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার এই বক্তব্য প্রদান করেন গত ২৩ সেপ্টেম্বর। বাংলা একাডেমি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে, তার বক্তব্যের লিখিতরূপ প্রকাশ করা হলো ভিউজ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য। আজ প্রকাশিত হলো আলোচনাটির প্রথম অংশ।
আজকের আলোচনা শুনে আমার মনে হয়েছে যে, আমরা কিছুটা একাডেমিক থাকতে চাইছি। আমি যেভাবে কথা বলি, যাদের সঙ্গে কথা বলি, তারা অতি সাধারণ মানুষ। তাদের অনেক কঠিন বিষয় সহজ করে বোঝাতে হয়। এখানে একাডেমিক বিষয় কথা হচ্ছে, খুবই ভালো, আমিও চেষ্টা করব কিছুটা একাডেমিক থাকার।
বিশেষ ধন্যবাদ জানাব রাশেদ রাহমকে। তিনি একটি লিখিত রূপ দিয়েছেন, অনেক কিছু আছে, আমি দেখেছি, আমার নিজেরও একটি খসড়া খাতা আছে, এটা আমার খুব কাজে লাগবে। শেষে এসে তিনি আমার প্রশংসা করেছেন। যে কারও প্রশংসা পেলে ভালো লাগে। কিন্তু তার একটা কথা বুঝতে পারিনি। তিনি আমাকে বলেছেন, ‘তিনি ব্যক্তিমাত্র’।
রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে এটি কিন্তু মারাত্মক বিপজ্জনক। কেননা ব্যক্তি বলে বিচ্ছিন্ন কেউ থাকে না। সমাজবহির্ভূত ব্যক্তির চিন্তা বলে কিছু থাকে না। আমি যে কথাগুলো বলছি, তা কোনো না কোনো শ্রেণি, কোনো না কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা সমাজের কারও তরফ থেকেই বলছি। ফলে ব্যক্তি হিসেবে আমার নামটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমার চিন্তাটা গুরুত্বপূর্ণ।
যদি এটা আমরা বুঝতে পারতাম তাহলে আজকে যে শিরোনাম দেখছেন, এই শিরোনামটা ভিন্ন হতো। শিরোনামে আছে ‘সংবিধান’, যার সমালোচনা আমি দীর্ঘদিন ধরে করছি। সংবিধান একটা কলোনিয়াল ধারণা। একাডেমিক্যালি, ফিলোসফিক্যালি, পলিটিক্যালি, ক্রিটিক্যালি সব অর্থে। সংবিধান হচ্ছে কলোনিয়াল পাওয়ার, যেটা নিশ্চিন্ত করে যে, এটি দ্বারা একটি জনগোষ্ঠীকে শাসন করবে। ফলে তার একটি আইন দরকার। এ জন্য সংবিধান।
আমরা যদি আজকের এই একাডেমিক আলোচনাটি এগিয়ে নিতে চাইতাম, তাহলে শিরোনাম হতো: সংবিধান ও গণতান্ত্রিক বিতর্ক। অথবা ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনা এবং আমাদের রাজনৈতিক গঠন এরকম একটি শিরোনাম হতো। আমি গঠন শব্দটা যখন ব্যবহার করি, গণঅভ্যুত্থান ও গঠন, এটা যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করে ব্যবহার করেছি। গঠন শব্দটি আমি নিয়েছি কনস্টিটিউশন থেকে। এটি আইন এবং একই সঙ্গে রাজনীতিক গঠন।
আমি গঠন শব্দটা কেন ব্যবহার করি, এটা যদি বুঝাতে চাই, তাহলে গণঅভ্যুত্থানে পরে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি এটা বুঝতে হবে। এটা কী রাজনৈতিক সংকট নাকি সংবিধানের?
আপনারা একাডেমিক কাজ করছেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, আপনাদের কিন্তু উত্তরটা দেয়া উচিত। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু তাদের বহু আগে দেয়ার কথা ছিল। এই যে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল, এটা কি রাজনৈতিক না কি সংবিধানের সংকট? এই উত্তরের মধ্যেই কিন্তু এখনকার গণঅভ্যুত্থানের সংকট নিহিত। এই প্রশ্নের ও উপলব্ধির মধ্যে এটা নিহিত।
এটা যদি সাংবিধানিক সংকট বলেন, যেটা উকিলরা বলেন, এর মধ্যে উকিলিবুদ্ধি ছাড়া আর কিছু নেই। এরা কিন্তু উকিলিচিন্তা ছাড়া পলিটিক্যাল চিন্তা করতে অক্ষম। কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। এখানে হয়তো কেউ কেউ উকিল আছেন। এটা বড় কথা নয়। উকিলিবুদ্ধিটা আমাদের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে।
১৯৭২ সালে উকিলিবুদ্ধির জন্য আমরা বাংলাদেশের জনগণ আমাদের জন্য একিটি গঠনতন্ত্র তৈরি করতে পারিনি। ঐতিহাসিকভাবে এটা আমাদের স্বীকার করতে হবে। এতটি বছর কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অভ্যুদ্বয় হয়েছিল। এই জাতি কীভাবে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে হাজির থাকবে ইতিহাসে, তার রাষ্ট্রব্যবস্থায় উপস্থিত থাকবে এই প্রশ্নটা হাজির হয়েছিল; কিন্তু ১৯৭২ সালে এটা হরণ করা হয় সংবিধানের মধ্য দিয়ে।
এর সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা কিংবা সমাজতন্ত্রের কী সম্পর্ক এটা একদমই তুচ্ছ তর্ক। রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা আবির্ভূত হব, এই অধিকার আমাদের কাছ থেকে হরণ করা হয়েছে ১৯৭২ সালে। আজ এতটা বছর পর আবার সেই সুযোগ এসেছে; কিন্তু আবারও তা হরণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যেহেতু আমরা পরিষ্কার না রাজনৈতিক অধিকার কাকে বলে, কনস্টিটিউশন কাকে বলে, গঠন কাকে বলে। কনস্টিটিউশনের বাংলা অনুবাদ যে সংবিধান না, গঠন, এটা বুঝতে হবে।
গঠনতন্ত্রে বিধান থাকবে। রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যে পরস্পর সম্পর্কিত, তার যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, বিচার করার ক্ষমতা, তার যে নির্বাহী বিভাগ- এটা তো গুরুত্বপূর্ণ ফিলোসফিক্যাল তর্ক, এটা কি পাশ্চাত্য সমাধান করতে পেরেছে? না, পাশ্চাত্য তো পারে নাই। এই ব্যাপারগুলো তো একাডেমিক্যালি আলোচনা করা উচিত ছিল আমাদের।
সে কারণে আমরা মনে করি, এটা একটি রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক সংকটটি কী? আমাদের একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গঠন হতে দেয়া হয়নি ১৯৭২ সালে। ২০২৪ সালে আবারও আমাদের গঠন করবার অধিকার হরণ করা হচ্ছে সংবিধানের নামে। এটা কি আমরা হতে দিতে পারি? এই জন্য গঠন করার যে ব্যাপারটা, আমাদের রাজনৈতিক গঠনের ব্যাপারটা আমি বারবার আমার আলোচনায় নিয়ে আসছি।
আশা করি, আপনারা সবাই বুঝবেন যে, কেন গঠন কথাটা গুরুত্বপূর্ণ? আরও প্রাথমিক স্তরের কিছু ধারণা আমাদের পরিষ্কার হতে হবে। যেমন, রাষ্ট্র ও সরকারের কী পার্থক্য? অধিকাংশ মানুষ রাষ্ট্র বলতে সরকার বুঝেন। এটাও কিন্তু একাডেমিক লেবেলে পরিষ্কার করার কথা ছিল। আমরা যখন বলি যে, সংবিধানকে আমরা ফ্যাংশনালি দেখতে চাই; কিন্তু সংবিধান তো ফ্যাংশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট না। এ জন্য গঠন কথাটা যদি বলি, তার সঙ্গে আমার জাতির সব ঐতিহাসিক উপাদানই এসে যুক্ত হয়। তার মূল্যবোধ, আদর্শ, ঐতিহ্য নৈতিকতাবোধ সবই। আমি বাংলাভাষী, যার জন্য ১৯৭১ সালে আমি যুদ্ধ করেছি। এখন কি এটা বাদ দিব? আমি তো এটা বাদ দেব না; কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আমার সমাজের মধ্যে একটা বিরোধ আমি টিকিয়ে রেখেছি, বাংলাভাষার সঙ্গে আমার ধর্মের অহেতুক এক বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। এই বিরোধের কোনো যুক্তি ছিল না। ইসলামের সঙ্গে কী বিরোধ আছে আমার? কী দরকার ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটা যুক্ত করার?
যদি একটি দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ হয় তাহলে এমনিতেই ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যাবে। তাহলে কেন আমি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করব? এই কথাটা পরিষ্কার বলতে হবে। তার মানে কি আজকে যদি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল এসে বলে আমরা ইসলাম কায়েম করতে চাই, আপনারা কি করতে দেবেন তাদের? আমি তো দেখিনি, কোনো সেক্যুলার ইসলামপন্থিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছে, না, ইসলামিক রাষ্ট্র বলে কোনো কনসেপ্টই নাই। আপনি শুঁরিখানার সামনে গিয়ে যদি ইসলামিক শুঁরিখানা লিখেন, এটা হবে? ঠিক ইসলামিক রাষ্ট্র একটা শুঁরিখানার মতোই। এটা হয় না, কারণ ইসলামে রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।
রাষ্ট্রের ধারণা কলোনিয়াল, পাশ্চাত্য থেকে পাওয়া। এটা ক্রিশ্চিয়ান কনসেপশন। ইটস এ থিওজিক্যাল কনসেপশন। এটা পাশ্চত্য থেকে আসছে, কারণ, স্রষ্টা সার্বভৌম, স্রষ্টার সার্বভৌম গেছে গির্জার কাছে, গির্জার সার্বভৌম গেছে রাজার কাছে, রাজার কাছ থেকে পরে জনগণের হাতে এসেছে। এই হলো ইতিহাস, আমি সংক্ষেপে বললাম।
আজকে যারা ইসলাম ধর্ম মানেন, তারা কেন একটা খ্রিষ্টীয় তত্ত্ব মেনে নিবেন? এটা তো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তার তো আরও ভিন্নরকম চিন্তা থাকতে পারে। সেটা তো ইসলামেও থাকতে পারে। ইসলামে কোনো লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ধারণা নেই। আপনার প্রশাসন আছে, একই সঙ্গে খেয়াল করেন, আপনি যখন রাষ্ট্র নিয়ে আলাপ করবেন তখন কিন্তু প্রশাসন আলাদা করে দেখবেন না। রাষ্ট্র একই সঙ্গে শক্তি এবং এথিকও, যেটা আমরা হেগেলের কাছ থেকে পেয়েছি। রাষ্ট্র একটি এথিক্যাল আইডিয়া। এর একটা নৈতিক প্রকাশ আছে। এবং একই সঙ্গে এটা একটা প্রশাসন।
রাষ্ট্রের আলোচনায় ক্ষমতার প্রশ্ন জড়িত। ক্ষমতার প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা তরুণ বয়সে লেনিন পড়েছি, তারা জেনেছি রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের একটা হাতিয়ার। তো যারা এটা পড়ে পড়ে বড় হয়েছে, তারা তো জেনেছে রাষ্ট্র বল প্রয়োগের হাতিয়ার, তো তারা গিয়ে সরকারি অফিস-আদালত ভাঙতে শুরু করে দিয়েছে। সেক্রেটারিয়েট ভাঙতে শুরু করেছে। তার মানে রাষ্ট্র আর সরকার আলাদা হয়ে গেছে। রাষ্ট্র যে আমাদের চিন্তার মধ্যে থাকে এ নিয়ে আমাদের পরিষ্কার ধারণা হয়নি। তাই রাষ্ট্র প্রশ্নে আমরা সংবিধান নিয়ে আলাপ করি এটা ভয়ংকর।
যার কারণে আমাদের এখানে এত বড় একটা গণবিপ্লব হওয়ার পরও একটা সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব ঘটে গেছে। এত বড় একটা বিপ্লবের পর আপনি যে চুপ্পুর কাছে গিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন, শেখ হাসিনার সংবিধান গ্রহণ করলেন। কেন গ্রহণ করলেন? শেখ হাসিনার পুরো রাষ্ট্রটা তো ওই সংবিধানেই আছে। আপনি তো পুরো রাষ্ট্রটাই টিকিয়ে রেখেছেন। এখন কী করছেন? এখানে-ওখানে নিয়োগ দিচ্ছেন। এটা-ওটা ঠিক করার বাহানা করছেন। এগুলো কী? আপনি তো তখনই জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আপনি যখন বলেছেন, ‘আমি এই সংবিধান সংরক্ষণ করিব’ তাহলে আপনি এখন কী করে আলী রিয়াজকে দিয়ে সংবিধান কমিশন করেন, এটা অবৈধ না?
ফরহাদ মজহার: কবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে